আলোকিত বাংলাদেশ : অনেকে মনে করেন- মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে মসজিদ মাদ্রাসার গণ্ডির বাইরে কাজ করা উচিত নয়- বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ : বিষয়টি এমন নয়। মাদ্রাসাতে পড়ার অর্থ এই নয় যে, তিনি পার্থিব জগতের কোন কিছুর সাথে জড়াতে পারবেন না। মাদ্রাসাতে পড়ার উদ্দেশ্য আমি মনে করি দ্বীন বুঝা, দ্বীন মেনে চলার যোগ্যতা অর্জন করা। পরবর্তীতে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শরিয়ত পরিপালন করা। অতএব, মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেও এর বাইরে পেশাগত কর্মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ আছে। প্রশাসনিক হোক বা ব্যবসায়িক, তথ্য-প্রযুক্তি হোক বা অন্য কোনো পেশা সব ক্ষেত্রেই জড়িত হওয়ার সুযোগ আছে। মাদ্রাসাতে অধ্যয়ন মানেই পড়াশোনা শেষে শুধু মাদ্রাসা-মাসজিদ সেক্টরেই সীমাবদ্ধ থাকবে বিষয়টি এমন নয়। একজন আলেম ডাক্তার, একজন আলেম প্রকৌশলী, একজন আলেম ব্যবসায়ী এভাবে সম্ভাব্য সব সেক্টরে আলেমগণের পদচারণা সমাজের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলেই দৃঢ় বিশ্বাস করি।
তবে সবাই যদি এ সুযোগ গ্রহণ করে তাহলে মসজিদণ্ডমাদ্রাসায় দায়িত্ব পালন করবে কে? এর ভিত্তিতেই আসলাফের মাসলাক সামনে রেখে যদি মাদ্রাসা-মসজিদকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তবে সেটাই হবে উত্তম। এর মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং ভালো মানুষ তৈরি এবং আত্মার পরিশুদ্ধি ইত্যাদির চমৎকার সুযোগ থাকবে।
এক আলেম পরিবারের কথা জানি। পরিবারের ইচ্ছা সন্তান ডাক্তার হয়ে সততার সঙ্গে পরিবারের পাশাপাশি সমাজকে চিকিৎসাসেবা দিক। মুরব্বির সিন্ধান্ত, শারীরিক রোগের চিকিৎসক আছে প্রচুর। কিন্তু রুহানি জগতের ডাক্তারের প্রচণ্ড অভাব। তাই সন্তান মাদ্রাসাতেই পড়ালেখা করবে এবং তাযকিয়াতুন নাফসের সবক নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তীতে মসজিদণ্ডমাদ্রাসাতেই লেগে থেকে আল্লাহর বান্দাদের আত্মার চিকিৎসায় নিয়োজিত হবে এবং আল্লাহওয়ালা গড়ার পেশা ইখতিয়ার করবে।
আলোকিত বাংলাদেশ : কওমি পড়ুয়া তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান কেমন হওয়া উচিৎ?
ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ : প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কিছু বর্ণনা এসে গেছে। আমার পরামর্শ, কাওমি পড়ুয়া তরুণ প্রজন্মকে পড়ালেখা শেষে তারা কী করতে চায় সেটা নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেয়া উচিত। বিশেষ করে যারা বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখায় নিজেকে দুর্বল মনে করে, তাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি কার্যকর। অন্যথায় তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে হতাশায় ডুবে যায়। তারা নিজেদের জন্য পরবর্তী কর্মসংস্থানের ফিকির করবে। কেউ হস্ত শিল্পে দক্ষতা অর্জন করবে। কেউ ভিন্ন কোনো পেশা অবলম্বন করবে। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ যার যে দিকে ঝোঁক রয়েছে, সে সেদিকে এগিয়ে যাবে। সেটা যে কোনো ক্ষেত্রে হতে পারে। ছোট পেশা হতে পারে, হতে পারে বড় পেশা। যেমন কেউ মক্তবে পড়াবে; আবার কেউ এর পাশাপাশি ছোটখাটে ব্যবসায় সময় লাগাবে। এতে সমাজ তাদের দ্বারা উপকৃত হবে এবং তারাও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
তবে যারা পড়াশোনায় মেধার স্বাক্ষর রাখে এবং অধ্যয়নে অক্লান্ত পরিশ্রমী তাদের জন্য পরামর্শ, তারা অবশ্যই দ্বীনি প্রকল্পে আরো এগিয়ে যাবে। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে আল্লাহওয়ালা মানুষ তৈরির। জীবনের বহুমুখী কার্যক্রমে সাধারণ মানুষকে শরিয়তি বিধিবিধান সম্পর্কে অবহিতকরণের দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। এর জন্য যেমন বিশেষজ্ঞায়নের প্রয়োজন তেমনি সাধারণমুখীও হতে হবে। এ ক্ষেতে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি সাধারণ প্রতিষ্ঠানও আছে। সম্ভব হলে সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনে সচেষ্ট হবে। দারুল ইফতা, দারুল হাদিস ও কিসমুত তাফসিরে দক্ষতা অর্জন করে যেমন মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হতে পারেন, তেমনি এম ফিল ও পিএইচডি. অর্জন করেও বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। এরপর তিনি নিজেই নিজের কর্মসংস্থান নির্ণয়ে সক্ষম হবেন এবং সেভাবেই এগিয়ে যাবেন। ইখলাসের সঙ্গে যদি তিনি এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন এবং তার জন্য ভালো ও সুন্দর ব্যবস্থা করে দেবেন।
