পাপের সভ্যতা বর্জনীয়
শরিফ আহমাদ
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কখনো আমরা এমন অনেক আচরণ ও সভ্যতাকে আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করি যা আমাদের জীবনের প্রকৃত আনন্দকে ম্লান করে দেয়। ভালোর পরিবর্তে মন্দ হয়ে যায় কাজের ফল বা পরিণতি। পরিণামে দুনিয়া বা আখেরাতে হতে হয় ক্ষতিগ্রস্ত এমন সব সভ্যতাকে একজন সচেতন মুসলিম কখনো গ্রহণ করতে পারে না। আমাদের জীবনের বিভিন্ন আচরণ, চলাফেরা, মতামত বা রুচিবোধ কালক্রমে সভ্যতায় রূপ নেয়। যে সভ্যতা পাপের পথ উন্মোচিত করে এমন কিছু নব্যসভ্যতা হলো- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এ স্লোগানে নিজ ধর্মকে শিথিল করে অন্য ধর্মের প্রথা বা পূজা অর্চনাকে মৌন সমর্থন করা হয়, যা হালে পাপের সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। নারীর উদার স্বাধীনতা। নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে অর্ধবসনে ঘরের বাইর করা এটিও একটি পাপের সভ্যতা। বৈববাহিক সম্পর্ক ছাড়া নারী পুরুষ লিভ টুগেদার করা, বিয়ের আগে বর কনে একে অপরকে বুঝে নেওয়ার নামে নানাভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া, সমকামিতাকে বৈধ করার নানা উদ্যোগ বা কার্যত প্রতিফলের চেষ্টা, মানবতার কল্যাণে প্রযুক্তিকে ব্যবহার না করে নানা ধরনের প্রতারণামূলক বা অশ্লীলতাঘিরে কদর্যময় কথা, কাজ, ছবি, ছায়াছবি, রুচিহীন ও আপত্তিজনক কৌতুক, গান, অভিনয় এসবই পাপের সভ্যতা। কেননা তাতে মানবতা ও সুস্থ সভ্যতার কিছু থাকে না। কল্যাণকর সভ্যতাকে ক্ষমতার দাপট প্রয়োগ করে অকল্যাণকর বানানো, মিথ্যাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সত্য প্রমাণিত করার হীন প্রয়াসসহ এ জাতীয় কাজগুলো নিঃসন্দেহে পাপের পথ ও পঙ্কিল সভ্যতার দ্বার উন্মোচিত করে। স্বাধীনভাবে সঠিক নিয়মে ধর্ম পালনে বাধা দান, ন্যায়নীতি, উন্নত চরিত্র, মানবিক গুণাবলির বিকাশের পথে কোনো দল বা মত অন্তরায় হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক ও ক্ষতিকর একটি সভ্য সমাজের জন্য। এসব আচরণের সমষ্টিই এক সময় হয়ে ওঠে সভ্যতার কলঙ্কময় অধ্যায়। যা বাঞ্চিত নয়, বরং বর্জিত।
কোরআনে পাপের সতর্কবার্তা : মানুষের জীবনে দৈনিক কমবেশি ভুল হয়। প্রতিদিন হয় ছোট বড় অনেক পাপ। আল্লাহর অবাধ্যতা ও প্রিয় নবীজির সুন্নাতের প্রতি বিমুখতা হলো বড় পাপ। মূলত ছোট বড় সব পাপই বর্জনীয়। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা প্রকাশ্য পাপ কাজ পরিত্যাগ কর এবং পরিত্যাগ কর গোপনীয় পাপ কাজও। যারা পাপ কাজ করে তাদের অতি সত্ত্বরই তাদের মন্দ কাজের প্রতিফল দেয়া হবে। (সুরা আনআম : ১২০) এই আয়াতে পাপের ব্যাখায় তাফসিরে ইবনে কাসীরে নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস উলে¬খ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তোমার অন্তরে যা খটকা লাগে এবং তুমি এটা পছন্দ কর না যে, লোকের কাছে তা প্রকাশ হয়ে পড়ুক তাই হলো পাপ। (মুসলিম : ৪/১৯৮০)। পাপের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আরো বলা হয়েছে, আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন পাপ। (সুরা আরাফ:৩৩)।
কোনো পাপই ছোট নয় : কোরআন সুন্নাহ ও পরিণতির ভিত্তিতে পাপকে প্রধানত কবিরা এবং সগিরা দুই ভাগে বিভক্ত করা হলেও সব পাপ বর্জনীয়। কেননা পাপ হলো শত্রুর মতো। শত্রুর ক্ষেত্রে যুদ্ধের কৌশল হলো শত্রুকে কখনো ছোট করে দেখতে নাই। এ সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, তুমি ওই সকল গোনাহ থেকে বেঁচে থাকো যেগুলোকে ছোট বলে ধারণা করা হবে। (আলজামি : ২৬৮৬)। পাপ থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিবর্গ আল্লাহর সান্নিধ্য সহজে অর্জন করতে পারে। পাপ থেকে দূরে থাকাটাও একপ্রকার ইবাদত। এ সম্পর্কে একটি হাদিস পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা (রা.) একদিন নবীজি (সা.)-কে বললেন অনেকে রাত জেগে ইবাদত করে। আমরা মহিলারা একটু অলস প্রকৃতির। রাত জেগে ইবাদাত করতে পারি না। শুধু ঘুম আসে। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ঘুম বেশি। তো আমাদের শুধু ঘুম আসে। ফলে যারা রাত জেগে ইবাদত করে তাদের থেকে তো পেছনে পড়ে গেলাম। তখন আয়েশা (রা.) কে নবীজি (সা.) সান্ত¡না দিয়ে বললেন, যে ব্যক্তি খুব ইবাদতকারী থেকেও অগ্রসর হয়ে আনন্দ পেতে চায় তার জন্য উচিত হলো যাবতীয় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। অর্থাৎ তুমি যদি গোনাহ থেকে বেঁচে থাকো তাহলে রাত জেগে ইবাদতকারীর থেকেও আগে বেড়ে যেতে পারবে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৪৯৫০)।
