পৃথিবীর প্রাচীন মসজিদ বাইতুল মুকাদ্দাস। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নবী রাসুলগণের পদার্পণে মুখরিত ছিল। ফিলিস্তিনের মাটিতে এখনো ঘুমিয়ে আছেন অনেক নবী রাসুল ও বীর মুজাহিদ। বীরত্বের খেতাব নিয়ে এখানে শিশুরা জন্মগ্রহণ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানের নাম পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এসেছে অসংখ্যবার। বলা হয়েছে গুরুত্ব, ফজিলত ও ইতিহাস। দলিলসহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
কোরআনে বাইতুল মুকাদ্দাস : বাইতুল মুকাদ্দাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। আশপাশের অঞ্চলে ভরপুর বরকত দিয়েছেন। মহানবী (সা.)-এর মিরাজ রাতের গৌরবোজ্জ্বল সাক্ষী বাইতুল মুকাদ্দাস। এখানে তিনি সব নবীদের ইমাম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
পবিত্র কোরআনে এসেছে, পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা নিয়ে যান। যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর শ্রোতা এবং সবকিছুর জ্ঞাতা। (সুরা বনী ইসরাইল : ১)।
মুসলমানদের প্রথম কেবলা : বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবীরা হিজরতের পর প্রায় ১৬ থেকে ১৭ মাস তার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েছেন। অতঃপর মসজিদুল হারামকে চিরকালের জন্য কেবলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হজরত বারা ইবনে আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বাইতুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে ১৬ মাস পর্যন্ত নামাজ আদায় করেছি। অবশেষে সুরা বাকারার এই আয়াত হয়, তোমরা যেখানেই থাকো তোমাদের চেহারা কাবার দিকে কর। নবীজি নামাজ শেষ করার পর আয়াতটি নাজিল হয়। এরপর একজন সাহাবী চলে গেলেন। এরই মধ্যে একদল আনসারকে নামাজ আদায় করতে দেখলেন। তিনি তাদের এ বিষয়ে অববাহিত করলেন। তারা তাদের চেহারা বাইতুল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নিলেন। (সহিহ মুসলিম : ১০৫৯)।
বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ : বাইতুল মুকাদ্দাস সর্বপ্রথম কত সালে কোনো ব্যক্তির দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এ সম্পর্কে হাদিস, তাফসির ও ইতিহাস গ্রন্থে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। হজরত আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এই দুটির মধ্যে কালের ব্যবধান কতটুকু? তিনি বললেন, ৪০ বছর। তবে যেখানেই নামাজের ওয়াক্ত হবে, সেখানেই নামাজ আদায় করে নেবে। সেটিই মসজিদ। (সহিহ মুসলিম : ১০৪৪) একটি বর্ণনায় এসেছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম মসজিদ হলো বাইতুল্লাহ, যা হজরত ইব্রাহিম (আ.) নির্মাণ করেন এবং দ্বিতীয় মসজিদ হলো মসজিদুল আকসা, যা বাইতুল্লাহ নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব (আ.) নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত দাউদ (আ.) তার সংস্কার করেন এবং হযরত সুলাইমান তার পুনর্নির্মাণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১/১৫২, সিরাত বিশ্বকোষ : ৩/১২৩)।
বাইতুল মুকাদ্দাসের মর্যাদা : পৃথিবীর সব মসজিদের মধ্যে তিনটি মসজিদ সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। এগুলো আল্লাহর নির্দেশে নবী-রাসুলগণ নির্মাণ করেছেন। সেগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
মহান আল্লাহর কুদরতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। বাইতুল মুকাদ্দাস সমানভাবে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি জাতির কাছে মর্যাদাপূর্ণ এবং তাদের জিয়ারতের স্থান। নবীজির মুখে বাইতুল মুকাদ্দাসের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেয়েছে। মুসলিমরাই মনেপ্রাণে বাইতুল মুকাদ্দাসকে ভালোবাসেন। জানমাল উৎসর্গ করে যুগে যুগে তার নজির স্থাপন করে যান। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মসজিদুল হারাম, মসজিদুর রাসুল এবং মসজিদুল আকসা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদে নামাজের উদ্দেশে হাওদা বাঁধা যাবে না অর্থাৎ সফর করবে না। (বোখারি : ১১১৬)।
বাইতুল মুকাদ্দাসের ফজিলত : পৃথিবীর প্রসিদ্ধ তিন মসজিদে নামাজ পড়ার তিন রকম ফজিলত রয়েছে। বাইতুল মুকাদ্দাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত সংক্রান্ত হাদিস হজরত মাইমুনা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে কিছু বলুন! রাসুল (সা.) বললেন, বাইতুল মাকদিস হলো হাশরের ময়দান। পুনরুত্থানের জায়গা। তোমরা তাতে গিয়ে নামাজ আদায় কর।
কেননা, তাতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অন্যান্য মসজিদে ১ হাজার নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। (মুসনাদে আহমদ : ২৬৩৪৩)।
হাদিসে আরো এসেছে, হজরত সুলাইমান (আ.) যখন এই মসজিদ নির্মাণ শেষ করেছিলেন, তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, যে ব্যক্তি শুধু নামাজের উদ্দেশে ওই মসজিদে উপস্থিত হবে, সে ব্যক্তি যেন ওই দিনকার মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। (নাসায়ি : ৬৬৯, ইবনে মাজাহ : ১৪০৮) বাইতুল মুকাদ্দাসের অধিবাসীরা নানা কারণে গৌরবের অধিকারী। হজরত উম্মে সালামা থেকে হাদিস বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদে হারামে হজ কিংবা ওমরা পালনে গমন করবে তার পূর্বাপর সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিংবা তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (আবু দাউদ : ১৪৭৯) জেরুজালেমের অধিবাসীদের প্রতি সংঘাত নয়, সবার ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
লেখক : কবি ও আলেম