চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানের নাম কীভাবে এলো
আবদুল মালেক
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হালিশহর : আরবি ‘হাওয়ালে শহর’ থেকে উদ্ভুত। অর্থ- ‘শহরতলি’। এটি ছিল আরব বণিকদের সাময়িক বসবাসের জন্য নির্ধারিত স্থান।
সুলকবহর : আরব বণিকদের নৌবাণিজ্যের যুগে প্রাচীন কর্ণফুলী নদীর যে স্থানটিতে বাণিজ্যতরী অবস্থান করত সেটি ‘সুলকুল বহর’ নামে খ্যাত ছিল। আরবি ‘সুলকুল বহর’ শব্দের অর্থ- ‘বাণিজ্যতরীর বিরতি স্থান- পোতাশ্রয়’। পরবর্তীতে এলাকাটি বর্তমানের ‘সুলকবহর’ নামে বিবর্তিত হয়েছে।
ষোলশহর : সুলকবহরের কাছের এই জায়গাটি ‘চাহেলে শহর’ নামে পরিচিত ছিল। আরবি চাহেলে শহর নামের অর্থ ‘নদীর তীরবর্তী শহর’ যা কালক্রমে ষোলশহর নাম ধারণ করে।
আন্দরকিল্লা : আরকানি আমলে এখানে প্রাচীন দুর্গ ছিল। নাম ছিল- ‘চাটিগাঁ দুর্গ’। ১৬৬৬ সালে মোগল বাহিনী আরকানি বাহিনীকে পরাজিত করে এই দুর্গ দখল করলে প্রধান সেনাপতি উমেদ খাঁ এই দুর্গের নাম দেন ‘আন্দরকিল্লা’।
লালদিঘি : বর্তমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরে ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে একটি পাকা ভবন ছিল যেটির দেওয়ালে লাল রঙ দেয়া হয়েছিল যা ‘লালকুঠি’ নামে পরিচিত ছিল। লালকুঠির সন্নিকটের দিঘিটি ‘লালদিঘি’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
হাজারি লেন : আন্দরকিল্লার মধ্যস্থিত এই গলিতে বারোজন মোগল ‘হাজারি’ বা সেনাপতির অন্যতম ভগবান সিং হাজারির বাড়ি ছিল। তা থেকে এই নামের উৎপত্তি। মেহেদিবাগ : চট্টগ্রাম শহরের এই এলাকাটিতে এককালে মেহেদি গাছের আধিক্য ছিল।
চকবাজার : পূর্ব নামণ্ড ‘চৌরাস্তার বাজার’। আরকানিদের হটিয়ে চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এই বাজার স্থাপনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের গোড়াপত্তন হয়। চট্টগ্রামের ১৮তম মোগল শাসক নবাব অলি বেগ খাঁ এর নামকরণ করেন ‘চকবাজার’। চকবাজারেই ‘অলি খাঁর মসজিদ’ নামে পুরোনো একটি মসজিদ এখনো রয়েছে। কাপাসগোলা : কার্পাস শব্দের বিকৃত রূপ ‘কাপাস’। প্রাচীনকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত কার্পাস তুলা এখানে বিক্রির জন্য গোলাজাত বা জমা হতো বলে এই এলাকাটি ‘কাপাসগোলা’ নামে খ্যাত হয়। কাঠগড় : এই স্থানে আরকানিদের কাঠের নির্মিত দুর্গ ছিল। কাঠের দুর্গের অপর নাম ছিল ‘কাঠগড়’।
লাভ লেইন : ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল ইংরেজ কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। এই এলাকায় ইংরেজ নারী-পুরুষের প্রকাশ্য প্রেমের কারণে এই নামের উৎপত্তি। আলকরণ : আলকরণ অর্থ- গণ্ডারের শিং। আরব বাণিজ্যের যুগে এই এলাকায় গণ্ডারের শিংয়ের আড়ত ছিল। তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে গণ্ডারের শিং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি হতো।
অভয় মিত্রের ঘাট : ফিরিঙ্গি বাজার নিবাসী ধনাঢ্য রায় বাহাদুর অভয়চরণ মিত্রের নামানুসারে এই ঘাট।
