দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার কৌশল
ইসমাঈল সিদ্দিকী
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জীবন চলার পথে ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব আর সমঝোতা বা মানিয়ে চলাকে স্বামী-স্ত্রী দুইজনই ‘হেরে যাওয়া’ মনে করা দাম্পত্য জীবনে দুঃখ-কষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ। দাম্পত্য জীবনে সুখণ্ডদুঃখের চিহ্নিত কারণগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা, সন্দেহ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা, পর্দা-পুশিদা রক্ষা করা, পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা, যৌতুকবিহীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শারীরিকভাবে অক্ষম হলে বিবাহ থেকে বিরত থাকা, এই সবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মানা হয় না বিধায়, দাম্পত্য জীবনে তিক্ততা তৈরি হয়, সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং পরবর্তীতে তা বিচ্ছেদে রূপ নেয়। মনে রাখতে হবে, দাম্পত্য জীবনে সামান্য মতের অমিল হতেই পারে। রাগ-অভিমান, মনোমালিন্য থাকতেই পারে। সমস্যা যেমন আছে, তেমন উত্তরণেরও অনেক উপায়ও আছে। এজন্য সাংসারিক জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হলে সর্বপ্রথম তা উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। সম্ভাব্য সব সমাধানের পথে বিচরণ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলতে হবে। উভয়কেই ছেড়ে দিতে হবে সন্দেহপ্রবণতা। একপক্ষ মানিয়ে চলবে আর অন্যপক্ষ ঔদ্ধত্য মননশীলতার অধিকারী হলে ‘শান্তি’ ও ‘সুখ’ নামক শব্দটি সংসার থেকে বিদায় নেবে।
মনোমালিন্য দেখা দিলে করণীয়
মনোমালিন্য দেখা দিলে যথাসম্ভব নিজেরাই মিটমাট করে নেবে, যদি তা বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা হয়, তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। ইরশাদ হয়েছে ‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত’ (সূরা নিসা : ৩৫)।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, উভয় সালিশ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করে দেয়ার সদুদ্দেশ্য রাখলে আল্লাহতায়ালা তাদের নেক নিয়ত ও সঠিক চেষ্টার বদৌলতে বনিবনা করে দেবেন। দাম্পত্য জীবন সুখী ও মধুময় করে তুলতে এবং একজন দায়িত্বশীল ও সফল স্বামীরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমরা নিম্নোক্ত নসিহাগুলো মেনে চলতে পারি।
স্ত্রীর প্রশংসা করা
রাসুল (সা.) স্ত্রীদের প্রশংসা করতেন। ভালো কাজের জন্য শুকরিয়া জানাতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে থেকে খাদিজা (রা.)-এর চেয়ে অন্য কোনো স্ত্রীর প্রতি বেশি ঈর্ষাপোষণ করিনি। কারণ, রাসুল (সা.) প্রায় তার কথা স্মরণ করতেন এবং তার প্রশংসা করতেন’ (বোখারি: ৫২২৯)।
দোষ গোপন রাখা
মন খারাপি অবসানের জন্য আমরা অন্যের কাছে নিজের প্রিয় মানুষটার সমালোচনা করে বেড়াই। এতে করে সংসারে কলহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয় এবং সুখণ্ডশান্তি চলে যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়’ (সূরা হুমাজাহ : ১)।
গোপনীয়তা ফাঁস না করা
স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস জঘন্যতম পাপ। নিজেদের একান্ত বিষয় অন্যের কাছে প্রকাশ করা গর্হিত অপরাধ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সে হবে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট পর্যায়ের যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়’ (মুসলিম : ৩৪৩৪)।
নিজেকে পরিপাটি রাখা
পুরুষরা তাদের সঙ্গিনীকে সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। ঠিক একইভাবে স্ত্রীরাও তাদের সঙ্গীকে সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। ময়লা কাপড় গায়ে জড়িয়ে, ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে স্বামী-স্ত্রী কেউ অপরের সান্নিধ্যে না যাওয়া। এতে হেলা প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে অবজ্ঞার রূপ নেয়। তখন সংসারে ভাঙন ধরে। তাই পরিপাটি থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীদের জন্য এমনই পরিপাটি থাকা পছন্দ করি, যেমন আমি তাদের ক্ষেত্রে সাজগোজ করে থাকতে পছন্দ করি’ (বায়হাকি : ১৪৭২৮)।
ঘরের কাজে সহযোগিতা করা
কর্মব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও যখনই ঘরে ফেরা হবে, তখন একটু সময় বের করে স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা। বিশেষ করে ছুটির দিনটিতে দুইজনে ঘর গোছানোর কাজ শেয়ার করে নেওয়া যেতে পারে।
আসওয়াদ (রহ.) বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী (সা.) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিজনের সহায়তা করতেন। আর সালাতের সময় সালাতে চলে যেতেন’ (বোখারি : ৬৭৬)।
ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা
স্ত্রীর জন্য সামর্থ্যানুযায়ী ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা।এক্ষেত্রে কৃপণতা পরিহার করে সাওয়াবের আশা রাখা।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাওয়াবের আশায় কোনো মুসলিম যখন তার পরিবার পরিজনের প্রতি ব্যয় করে, তা তার সদকা হিসেবে গণ্য হয়’ (বোখারি : ৫৩৫১)।
প্রহার না করা
স্ত্রীদের মারধর করা চরম অন্যায় আর নিম্ন মানসিকতার পরিচয়। আবদুল্লাহ ইবনে যামআ (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কেউ নিজ স্ত্রীদের গোলামের মতো প্রহার কর না। কেননা, দিনের শেষে তার সঙ্গে তো মিলিত হবে’ (বোখারি : ৫২০৪)।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসা
স্ত্রী যখনই স্বামীর সামনে আসবে, তখনই তাকে মুচকি হাসি দিয়ে সম্ভাষণ জানানো। বেশিরভাগ সাক্ষাতের সময়, আর বিদায়ের সময় নিবিড় আলিঙ্গনে তাকে বেঁধে রাখা কিছুক্ষণ। ভেবে দেখুন, আপনার স্ত্রী যদি সবসময় আপনাকে হাসি-খুশি দেখে তাহলে আপনার জীবন কেমন সুখময় হবে!
