মুসলমানদের স্পেন বিজয়
দিদার শফিক
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। আকাশে উড়িয়েছেন ইসলামের বিজয়ী পতাকা। তারা আদর্শে যেমন ছিলেন সর্বসেরা সমর নৈপুণ্যেও ছিলেন জগদ্বিখ্যাত। তাদের শাসনামলকে বলা হয়, খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামল। খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলের পর ৬৬১ সালে উত্থান ঘটে উমাইয়া বংশের। উমাইয়া শাসনামলে জগৎখ্যাত কিছু বিজয় অর্জিত হয়। তাদের হাত ধরে মুসলিম শাসনের ভিত্তি আরো মজবুত হয়। বিস্তৃতি ঘটে মুসলিম সাম্রাজ্যের। তাদের একের পর এক সামরিক অভিযানে আসতে থাকে যুগান্তকারী বিজয়। স্পেন বিজয়ও ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনা, যা ইউরোপের বুকে ইসালমের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে। চতুর্থ শতাব্দীর শেষ দিকে হিস্প্যানিয়া অঞ্চলে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) রোমান শাসনের পতন ঘটে। তখন তাদের জায়গা দখল করে নেয় পিরেনিজ পার হয়ে আইবেরীয় উপদ্বীপে আসা বিভিন্ন ভিজিগথিক গোত্র। সেসময় টলেডোতে স্থাপন করা হয় নতুন রাজধানী। খুব দ্রুত রোমান সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এরা। এরা কথা বলত ল্যাটিন ভাষায়। এ ভিজিগথরা পালন করত আরিয়ান ধর্ম। সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে ভিজিগথিক হিস্প্যানিয়ায় চলছিল অরাজকতার স্টিমরোলার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। দুর্নীতি আর চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছিল সীমাহীন। জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযানের উদ্দেশ্যে স্পেনের দিকে পা বাড়াল মুসলিমরা। লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ইসলামের সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকায়, ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে পুরো উত্তর আফ্রিকার উপকূলজুড়ে উপস্থিত মুসলিম সৈন্য।
স্পেনে তারিক বিন জিয়াদের অভিযান
৬৯৮ সালে মুসা বিন নুসায়ের ইফরিকিয়ার (লিবিয়া ও আলজেরিয়ার অংশবিশেষ) গভর্নর নিযুক্ত হয়ে সমগ্র উত্তর আফ্রিকার উপকূলে মুসলিমদের শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালান। এ ধারাবাহিকতায় তিনি তাঞ্জিয়ার্সেও ঢুকে পড়েন। বাইজানটাইন নৌবহরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য গড়ে তুলেন শক্তিশালী নৌবহর। মুসা বিন নুসায়ের আফ্রিকা জয় করেই সন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু স্পেন থেকে আসা এক অভিজাত খ্রিষ্টান হিস্প্যানিয়া জয় করার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করে। উদ্বুদ্ধকারী ব্যক্তিটি ছিলেন সেউটার কাউন্ট হুলিয়ান, ভিজিগথ রাজা প্রথম রডারিকের একজন সামন্ত রাজা। হুলিয়ান মুসা বিন নুসায়েরকে হিস্প্যানিয়ায় থাকা সম্পদের পাহাড়ের বিবরণ দেন। তাকে জানান রডারিকের কারণে তাদের রাজ্যে চলা অরাজকতার কথা। মূলত হুলিয়ান চেয়েছিলেন ভিজিগথদের পতন দেখতে, কারণ সম্রাট রডারিক হুলিয়ানের মেয়ে ফ্লোরিন্ডাকে ধর্ষণ করেছিলেন। তাই হুলিয়ান চেয়েছিলেন মুসলমানদের মাধ্যমে তার মেয়ের এ শ্লীলতাহানীর সমোচিত জবাব দিতে। মুসা বিন নুসায়ের হিস্প্যানিয়া জয় করতে তাঞ্জিয়ার্সের তৎকালীন গভর্নর তারিক বিন জিয়াদকে পাঠালেন। তারিক বিন জিয়াদ মাত্র ৭,০০০ সৈন্য নিয়ে রওয়ানা করেন হিস্প্যানিয়ার উদ্দেশে। তারিক ছিলেন মুসা বিন নুসায়েরের গোলাম। পরবর্তীতে মুসা তাকে মুক্ত করে দেন। আর তাকে বানান বাহিনীর সেনাপতি।
এপ্রিল ২৬, ৭১১। তারিক বিন জিয়াদ তার বাহিনী নিয়ে জিব্রাল্টারে পৌঁছেন। জিব্রাল্টারের নামকরণ করা হয়েছে তারিক এর নামানুসারেই। ‘জাবাল-আত-তারিক’ অর্থাৎ তারিকের পাহাড় থেকেই উৎপত্তি জিব্রাল্টারের নাম। এই ছোট্ট সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হতে রডারিক জড়ো করেছিলেন প্রায় এক লাখ সৈন্য। সাগর পাড়ি দিয়ে নিজ সৈন্যদের তারিক আদেশ দিলেন পেছনে থাকা নিজেদের জাহাজ পোড়ে ফেলতে। তখন তারিক বিন জিয়াদ সৈন্যদের উদ্দেশে তার ইতিহাসবিখ্যাত ভাষণ দিলেন।
