সত্য ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম ইসলাম
মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে মনোনীত করলাম। (সুরা মায়েদা : ৩)।
আয়াত থেকে শিক্ষা : আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত কেয়ামত পর্যন্ত সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম একমাত্র ইসলাম। ইসলাম ধর্মের বিধানে নতুনভাবে কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের সুযোগ নেই।
জ্ঞাতব্য বিষয় : বিদায় হজের ঐতিহাসিক দিন জুমাবার আসরের পর আরাফার ময়দানে এই আয়াত নাজিল হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমসহ আরাফায় অবস্থান করছিলেন এবং তিনি একটি উষ্ট্রির উপর সওয়ার ছিলেন। ওহির ভার সইতে না পেরে সে দিন উষ্ট্রিটি মাটিতে বসে পড়েছিল।
বোখারি শরিফের ঈমান অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক ইহুদি (কতিপয় রেওয়াতে উক্ত ইহুদির নাম কা’ব আহবার উল্লেখিত হয়েছে) এই মর্মে হজরত ওমর (রা.)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, হে আমীরুল মোমেনীন! আপনাদের কিতাবে এমন একখানি আয়াত আছে, যা আপনারা পড়ে থাকেন, তা যদি আমাদের ইহুদি জাতির ওপর নাজিল হত, তাহলে আমরা ওই দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম। হজরত উমর (রা.) ইহুদিকে জিজ্ঞেস করলেন কোন আয়াতের কথা তুমি বলছ? উত্তরে তখন ওই ইহুদি এই আয়াতের কথাই বলল। এরপর হজরত উমর (রা.) বললেন : আমরা জানি- এই আয়াত কোন দিন, কোথায় নাজিল হয়েছিল। আরাফার দিন শুক্রবার আরাফায় অবস্থানকালীন হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল।
তাফসির জগতের সম্রাট হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ভাষ্যমতে এই আয়াত পবিত্র কোরআনের শেষ সময়কার আয়াত। এরপর বিধিবিধান সম্পর্কীয় আর কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়নি, শুধু উৎসাহ প্রদান ও ভীতিপ্রদর্শনমূলক কয়েকখানি আয়াত নাজিল হয়েছে। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন।
তাফসির : পবিত্র কোরআনের প্রতিটি আয়াতই কিনারাবিহীন সমুদ্র, তাই আলোচ্য আয়াতে কারিমার তিনটি বাক্যের প্রতিটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু শেষ বাক্যটির মর্মার্থ সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় সম্মানিত পাঠকম-লীর সামনে উপস্থাপন করছি।
এক. আল্লাহ যেমন মহান, আল্লাহর বাণীও তেমনি মহান, এ কারণে আমরা পবিত্র কোরআনকে মহাগ্রন্থ বলে থাকি। পৃথিবীর অন্য কোনো গ্রন্থের সমকক্ষ হতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেভাবে সব ধরনের ত্রুটি থেকে চিরমুক্ত, ঠিক সেভাবে তার কথা, পছন্দ, নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তবলিও সব ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত। উভয় জায়গায় আমাদের একই রকম বিশ্বাস লালন ও পোষণ করা আবশ্যক। এর ব্যত্যয় হওয়া ঈমানপরিপন্থি এবং তা নিঃসন্দেহে চরম অজ্ঞতার শামিল। স্বাভাবিক কারণে আমাদের হৃদয়গভীরে এই চিরন্তন বাস্তবতাটিকে গ্রথিত করতে হবে, যেহেতু ইসলামকে মহান আল্লাহই আমাদের জন্য জীবনবিধান রূপে পছন্দ করেছেন তাই তার এই পছন্দনীয় ও মনোনীত ধর্মে কোনো ধরনেরর ত্রুটি-বিচ্যুতি, বৈষম্য, বক্রতা, সংশয়-সন্দেহ ও প্রশ্ন থাকতে পারে না। বুঝতে পারা দয়াময় আল্লাহর তাওফীক্ব ও দয়া। বুঝে না এলেও প্রকৃত মোমিন মান্য করতে বাধ্য।
দুই. মহান আল্লাহর অন্যতম একটি মৌলিক পরিচয় হলো তিনি ‘আহকামুল হাকিমীন’ অর্থাৎ তিনি সব বিচারকের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক এবং সব শাসকের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাসক। সুরা ত্বীনের শেষাংশে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন : আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন? সুতরাং যে ব্যক্তির ন্যূনতম জ্ঞান আছে, তার তো সহজেই এটা বুঝা উচিত যে, ইসলাম ধর্মে কোন ত্রুটি বা খুঁত পরিলক্ষিত হওয়াটা আল্লাহর উপরোক্ত পরিচয়ের সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক একটি বিষয়, যা অসম্ভব।
তিন. মহামহিম প্রতিপালকের আরেকটি মৌলিক পরিচয় হলো, তিনি ‘আরহামুর রাহিমীন’ অর্থাৎ তিনিই সর্বাধিক দয়ালু, তার চেয়ে বড় দয়ালু ও দয়াবান আর কেউ হতে পারে না। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাঁর এই পরিচয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। সুতরাং চরম পর্যায়ের নির্বোধ মানুষ ছাড়া দুনিয়ার আর কেউই এমনটা ভাবতে পারে না যে, মানবজতিকে মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত এত সুন্দর ও উত্তমরূপে যিনি সৃজন করলেন, তিনি সবচেয়ে বড় দয়ালু নন বরং তার চেয়েও বেশি দয়ালু অন্য কেউ! এই বিশ্লেষণের ফলাফলও এই যে, যিনি সর্বাধিক দয়াময় তাঁর মনোনীত ধর্ম ইসলামের কোনো একটি বিধান আপত্তিকর বা অমানবিক মনে হওয়াও অসম্ভব।
চার. এমনি ভাবে ‘রব’ যার পরিচয় এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছু সম্পর্কেই যিনি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন, যিনি মহাজ্ঞানী তার দেওয়া জীবন বিধানে কোনো প্রকার ভুলত্রুটি আবিষ্কার করতে পারাও প্রকারান্তরে তার এ সব পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, যা অবান্তরর, অবাস্তব ও অসম্ভব। মোদ্দা কথা হলো : মহান আল্লাহই যেমন আমাদের মহান স্রষ্টা, তেমনি তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ও সর্বাধিক দয়ালু, তিনিই সমগ্র জগতের প্রতিপালক, তিনি মহাজ্ঞানী, তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই জানেন। সুতরাং তার পছন্দনীয় ও মনোনীত ধর্ম ইসলামই হলো- সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবিধান, এর চেয়ে উত্তম সংবিধান পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোনটিই নেই। সুরা আল-ইমরানের ১৯নং আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ধর্ম হচ্ছে একমাত্র ইসলাম। একই সুরার ৮৫ নং আয়াতে তিনি এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।
সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন এই ধর্ম ইসলাম আক্বীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন ও রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সর্বক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ, যা আলোচ্য আয়াতের প্রথম বাক্যে ঘোষিত হয়েছে। অতএব, পূর্ণাঙ্গ এই ধর্ম ছেড়ে অন্য কোনো ভ্রান্ত ধর্ম থেকে আমাদের কর্মনীতি নির্ণয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য অনুধাবন করার তৌফিক দিন- আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল ও শাইখুল হাদিস, জামেয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা।