সাক্ষাৎকালীন মুসলিম সভ্যতা

ইসমাঈল সিদ্দিকী

প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন ছাড়া একাকী বসবাস করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সমাজে থাকতে হলে নানা প্রয়োজনে একে অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে হয়। পরস্পর দেখা সাক্ষাতে বহুবিধ ফায়দা আছে। কারণ দেখা-সাক্ষাৎ আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব ও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক ও বন্ধনকে দৃঢ় করে। অটুট রাখে। মনোমালিন্য দূর করে বিবাদের পথ বন্ধ করে বিদ্যমান নানা সমস্যার সমাধান করে। একটা সুন্দর-সুশৃঙ্খল আর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠনে দেখা-সাক্ষাৎ অনন্য ভূমিকা পালন করে। এজন্য ইসলাম দেখা সাক্ষাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের জন্য আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা অবধারিত রয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২০৩০)।

দেখা সাক্ষাতের ক্ষেত্রে ইসলামের কিছু নিয়ম রয়েছে, যা মেনে চললে পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর ও সুদৃঢ় হয়। সাক্ষাৎকালীন একজন মুসলিমের বৈশিষ্ট্য ও নবী (সা.)-এর সুন্নাহ হিসেবে বিবেচিত এমন ১০টি নিয়ম নিচে উল্লেখ করা হলো।

১. হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা : হাসি সৌন্দর্যের প্রতীক। হাস্যোজ্জ্বল মানুষকে সবাই ভালোবাসে, কাছে টানে। সাক্ষাৎপ্রার্থী ও সাক্ষাৎদাতা উভয়ের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সাক্ষাৎকে মধুময় করে তোলে। সাক্ষাৎকালে মুচকি হেসে সাক্ষাৎপ্রার্থীকে বরণ করে নিতে নবী কারিম (সা.) উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কোনো ভালো কাজকে ছোটো মনে করবে না, যদিও তা অন্যের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাতের ব্যাপারেই হোক না কেন।’ (মুসলিম : হাদিস : ২৬২৬)।

২. সালাম বিনিময় করা : সালাম চরম শত্রুকেও পরম বন্ধুতে পরিণত করে। পরস্পর ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা সৃষ্টি করে। তাই সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে ইসলাম উৎসাহ প্রদান করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা ইমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর ইমানদার হতে পারবে না পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি না হলে। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয়ের কথা বলব, যা করলে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাও।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৪)। অন্য হাদিসে এসেছে, (সাক্ষাতে) কথা বলার আগে সালাম দেওয়া। আরেক হাদিসে এসেছে, নিশ্চয় আল্লাহর কাছে উত্তম সে ব্যক্তি, যে আগে সালাম দেয়। (আবু দাউদ : ৫১৯৭)।

৩. মুসাফাহা করা : মুসাফাহা সালামের পরিপূর্ণতা। তাই পরস্পর সালাম বিনিময়ের পর সময়-সুযোগ হলে দু’হাত মিলিয়ে মুসাফাহা করে নেবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সালামের পরিপূর্ণতা হলো মুসাফাহা। (তিরমিজি : ২৭৩০)।

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘দুজন মুসলমান পরস্পর সাক্ষাতের পর মুসাফাহা করলে তাদের পৃথক হওয়ার আগেই তাদের পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (আবু দাউদ : ৫২১৪)।

৪. মোয়ানাকা বা কোলাকুলি করা : সফর থেকে ফেরার পর দীর্ঘদিন বাদে পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ হলে সাহাবায়ে-কেরাম মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করতেন এবং খোঁজখবর জিজ্ঞেস করতেন। হজরত শাবিহ (রহ.) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরে সাক্ষাতে মুসাফাহা করতেন আর দূরের সফর থেকে ফিরে এলে কোলাকুলি করতেন।’ (মুসন্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ২৬২৩৪)।

৫. কপালে চুমু খাওয়া : কোলাকুলি পরবর্তী সময়ে চুমু খাওয়ার কথাও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, যায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) যখন মদিনায় এলেন তখন নবী (সা.) আমার ঘরে ছিলেন। যায়েদ (রা.) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমার ঘরে এলেন এবং দরজায় টোকা দিলেন। রাসুল (সা.) নিজের কাপড় সামলাতে সামলাতে উঠে গেলেন এবং যায়েদের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এবং স্নেহ করলেন।’ (তিরমিজি : ২৭৩২)।

