সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশজুড়ে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এবং খুন-খারাবি ইত্যাদি অপরাধের ঘটনা অহরহ ঘটছে। উঠতি বয়সের স্কুল-কলেজগামী কিশোরদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির প্রসারে সহজেই তাদের মনোজগতে সন্ত্রাসবাদীরা হানা দিচ্ছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। এলাকার বড় ভাইদের মদদে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের অপরাধসমূহের রূপ বদলাচ্ছে, হিংস্র হচ্ছে, নৃশংস হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এদের মধ্যে ছিন্নমূল পরিবারের বিপথগামী সন্তান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছে। বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার প্রয়োজনে কিশোর বন্ধুরা মিলে প্রথমে একটি গ্রুপ তৈরি করে। পরে একসঙ্গে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রয়োজনে অস্ত্র বহন ও ফাঁকা ফায়ারিং করে এবং গ্রুপ করে মোটরসাইকেল নিয়ে দেয়া হয় মহড়া। এভাবে নানা অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এ অপ্রতিরোধ্য ভাব ও মানসিকতার কিশোর গ্যাং সমাজ ও সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
কিশোর মনে পাপের গীত : কিশোর মনে পাপের স্বাদ কিশোরকে পাপের পথে নিয়ে যায়। একজন কিশোর পাপ করার সাহস পেত না যদি সামাজিক বন্ধন মজবুত হতো কিংবা ছোটরা বড়দের, গুরুজনের কথা মেনে চলার মানসিকতা লালন করত। ক্রমে সমাজ থেকে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার মন ও মানসিকতা কমে যাচ্ছে যার ফল হচ্ছে অপরিণামর্দশী কিশোর গ্যাং। আবার কখনো দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতারা এ অবোধ শিশুদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে পাপের পথে ঠেলে দিচ্ছে। ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত জীবনের দিকে। ফলে কিশোররা রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে আরো মারমুখী বা হিংস্র হয়ে ওঠছে। তখন তারা পাপকেই খুঁজে সুখের নীড়। স্বপ্নের জগৎ। আর মন গেয়ে ওঠে পাপের গীত।
নেপথ্য কারণ ও প্রতিকার : কিশোরদের পথভ্রষ্ট হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় আর দ্বীন শিক্ষায় অবহেলা প্রদর্শন। ইসলামি জীবনবোধ ও জীবনব্যবস্থার অনুসরণের অভাবই আমাদের নানা সমস্যায় পর্যুদস্ত করে রেখেছে। এসব সমস্যা থেকে মুক্তির যথার্থ ও স্থায়ী উপায় হচ্ছে, সমাজের সর্বস্তরে ইসলামি জীবনবোধের বিস্তার ও ইসলামি জীবন-ব্যবস্থার অনুসরণ। একজন ধর্মপ্রিয় শিক্ষার্থী, ধর্মীয় অনুরাগ আর অনুসরণ নিয়ে বেড়ে ওঠা ছাত্রছাত্রী কখনোই বিপথে যেতে পারে না। কখনোই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে না। কারণ সন্ত্রাসের ব্যাপারে ইসলাম ধর্মে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আর হুঁশিয়ারি বার্তা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে কেউ কোনো মোমেনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করল, তার শাস্তি জাহান্নাম। তথায় সে থাকবে দীর্ঘকাল। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভয়ংকর শাস্তি।’ (নিসা : ৯৩) জীবনের অতি মূল্যবান অংশের নাম তারুণ্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার, আত্ম গঠনের এ এক সতেজ অধ্যায়। আর তাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ-সমাজ। এরাই তো নতুন সূর্য- সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার। এই সূর্য ক্ষয় ও অবক্ষয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়ার মানে, সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। কাজেই আমাদের কিশোর-তরুণদের অবক্ষয়ের রাহুগ্রাসে পতিত হওয়া থেকে অবশ্যই ফেরাতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির পাশাপাশি সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে সন্ত্রাসবাদের কুফল সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান এবং সতর্ক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করলে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা সন্ত্রাসের ধরন, প্রকৃতি এবং এছাড়াও সন্ত্রাসে সম্পৃক্ত হওয়ার লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে এবং আত্মসংশোধনে উদ্বুদ্ধ হবে। ফলে সন্ত্রাসের মতো জীবন-বিনাশি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সহজেই সম্পৃক্ত হতে উৎসাহী হবে না।
শিক্ষালয়ের পাশাপাশি পরিবারকেও এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করতে হবে। সামাজিক নেটওয়ার্কে বুদ হয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে না তাকালে মা-বাবাকেও একসময় তাদের সন্তানদের অপকর্মের খবর পেয়ে ভীষণ মনোকষ্টে পড়তে হয়। পুরো পরিবারটি তখন বিষণ্নতায় ডুবে মরে। তাই সমাজের অংশ হিসেবে পরিবারকেও তার সজাগ কল্যাণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ নিরসন বা নিয়ন্ত্রণে সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ রেখে আন্তরিক ও নির্মোহভাবে কাজ করে যেতে হবে। অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। অস্ত্রের সরঞ্জামাদি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছাড়া আমদানি রপ্তানি নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসবাদের ভয় ও হুমকিধমকি থেকে মানুষকে রেহাই দিতে রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও পুলিশ বাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী, যুগোপযোগী এবং উজ্জীবিত রাখতে হবে।
লেখক: তরুণ আলেম