স্বামীকে তুচ্ছ জ্ঞান না করা
সুখময় দাম্পত্য জীবনের জন্য স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। স্ত্রীরা অনেক সময় স্বামীকে নাক ছিটকে কথা বলে থাকে। নিজের বা বাপের বাড়ির বড়ত্ব দেখিয়ে স্বামীকে ছোট করার চেষ্টা করে। এসব আচরণ বর্জনীয়। স্ত্রীরা স্বামীদের প্রতি এমন আচরণ করলে সংসার টিকলেও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে না। সম্পর্কে ফাটল ধরে। কখনো কখনো সম্পর্কের এ ফাটল বিচ্ছেদে গড়ায়।
হালাল পথে উপার্জনকে গুরুত্ব দেওয়া
হালাল পথে উপার্জন করতে গিয়ে অনেক সময় পরিবারের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করা যায় না। স্বামী তো বউ বাচ্চাকে একটু সুখে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন; কিন্তু স্ত্রীর তো তাতে মন ভরছে না। বিষয়টি এমন না হয়ে বরং হালাল রুজির প্রতি পরিবারের সবাই সন্তুষ্ট ও আত্মতুষ্ট থাকা। স্বামীকে হালাল রুজির প্রতি স্ত্রীগণ উৎসাহ দেওয়া। তখন মানসিক ও আত্মিক সম্মান ও শক্তি অর্জিত হবে। যা দাম্পত্য জীবনকে আরো সুখময় ও সুদৃঢ় বন্ধনে পরিণত করবে।
স্বামীর মন মেজাজ বোঝা
স্বামীর কাছে সদা আদরণীয় ও কমণীয় হয়ে থাকার জন্য স্ত্রী-স্বামীর মন মেজাজ বুঝে চলা জরুরি। স্বামীর বৈধ আবদার, আবেগ, অনুরাগ, ভালোবাসাকে মূল্যায়ণ করা। স্বামী রেগে থাকা অবস্থায় বিরক্তিকর কথা বা আচরণের মাধ্যমে তাকে আরো রাগিয়ে না তোলা, বরং পরিবেশ ও সুযোগ বুঝে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করা। রাগের অবস্থায় ঘটে যাওয়া ভুলগুলো স্বাভাবিক সময়ে শুধরে নেওয়া। স্বামীর আনুগত্যকে গুরুত্ব দেওয়া। স্বামীর চোখের ও ইশারার ভাষা বোঝার চেষ্টা করা। মন-মেজাজ বুঝে মাঝেমধ্যে খোশগল্প করা। ঠাট্টা মশকারাকে ঠাট্টা মশকারার স্থানেই রাখা। অমøমধুর খুনশুটিকে ঝগড়ায় রূপ না দেওয়া। হাসি মজাকের এ ধারা পরিমিতি বোধের মধ্যে চলমান রাখার চেষ্টা করা। তখন দাম্পত্য জীবন কান্নায় না হাসিতে ভরে ওঠবে।
শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান করা
স্ত্রীরা যখন স্বামীর মা-বাবা তথা নিজ শ্বশুর-শাশুড়িকে যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন করে তখন তার দেওয়া এ সম্মান ‘স্নেহ মমতা’ হয়ে ফিরে আসে। স্ত্রীরা শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান না করা, তাদের প্রতি যত্নশীল না হওয়া আজকাল দাম্পত্য জীবনে কলহ ও অশান্তির একটি মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়। স্বামীর বাবা-মায়ের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে স্ত্রী নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতা লালন করা যাবে না। বরং অধিকারে সমতা বজায় রাখতে হবে। মোটকথা, আচরণ ও সামাজিকতায় উদারপন্থি হয়ে পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করার সদিচ্ছা লালন ও সুখে-দুঃখে মিলেমিশে থাকার সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হলে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে সুখের শীতল সমীরণ বয়ে যায় নিরন্তর।