মনে রাখতে হবে, কপালে বা গালে চুমু খাওয়া সেক্ষেত্রে জায়েয, যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজ মনের কামনা-বাসনার আশঙ্কা হতে পবিত্র হবেন এবং যাকে চুমু দেবেন তার পক্ষেও তেমন আশঙ্কা না থাকবে। আর যদি তেমন আশঙ্কা নিজের বেলায় থাকে কিংবা তার বেলায় থাকে, তা হলে মোটেও চুমু খাওয়া জায়েয নেই। (রদ্দুল মুহতার : ৯/৫৪৬, মাবসূত : ১০/ ১৪৯)।

৬. সাক্ষাতের জন্য সময় নেওয়া : উপযুক্ত সময়ে ফোন করে বা অন্য কোনো মাধ্যমে সাক্ষাতের জন্য আগে থেকে সময় নিয়ে রাখা। হঠাৎ করে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হওয়া কখনও উচিত নয়। বিশেষত ব্যস্ত লোকদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে খেয়াল রাখা অনেক বেশি জরুরি। সাক্ষাতের জন্য পূর্ব অনুমতির একটা বড় ফায়দা হলো, এতে দ্বিতীয় পক্ষ মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে এবং স্বতস্ফূর্ত ও মনোযোগ সহকারে কাজটি সম্পন্ন হয়। সাক্ষাৎপ্রার্থিত ব্যক্তির অনুমতি নিয়ে সাক্ষাতে যাওয়া আদব। মুসলিম সভ্যতা।

৭. দীর্ঘ সময় অবস্থান না করা : কারও সাক্ষাতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান না করা। প্রয়োজন সেরে দ্রুত চলে আসা। দীর্ঘ সময় অবস্থানের কারণে সাক্ষাৎদাতার কাজের ব্যাঘাত হতে পারে। সংকোচের কারণে হয় তো তিনি কিছু নাও বলতে পারেন। তবে যদি তিনি আপনার দীর্ঘ উপস্থিতি কামনা করেন এবং আপনার উপস্থিতি তার জন্য প্রশান্তিদায়ক হয়, তাহলে যথাসম্ভব দীর্ঘ সময় অবস্থান করা যেতে পারে।

৮. মাথানিচু বা কুর্নিশ না করা : অনেককে দেখা যায়, আগত ব্যক্তিকে মাথানিচু করে সম্মানপ্রদর্শন করতে, এটা ঠিক নয়। মস্তক অবনত করে সম্মানপ্রদর্শন করতে হাদিসে নিষেধ আছে। এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের কেউ যখন তার ভাই বা বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন কি মস্তক অবনত করবে? নবী কারিম (সা.) বললেন, ‘না,।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৭০২)। মাথা ঝুকিয়ে সালাম করা সিজদাসদৃশ বিবেচিত। সিজদার হকদার একমাত্র আল্লাহ। তাই কুর্নিশে পাপ হয় এবং তা বর্জনীয়। হাত না তুলে শুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিতে হয়। তবে বধির ও দূরের কাউকে হাত দিয়ে ইশারা করে মুখে সালামের বাক্য পড়ে সালাম দেওয়া বিধিসম্মত।

৯. দৃষ্টি হেফাজত রাখা : একান্ত কোনো প্রয়োজনে বেগানা কোনো নারীর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন হলে দৃষ্টি অবনত করে দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’ (সুরা আন-নুর : ৩০)।

১০. আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা : কেউ সাক্ষাতে এলে মেজবান নিজের সামর্থ্যানুযায়ী আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবে। মেহমানের যথাযথ আপ্যায়ন ও কদর করা একজন মুসলমানের ইমানি দায়িত্বও বটে। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানের সমাদর করে।’ (বোখারি : ৬১৩৬)। তবে আপ্যায়নে আড়ম্বরতা ও বাড়াবাড়ি বর্জনীয়। এসব আয়োজনে বাড়াবাড়ি নানা মসিবত ডেকে আনে। ভালোবাসা ও হৃদ্যতা সৃষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। আত্মীয় আত্মীয়ের বাড়িতে আসা যাওয়া কমে যায়। এজন্য যথাসম্ভব এসব অর্থহীন আড়ম্বরতা পরিহার করে চলা উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর গবেষণা বিভাগ, শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।