আলোকিত বাংলাদেশ : ভিন্ন কর্মসংস্থানের জন্য নিজেকে কীভাবে তৈরি করা উচিত?
ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ : ভিন্ন কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কেউ পড়াশোনার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী মাদ্রাসার ছুটিকালীন বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। অনেকে পড়াশোনা শেষেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। সেভাবে পরবর্তীতে তিনি যার জন্য যেটা প্রযোজ্য, সে পেশা গ্রহণ করতে পারবেন। বর্তমানে এমন বিষয় রয়েছে প্রচুর। আইটি সেকশন তথা কম্পিউটারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়। এ জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তারা আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এর দ্বারা কাওমি পড়ুয়া প্রজন্ম যেমন নিজেরা মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবেন, তেমনি পরিবার ও সমাজ পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ। হ্যাঁ, সতর্ক থাকতে হবে এগুলোতে অংশগ্রহণ করে যেন নিজের মূলচেতনা ও পরিচিতি যেন হারিয়ে না ফেলে। পরিবেশের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা যেন ধ্বংস না হয়। এমন দুঃখজনক ঘটনার কিন্তু বহু নজির আছে।
আলোকিত বাংলাদেশ : প্রশাসনিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে হাইয়াতুল উলয়ার ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ : এ ক্ষেত্রে হাইয়াতুল উলয়া চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তবে বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। যেহেতু হাইয়াতুল উলয়ার অধীনেই মাদ্রাসার দাওরা হাদিসকে প্রচলিত এম এ ডিগ্রির মান দেয়া হয়েছে সেহেতু এর ধারাবাহিকতায় সরকারি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও এ সনদের স্বীকৃতি দেয়া উচিত। আমার জানামতে স্বীকৃতি শুধু ইমামতি এবং আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ এর জন্য দেয়া হয়েছে। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়ত এটা প্রয়োগ করা কঠিন হতে পারে। কিন্তু হাইয়াতুল উলয়ার নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে যদি প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তাহলে আশা করি ভালো ফল আসতে পারে। বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি আদায় করতে পারলেও কওমি সন্তানরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে।
আমরা দেখেছি কওমি সন্তানরা যেভাবেই হোক দেশে বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। এ জন্য অবশ্য তাদের বেশ কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে। তাই যদি তাদের সরাসরি মেধার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে সেটা হবে দেশ ও জাতির জন্য বিশাল প্রাপ্তি। এ সুযোগ প্রাপ্তির তাদের অধিকার রয়েছে। এটা করুণা নয়। প্রতিযোগিতায় তারা টিকলে পাবে, অন্যথায় ছিটকে যাবে। যেমন অন্যরা ছিটকে যাচ্ছে। তবুও মানসিক একটি প্রশান্তি থাকবে, আমরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে হাইয়াতুল উলয়া যদি এমন একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে সেটা হবে যুগান্তরী সফলতা। আর হাইয়াতুল উলয়ার নেতৃবৃন্দের সে যোগ্যতাও আছে বলে আমি মনে করি। বাকি এখন এগিয়ে যাওয়ার মিশন। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন, আমিন।
আলোকিত বাংলাদেশ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।