‘হে আমার সৈন্যরা, কোথায় পালাবে তোমরা? তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রু। তোমাদের সামনে রয়েছে অগণিত শত্রু, আর জীবন বাঁচানোর জন্য তোমাদের কাছে রয়েছে শুধু তলোয়ার।... এবং মনে রেখো এই অসাধারণ যুদ্ধে আমিই সবার সামনে থাকব, যা তোমরা করতে যাচ্ছ...’ তারিকের ভাষণ শুনে উজ্জীবিত সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল রডারিকের বিশাল বাহিনীর ওপর। রডারিকের বাহিনী তখন দ্বিধাবিভক্ত, নিজেদের সুরক্ষিত শহর ছেড়ে এই প্রান্তরে যুদ্ধ করতে এসে যারপরনাই বিরক্ত সামন্ত রাজারা। তাছাড়া এই বিশাল বাহিনী রডারিকের অনুগতও নয়। এই সুযোগটাই কাজে লাগালো মুসলিমরা। তারিকের ৭ হাজার সৈন্যের সঙ্গে মুসা বিন নুসায়েরের পাঠানো আরো ৫ হাজার সৈন্য এসে যোগ হলো। মোট ১২ হাজার সৈন্যের অসাধারণ রণকৌশলে মুহূর্তের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো প্রায় লাখ সংখ্যার ভিজিগথ বাহিনী। পরিশেষে, গুয়াদেলেতের যুদ্ধে নিহত হলো রডারিক আর হিস্প্যানিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম শাসন।
ইউরোপে প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র
বছরান্তেই উত্তর আফ্রিকার আমাজিঘদের (বারবার) ঢল নেমে আসে আইবেরিয়ায়। জিব্রাল্টার থেকে দক্ষিণ ফ্রান্স পর্যন্ত মুসলিমদের দখলে চলে এলো। মুসলিম শাসন সত্ত্বেও খ্রিষ্টান আর ইহুদিরা স্বাধীনভাবেই নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারত, তাদের ওপর জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। আর এ কারণেই কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যাপক পরিমাণ খ্রিষ্টান ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিল।
দশম শতাব্দীর মধ্যেই আল-আন্দালুস পরিণত হলো ইউরোপ, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্র হিসেবে। পণ্ডিত ব্যক্তিগণ চর্চা করতে থাকল বিজ্ঞান-দর্শনশাস্ত্রের, থেমে যাওয়া প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান আবারো আলোর মুখ দেখল মুসলমানদের হাত ধরে। অন্যদিকে খ্রিষ্টধর্ম প্রধান ইউরোপ, তখন নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতার রেষারেষিতে ব্যস্ত, রেনেসাঁ শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী ‘ডার্ক এজ’ চলছে তখন ইউরোপে। তাছাড়া ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর আর আফ্রিকান আটলান্টিক দিয়ে ঘিরে থাকা আল-আন্দালুস হয়ে দাঁড়ালো ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র।
৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে, উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে শুরু হয় আব্বাসীয় যুগ। গণহত্যার সময় উমাইয়া পরিবারের বেঁচে যাওয়া রাজপুত্র আবদ আল-রহমান পালিয়ে আন্দালুসে চলে আসেন। সেখানেই শুরু হয় তার নতুন রাজ্য-শাসন, আল-আন্দালুসকে ঘোষণা করেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। ৭৫৬ সালে নিজেকে আল-আন্দালুসের আমির হিসেবে ঘোষণা করেন আবদ আল-রহমান, ইউরোপের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র।
সভ্যতার আন্দালুস
আন্দালুস ছিল মুসলিম সভ্যতার নান্দনিক দেশ। সভ্যতার নগর। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র্। আন্দালুস আগের আরব রাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলোকে সবদিক থেকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। রোমানদের কাছ থেকে ধার নেওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং আর শহরের পরিকল্পনার সঙ্গে ইসলামি স্থাপত্যকলা মিশিয়ে নতুন করে গড়া হলো আন্দালুসের শহরগুলো। ভ্যালেন্সিয়া আর সেভিল ছিল বিলাসবহুল শহর। জাতিভা শহরে চালু করা হয়েছিল কাগজের কারখানা, দুষ্প্রাপ্য আর দামি পার্চমেন্টকে বিদায় করে শুরু করা হয়েছিল, বই তৈরি করার বিপ্লব। কালের গর্ভে নষ্ট হয়ে যাওয়া মিশরীয় আর গ্রিক ডকুমেন্টগুলো বইয়ের আকার পেতে শুরু করল। শহরে শহরে তৈরি করা হলো হাম্মামখানা, আর তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। নারীরা, বিশেষ করে অভিজাতরা মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টানদের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত তখন।
ইসলামের সুশাসন
ইসলামের সুশাসনে সব ধর্মের মানুষ নিরাপদ। সবাই নিয়ম মেনে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে। এর উত্তম নজির স্থাপন করেছিল আন্দালুস তথা মুসলিম স্পেন। কেননা, ইসলামে জিম্মি ব্যবস্থার কারণে অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও সমানভাবে নিজেদের ধর্ম পালন করার সুযোগ পেত, নিজস্ব সম্প্রদায়ের নিয়মণ্ডকানুন, উৎসবসহ সবকিছুই নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এ জন্য তাদের অবশ্য নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘জিযিয়া কর’ দিতে হত। যার বিনিময়ে তারা নিরাপত্তার সঙ্গে স্বাধীনভাবে মুসলিম দেশে বসবাস করত।
লেখক : মুহাদ্দিস ও মিডিয়াকর্মী