পাপ কাজে দুনিয়ার ক্ষতি : পাপের কারণে অপরাধীরা অবশ্যই পরকালে শাস্তি ভোগ করবে। তবে কোনো কোনো পাপের শাস্তি আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন, আমি অবশ্যই তাদের গুরু শাস্তির পূর্বে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা সিজদা : ২১)।
দুনিয়াতে পাপের শাস্তি সম্পর্কে এ হাদিসটি উল্লেখযোগ্য। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন কোনো জাতির মধ্যে আত্মসাৎ বৃদ্ধি পেলে সে জাতির লোকদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করা হয়। কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিমাপ ও ওজনে কম দিলে তাদের রিজিক সংকুচিত করা হয়। কোনো জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে বিচার-ফায়সালা করলে তাদের মধ্যে রক্তপাত বিস্তৃতি লাভ করে। কোনো জাতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আল্লাহ তাদের ওপর শত্রুদল চাপিয়ে দেন। (মুয়াত্তা মালেক : ১৩২৩)। দুনিয়াতে আরো বেশকিছু পাপের নগদ শাস্তি দেয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, পাপী ব্যক্তি দীনি ইলম থেকে বঞ্চিত হয়, কামাই রোজগারের বরকত হারিয়ে ফেলে, হায়াত কমে যায়, বালা মসিবত নেমে আসে, কাজেকামে বাধা বিপত্তি চলে আসে, মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব হয় না ইত্যাদি।
পাপীর শেষ আশ্রয়স্থল : পৃথিবীর মানুষ পাপীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কত আইন কানুন তৈরি করেছে অথচ মহান আল্লাহ সব পাপীকে ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। একজন পাপীর শেষ আশ্রয়স্থল তিনি। যত বড় পাপী হোক না কেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে অবশ্যই তিনি ক্ষমা করেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, আর যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল। (সূরা ত্বহা: ৮২)। একজন গোনাহগার বান্দা যখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহপাক খুব খুশি হন। রাসুল (সা.) বলেন তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হও আল্লাহতায়ালা তার বান্দার তওবাতে এর চেয়েও বেশি খুশি হন। (বোখারি : ৬৭০৯)। তাই গোনাহ করার সঙ্গে সঙ্গে তওবা ইস্তেগফার করা উচিত। প্রকৃত মোমেনগণ তওবা ইস্তেগফারকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নিয়েছেন।
পাপ বর্জনের সহজ নিয়ম : একজন পাপী ব্যক্তি একদিনে বা এক রাতে গোনাহের অভ্যাস ছেড়ে দিতে পারে না। অপরাধ প্রবণতা কামানোর জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে, প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাতে হবে তবে এক সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে মদদ। কোরআনের বর্ণনা, আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদের আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন। (সূরা আনকাবুত : ৬৯)। এ সম্পর্কে হাদিসের বর্ণনা হলো, আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মোমেন দুর্বল মোমেন থেকে অধিক উত্তম ও প্রিয়। তুমি ওই জিনিসে যত্নবান হও যাতে তোমার উপকার আছে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো ও উৎসাহহীন হয়ো না। (মুসলিম : ৪৮২২)।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে পাপ বর্জন করার অসংখ্য নীতিমালা আছে। গোনাহ মুক্ত জীবন গঠন করার অনেক উপমা আছে। সেগুলো অনুসরণ করার পাশাপাশি পাপ যেন না হয় এজন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া পাপের পরিবেশে নিজেকে জড়ানো থেকে বিরত রাখা, কথায় আচরণে কিংবা অনুষ্ঠান বা আয়োজনে পাপমুক্ততার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করা হলে জীবন পাপমুক্ত করা সহজ হয়ে ওঠে।
লেখক: কবি ও আলেম