দেবপাহাড় : ব্রিটিশ সরকার শরচ্চন্দ্র দাস নামের এক ব্যক্তির কাজে খুশি হয়ে তাকে পুরস্কারস্বরূপ ‘জয়নামা বা জাঁহানুমা’ পাহাড়টি প্রদান করেন। শরচ্চন্দ্র ওই পাহাড়শীর্ষে একটি দেবমন্দির নির্মাণ করে নতুন নাম দেন ‘দেবপাহাড়’। চন্দনপুরা : পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত আগরকাঠ প্রাচীনকাল হতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে ইউরোপে রপ্তানি হতো। আগরকাঠ সেকালে চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘চন্দনকাঠ’ নামে খ্যাত ছিল। বর্তমান চন্দনপুরা ছিল এসব চন্দনকাঠের গোলাঘর বা মজুতস্থান। পাথরঘাটা : কথিত আছে- পীর বদর শাহ আরব দেশ থেকে সমুদ্রপথে একটি পাথরের উপর সওয়ার হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এবং সেই পাথরখানি কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী একটি স্থানে থেমে যাওয়ার পর তিনি তীরে উঠে আসেন। তখন থেকে এই জায়গার নাম ‘পাথরঘাটা’ নামে খ্যাত হয়।
এনায়েত বাজার : এনায়েত খাঁ নামের একজন মোগল সেনাপতির নামানুসারে এই নামকরণ হয়েছিল। এনায়েত বাজার ছিল তৎকালীন মোগল সেনাবাহিনীর মুসলমান সেনাদলের আবাসস্থল। টাইগার পাস : দুই পাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এই রাস্তাটি সোজা চলে গেছে সমুদ্রে। ১৯ শতকের শেষার্ধেও এসব পাহাড় ছিল জনবসতিহীন, গভীর জঙ্গলাবৃত এবং বাঘের আখড়া। ১৮৬২ সালে চট্টগ্রামে কর্মরত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান মিস্টার ক্লের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়- এখানে নিয়মিত বাঘের আক্রমনে লোকে প্রাণ হারাত, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে এই রাস্তা ধরে বাঘ চলাচল করত বিধায় এটি ‘টাইগার পাস’ নামে খ্যাত হয়। সেই ঐতিহাসিক স্মৃতির স্মারক হিসেবে বর্তমানে টাইগার পাস এলাকায় টাইগার বা বাঘের মূর্তি স্থাপিত আছে।
বাঘ ভ্যালি : চট্টেশ্বরী রোডের ওয়ার সিমেট্রির সন্নিকটস্থ এই পাহাড়ি এলাকাটি একসময় ছিল জনমানবহীন ও জঙ্গলাবৃত- সেখানে দিনে দুপুরে বাঘ বিচরণ করত। এই এলাকায় বাঘ ধরার জন্য ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা ছিল, জীবন্ত বাঘ ধরতে পারলে মিলত পুরস্কার। এভাবেই এলাকাটি বাঘ ভ্যালি বা বাঘের উপত্যকা হিসেবে খ্যাত হয়।
খুলশী : আরবি ও ফারসি ভাষার প্রচলিত ‘খোলাসা’ শব্দ থেকে খুলশী নাম উদ্ভুত। খোলাসা অর্থ খোলামেলা, জনবিরল স্থান। কাজির দেউড়ি : কাজি মির আবদুল গণির নামানুসারে এই এলাকা খ্যাত হয়েছে। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে তিনি দিল্লি গমন করে তৎকালীন মোগল সম্রাটের কাছ থেকে চট্টগ্রামের কাজী (বিচারক) এর দায়িত্ব লাভ করেন এবং স্টেডিয়ামের পূর্বদিকে নিজের দেউড়ি (বহির্বাড়ি) ও মসজিদ স্থাপন করেন।
আসাদগঞ্জ : পটিয়া থানার বড় উঠান গ্রামনিবাসী ১৮ শতকের প্রখ্যাত জমিদার আসাদ আলী খাঁর নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে।
