জমজম কূপ আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন
শরিফ আহমাদ
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ঐতিহাসিক একটি কূপের নাম জমজম। এটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পানির কূপ। ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সময়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কোটি কোটি মানুষ এই পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করেছে। এখনো হজ ও উমরা আদায়কারী লাখ লাখ হাজী এই কূপের পানি পান করে যাচ্ছে। পবিত্র কাবা থেকে ৬৬ ফুট আগে অবস্থিত এই জমজম কূপ আল্লাহর কুদরতের শ্রেষ্ঠ একটি নিদর্শন। কাবাঘরের ইতিহাস ও জমজম কূপের সৃষ্টি একটি অন্যটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিচে জমজম কূপের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
বাইতুল্লাহ ও জমজম প্রতিষ্ঠা
পবিত্র কাবাঘরের ইতিহাস অতি প্রাচীন। আরবের মরুভূমিতে পূর্বের কাবার চিহ্নিত স্থানে হজরত ইবরাহিম (আ.) তার স্ত্রী হজরত হাজেরা (আ.) ও পুত্র ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর হুকুমে রেখে যান এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেন, হে আমাদের রব! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করলাম অনুর্বর উপত্যকায় আপনার পবিত্র গৃহের কাছে। (সুরা ইবরাহিম : ৩৭)। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার বরকতে হজরত হাজেরা (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর মাধ্যমে জমজম কূপের সৃষ্টি হয়। এর আরো অনেক পরে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) পুনরায় কাবা প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এসেছে, নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম গৃহ, যা মানবমণ্ডলীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা ওই ঘর যা বাক্কায় (মাক্কায়) অবিস্থত। ওটি সৌভাগ্যযুক্ত এবং সব বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক। ওর মধ্যে প্রকাশ্য নিদর্শনগুলো বিদ্যমান রয়েছে। মাকামে ইবরাহিম উক্ত নিদর্শনগুলোর অন্যতম। আর যে ওর মধ্যে প্রবেশ করে সে নিরাপত্তা প্রাপ্ত হয়। (সুরা আল ইমরান : ৯৬-৯৭)।
জমজম কূপের ইতিহাস
ইমাম বোখারি (রহ.) তার সহিহ গ্রন্থের আম্বিয়া অধ্যায়ে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বিস্তারিতভাবে জমজম কূপের ইতিহাস উল্লেখ করেছেন। তাফসির ইবনে কাসিরেও হাদিসটি আনা হয়েছে। তার সারাংশ হলো, হজরত ইবরাহিম (আ.) তার স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর হুকুমে মক্কায় রেখে যান। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পানি এবং খেজুর শেষ হয়ে যায়। তৃষ্ণায় মা ছেলে কাতর হয়ে পড়ে। একফোঁটা পানির আশায় হজরত হাজেরা (আ.) সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন যে, রাসুল (সা.) বলেছেন : এ জন্যই হজ কিংবা উমরাহ করার সময় লোকদের সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌড়াতে হয়। হজরত হাজেরা (আ.) ছোটাছুটির ভেতরে আওয়াজ শুনতে পান। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেন আপনার কাছে কি কোনো খাদ্য আছে? অতঃপর তিনি দেখতে পেলেন, যে স্থানটিতে বর্তমান জমজম কূপ অবস্থিত, সেখানে ফেরেশতারা তার পায়ের গোঁড়ালি দ্বারা (অথবা পাখা দ্বারা) মাটি খুঁড়ছেন এবং ওই স্থান থেকে ফোয়ারা হয়ে পানি বের হয়ে আসছে। ইসমাঈল (আ.)-এর মা অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং তিনিও মাটি খুঁড়ে তার দুই হাত দিয়ে পানি রাখার পাত্রে পানি ভর্তি করতে শুরু করেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন : ইসমাঈল (আ.) এর মায়ের প্রতি আল্লাহ রহম করুন! তিনি যদি পানিপ্রবাহ বন্ধ করার জন্য কূপের চারিদিকে বাঁধ না দিতেন, তাহলে জমজমের পানিপ্রবাহে সব পৃথিবী সয়লাব হয়ে যেত। তখন ফেরেশতা হাজেরা (আ.) কে লক্ষ্য করে বললেন, আপনি ভয় পাবেন না, এই বালক এবং তাঁর পিতা উভয়ে মিলে এখানে আল্লাহর ঘর তৈরি করবেন। আল্লাহর নাম স্মরণকারীকে আল্লাহ কখনো পরিত্যাগ করেন না। তাদের মাধ্যমে জমজম কূপের সৃষ্টি হলো। জারহাম গোত্রসহ আরো অনেকে বসবাস শুরু করল এ অঞ্চলে। এভাবেই গোড়াপত্তন হয় মক্কা নগরীর।
জমজমের পানির বৈশিষ্ট্য
জমজমের পানির বৈশিষ্ট্য, ফজিলত ও পান করার নিয়ম সংক্রান্ত অনেক হাদিস রয়েছে। জমজম কূপের পানি সুস্বাদু, বরকত ও খাবারের উপাদান সমৃদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই এই পানিকে জমিনের সর্বোত্তম পানি বলেছেন। এই কূপের পানি পৃথিবীর পবিত্র ও উৎকৃষ্টতম হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হলো রাসুল (সা.)-এর বক্ষ বিদীর্ণ করে জিবরাঈল (আ.) জমজমের পানি দিয়ে তা ধৌত করেছিলেন। (বোখারি : ৩৩৪২)। জমজমের পানিতে রোগের শেফা আছে। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, জমজমের পানি সেজন্যই হবে, যার জন্য তা পান করা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ : ৩০৬২, দারা কুতনী : ২৩৮, বায়হাকি কুবরা : ৯৪৪২, শুয়াবুল ঈমান : ৪১২৭, মুসনাদে আহমাদ : ১৪৮৪৯)।
জমজমের পানি পানের আদব
জমজম কূপের পানি দাঁড়িয়ে পান করাই হলো আদব। রাসুলুল্লাহ (সা.) জমজমের পবিত্র পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন।? (মুসলিম : ২০২৬)। তাই অধিকাংশ আলেম জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করাকে উত্তম মনে করেন। একদল ফুকাহায়ে কেরাম জমজমের পানি কেবলার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব বলেছেন। তবে আর একদল ফুকাহায়ে কেরাম দাঁড়িয়ে পান করাকে মুস্তাহাব বলেন না, বরং জায়েজ বলে থাকেন। (ফাতওয়ায়ে শামি-১/২৫৪-২৫৫)। জমজমের পানি পান করার সময় এই দোয়াটি পাঠ করতে হয়। আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়া, ওয়া রিজকান ওয়াসিআ, ওয়া শিফা আন মিন কুল্লি দায়িন। (দারা কুতনি : ৪৬৬)।