মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত একজন আলেম। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। ইসলামি শিক্ষার প্রসার-প্রচার, আধ্যাত্মিক সাধনা, জ্ঞান-গবেষণার ময়দানে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক এই ব্যক্তির হাত ধরে বাংলাদেশে সূচনা হয়েছিল ইসলামি রাজনীতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার লাখো অনুসারী। স্বীয় কর্মগুণ আর নববী আদর্শের জন্য ইতিহাসে আজ তিনি অমর।
জন্ম ও শিক্ষা
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ১৮৯৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার লুধুয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে ?জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইদ্রিস ও মায়ের নাম খাদিজা। পরিবারেই হয় তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। দুবলারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে চন্দ্রগঞ্জের বাইতুল আমান জামে মসজিদ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন।
তারপর লাকসামের নবাববাড়ি মাদ্রাসা ও খিলবাইছা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে ১৯১৩ সালে তিনি পানিপথের উদ্দেশে পাড়ি জমান। সেখানে কোরআন মুখস্থ ও তাজবীদে পাণ্ডিত্য লাভ করায় স্বীয় উস্তাদ তাকে হাফেজ্জী উপাধি প্রদান করেন। ১৯১৬ সালে পানিপথ ত্যাগ করে মাওলানা থানবীর পরামর্শে মাজাহির উলুম সাহারানপুর মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন?। ১৯২৩ সালে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে ১৯৯৪ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর বিভাগে অধ্যয়নে মনোযোগী হন এবং সেখান থেকে তিনি ইসলামি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন ও অবদান
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) দেশে ফিরেই সদর সাহেব খ্যাত আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব পীরজি (রহ.) হুজুরের সুপরামর্শ ও সহযোগিতায় দেশের আনাচে-কানাচে দেওবন্দের নিয়মে নিত্যনতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাদ্রাসা হলো বড় কাটারা, ফরিদাবাদ ও লালবাগ মাদ্রাসা। হাফেজ্জী হুজুর ১৯৬৫ সালে একক উদ্যোগে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে নুরিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
কোরআনের পাখি হাফেজ্জী হুজুরের কোরআন শিক্ষা দীক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। প্রতি রমজানে নুরিয়া মাদ্রাসায় নাদিয়াতুল কোরআনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব ও নূরানী শিক্ষাপদ্ধতির আবিষ্কারক আল্লামা বেলায়েত হোসাইনের মাধ্যমে কোরআনের প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করতেন।
তার জীবনের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব প্রতিষ্ঠা করা। মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও রহমে তার স্বপ্ন আজ বাস্তবের পথে।
তালিম ও তাজকিয়া
হজরত হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) ছিলেন নবীর যোগ্য নায়েব। নবীর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে সাহাবায়ে কেরামের মতো জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়েছেন। মাদ্রাসায় নিয়মিত হাদিস, তাফসির, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ে দরস প্রদান করতেন। তিনি ছাত্রদের কোরআনুল কারিম দেখে দেখে পড়ার প্রতি বিশেষ তাগিদ দিতেন। তার ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), সৈয়দ ফজলুল করিম (রহ.), মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) ও আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী (রহ.) প্রমুখ।
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) নিজে মাগরিবের পর আওয়াবিনে তিন পারা কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তাহাজ্জুদে তিন পারা আর হাঁটা চলার মধ্যে তিন পারা দৈনিক মোট ৯ পারা কোরআন তেলাওয়াত করতেন।
তিনি ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীর মহান সংস্করণ হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.)-এর একজন শীর্ষ খলিফা। তাজকিয়ার ময়দানে ছিল তার সরব উপস্থিতি?। খানকা, মাহফিলে বেশ জোরালোভাবে তাজকিয়ার দায়িত্ব আঞ্জাম দিতেন। হুজুরের বিখ্যাত শিষ্যদের দিকে তাকালে কিছুটা অনুমান করা যায়। হুজুরের অধিক পরিমাণে জিকিরের প্রসঙ্গে হজরত আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী (রহ.) বলতেন, তিনি এত বেশি জিকির করতেন যে, তার ঠোঁট নাড়ানোর মধুর দৃশ্য দেখে বাচ্চারা পর্যন্ত অবাক হয়ে দেখত।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জীবনের উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য বহুল ঘটনা হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ। তিনি রাজনীতির মাঠে এসে ইসলামি রাজনীতির মোড়ক উন্মোচন করেন। ওই সময় আলেম সমাজ রাজনীতি বিমুখতার বিপরীতে তাওবার রাজনীতির আহ্বান জানান। ২৯ নভেম্বর ১৯৮১ সালে তিনি খেলাফত আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বটগাছ মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২১ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে তার নেতৃত্বে ১০টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৫ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রার্থী হয় এবং দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ইসলামের শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ১৯৮২ সালে হাফেজ্জী হুজুর ইরাক-ইরান সফর করেন এবং ইমাম খোমেনী ও সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা চালান। হাফেজ্জী হুজুর বাংলাদেশে তওবার রাজনীতির আহ্বায়ক। তিনি ছিলেন বুজুর্গ ব্যক্তি। চেয়েছিলেন দেশময় বয়ে যাক পাপমুক্ত খোশবুময় সমীরণ। সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মানবপ্রেম ও আল্লাহপ্রেমের এক অপূর্ব সেতুবন্ধন তৈরি করার জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। পাপ বর্জন করে রাজনীতিতে আসা কিংবা তওবা করে অসাধুতা পরিহার করে রাজনীতিকে পাপমুক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি।
ইন্তেকাল ও দাফন
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) কে ১৯৮৭ সালের ২৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে ৭ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। হুজুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের ইমামতিতে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী, ইসলাম প্রেমী শোকার্ত জনতা অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। এমন একজন জাতীয় নেতা এ যুগে পাওয়া দুষ্কর। হুজুরের অনেক রক্ত ঘামে প্রতিষ্ঠা করা জান্নাতের বাগান নুরিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। (তথ্যসূত্র : মাসিক আল কাউসার, মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর, স্মরণীয় মনীষা, হাফেজ্জি হুজুরের জীবনী, হাফেজ্জী হুজুর স্মারকগ্রন্থ ও উইকিপিডিয়া)।