বকশীর হাট : ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে বাঁশখালীর নিবাসী বকশী হামিদ নামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই বকশীর হাট স্থাপন করেন। বাঁশখালীর ইলসা গ্রামে বকশী হামিদের নামে দিঘি, মসজিদ ইত্যাদি নিদর্শন আজো বিদ্যমান।
খাতুনগঞ্জ : উনবিংশ শতকে চট্টগ্রামের একজন অভিজাত, গুণী ও খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন খানবাহাদুর হামিদউল্লাহ খাঁ। তিনি ফারসি ভাষায় ‘তারিখে হামিদী’ শিরোনামে প্রথম চট্টগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। হামিদউল্লাহ খাঁর দ্বিতীয় পত্নীর নাম ছিল- খাতুন বিবি। কালক্রমে তার স্ত্রী খাতুন বিবির নামে এই খাতুনগঞ্জ গড়ে ওঠে।
রহমতগঞ্জ : ১৬৯৮ সালে নবাব রহমতুল¬া চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিয়োগ হলে এই স্থান তার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমান জেএম সেন হলের উত্তর পাশে নবাব রহমতুল্লাহর কবর বিদ্যমান রয়েছে।
ফিরিঙ্গি বাজার : ১৬ শতকের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে পর্তুগিজ বণিকরা আগমন করে। তারা এদেশে ‘ফিরিঙ্গি’ নামে খ্যাত ছিল। অত্র এলাকাটি ছিল ফিরিঙ্গি বণিকদের আড়ত। রেয়াজুদ্দিন বাজার : এই এলাকাটি একসময় ছিল জমিদার দেওয়ান বৈদ্যনাথের বাগানবাড়ি। এখানে সেগুনবাগিচা ছিল। পরবর্তীতে এই এলাকাটি কিনে নেন চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান বিএ, বিএল শেখ রেয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির পিতা শেখ মো. ওয়াশীল। শেখ রেয়াজুদ্দিন এই এলাকার প্রভূত উন্নয়ন ঘটালে এটি তার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। চেরাগী পাহাড় : কথিত আছে- আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হজরত বদর শাহ নামক এক সুফি সাধক মাটি নির্মিত একটি চেরাগ বা চাটি হাতে নিয়ে সমুদ্রে পাথরের উপর আরোহন করে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছান। তখন চট্টগ্রাম ছিল গভীর অরণ্যাবৃত এবং জিনপরীর আবাসস্থল। বদর শাহ একটি অনুচ্চ পাহাড়ে উঠতে গেলে জিনপরীরা বাধা প্রদান করে এবং থাকার অনুমতি দেয় না। তখন বদর শাহ রাতের অন্ধকারে হাতের চেরাগটি পাহাড়ে রেখে জ্বালাবার স্থানটুকু দিতে অনুরোধ করলে জিনেরা রাজি হয়। কিন্তু চেরাগ জ্বালানোর পর চেরাগের তেজ সহ্য করতে না পেরে জিনেরা স্থান ত্যাগ করে এবং বদর শাহ সেখানে ইবাদাতের স্থান তৈয়ার করেন। উলে¬খ্য, ‘চেরাগী পাহাড়’টি ‘চাটির পাহাড়’ নামেও পরিচিত, চাটি অর্থ মৃৎপ্রদীপ। অনেকে ধারণা করেন- এই ‘চাটি’ শব্দ থেকেই চাটিগাঁ- চাটগাঁ- চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। বর্তমানে এই চেরাগী পাহাড়ে চেরাগসদৃশ একটি সুন্দর স্থাপনা নির্মিত আছে। সৌজন্যে: সাঈদ আহসান খালিদ (মেমোরিঃ ২০১৮) তথ্যসূত্রঃ *বন্দর শহর চট্টগ্রাম: আবদুল হক চৌধুরী *চট্টগ্রামের ইতিহাস: পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস: ওহীদুল আলম, বৃহত্তর চট্টল: মোহাম্মদ নুরুল হক)।