কোরআন গবেষণায় উইলিয়াম টিসডালের ভ্রান্তিবিলাস : ০২
মুসা আল হাফিজ
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তৃতীয় অধ্যায়ে টিসডাল নিজের সিদ্ধান্ত পেশ করে বলেন, ইসলাম ও কোরআনের দ্বিতীয় উৎস হলো ইহুদি ও সাবিয়ান চিন্তাধারা ও ধর্মীয় আচার। তিনি এ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন- Influence of Sabian and Jewish Ideas and Practices ‘সাবিয়ান-ইহুদি ধারণা ও অনুশীলনের প্রভাব।’ [৬]
টিসডালের দাবি হলো, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.) ঈমান, বেহেশত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, শয়তান, তওবা, জিবরাইল ইত্যাদির ধারণা ইহুদি ধর্ম থেকে ধার করেছেন।’ ‘বিশ্বাস, অনুতাপ, স্বর্গ, নরক, শয়তান, ফেরেশতা, জিবরাইল এসবকিছু ইহুদি উৎস থেকে অর্জিত নমুনামাত্র।’ [৭]
তার ধারণা, ইহুদিরা যেহেতু আরব সমাজে বিদ্যমান ছিল, তাই ইসলামের নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের আকিদা, ধ্যান-ধারণা ও ধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন। ফলত তিনি ইহুদিদের মধ্যে তার নতুন ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা (acceptance) তৈরির জন্য তাদের ধর্ম থেকে অনেক কিছু আল কোরআনে যুক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে এই দাবি অনৈতিহাসিক। মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে কোরআনের বিপুল বিশাল অংশ, সেখানে কোনো ইহুদি ছিল না। তবে মদিনায় ইহুদি ছিল বটে; কিন্তু ইহুদিদের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে তখনই, যখন মহানবী (সা.) মদিনায় গিয়েছিলেন। এতক্ষণে কোরআন নাজিলের ১৩ বছর কেটে গেছে এবং কোরআনের দুই-তৃতীয়াংশের অবতরণ সমাপ্ত হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো- সে সময় তাওরাতের আরবি সংস্করণ ছিল না। আরবি সংস্করণের তাওরাত তখন না ছিল আরবে, না ছিল বিশ্বের অন্য কোথাও। আরবি ভাষায় তাওরাতের সংস্করণ প্রকাশ পায় নবীজির ইন্তেকালের প্রায় আড়াইশ’ বা ২০০ বছর পরে। অর্থাৎ ৮৯৭ বা ৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে আরবিতে অনূদিত তাওরাত প্রথম প্রকাশিত হয়। [৮]
অতএব, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইহুদিদের কাছ থেকে ধর্মীয় চিন্তা ও ধারণা গ্রহণ করেছেন, এমন দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অমূলক। পবিত্র কোরআন, তাওরাত ও ইঞ্জিলের বিষয়বস্তুর মিলের কারণ হলো, (পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুসারে) তিনটি কিতাবই আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য বিভিন্ন সময়ে নাজিল করেছেন। তিন কিতাবের উৎস এক, লক্ষ্য এক, মূল বিষয়বস্তু এক। পূর্ববর্তী কিতাবগুলো বিকৃত হলেও তাতে রয়ে গেছে মূল সত্যের ছিটেফোঁটা। ফলে কোরআনের সঙ্গে তার সাদৃশ্য নানা ক্ষেত্রে থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এই সাদৃশ্যের মূলে আছে কোরআনের এই সত্য। তিন গ্রন্থই নাজিল হয়েছে তিন পয়গাম্বরের কাছে। তাদের শিক্ষা ও দাওয়াহ একই আলোকধারা থেকে উৎসারিত, এটা ইসলামের বিশ্বাস। একজন মুসলিমকে এ বিশ্বাস পোষণ করতে হয়। একই সঙ্গে বিশ্বাস করতে হয়, সেই প্রমাণিত সত্যকে, যা বানান করে বুঝিয়ে দিয়েছে কত বিপুল ও গভীরভাবে পূর্ববর্তী পয়গাম্বরদের কিতাবগুলো বিকৃত হয়েছে, মানুষের স্বেচ্ছাচারের শিকার হয়েছে। ফলে যেসব জায়গায় কোরআনের সঙ্গে এসব গ্রন্থের আপাত সাদৃশ্য দেখা যায়, সেখানেই তলিয়ে দেখলে লক্ষ্য করা যায় কত গভীর ও প্রভাবশালী পার্থক্য রয়ে গেছে উভয় ভাষ্যে। সেই তফাত যেমন বক্তব্যে, মাত্রায়, বৈশিষ্ট্যে, গুণাগুণে, তেমনই ফলাফলে। শুধুই বিষয়ের সমরূপিতা আছে কোথাও কোথাও। যাকে আপাত মিল বলে আখ্যায়িত করা যায়। এই আপাত মিলের জায়গাগুলো বরং প্রকৃষ্ট অনুসন্ধানে আল কোরআনের অহি হওয়ার দলিল। যখন লক্ষ্য করা যায় একই বিষয়ে অন্যগ্রন্থে বিদ্যমান সমস্যাগুলোতে কী অলৌকিক নৈপুণ্যে এড়িয়ে গেছে বা পরিহার করেছে আল কোরআন।
বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে খ্রিষ্টবাদ ও খিষ্ট্রীয় সাহিত্যকে কোরআনের উৎস বলেছেন টিসডাল। এ অধ্যায়ের শিরোনাম হলো- Influence of Christianity and Christian Apocryphal Books অর্থাৎ, খ্রিষ্টধর্ম ও খ্রিষ্টান অ্যাপোক্রিফাল বইয়ের প্রভাব। এখানে তার দাবি- খ্রিষ্টানরা যদিও ইহুদিদের মতো আরবে বসতি স্থাপন করেনি, তবে ইসলামের নবী ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সফর করেছিলেন। বাণিজ্যের সময় তিনি বুহাইরা প্রমুখ খ্রিষ্টান পাদ্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং উকাজ মেলায় নাজরানের বিশপ কুস ইবনে সায়েদার ভাষণ শুনে খ্রিষ্টান ধর্মের আকিদা ও শিক্ষা সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেছেন। পরে তিনি তা তার কোরআনে যুক্ত করেন।
টিসডালের বক্তব্য : ‘আমরা জানি, যৌবনে ইসলামের নবী মুহাম্মদ নাজরানের বিশপ কুসের প্রচার শুনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নবুওয়তের আগে তেজারতের উদ্দেশ্যে সিরিয়া সফর করেন। পথে অনেক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করেন।’ [৯] কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হলো, উসমান ইবনে হুওয়াইরিস এবং ওয়ারকা ইবনে নওফল ছাড়া মক্কা বা মক্কার চতুর্সীমায় কোনো খ্রিষ্টান ছিল না। ওসমানের খ্রিষ্টান হওয়াটা মক্কায় কোনো প্রভাব তৈরি করেনি। মহানবীর (সা.) মনে, চিন্তায় প্রভাব তৈরির তো প্রশ্নই আসে না। কারণ নবুওয়তের ৩ বছর আগে উসমান ইবনে হুওয়াইরিস সিরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। [১০]
আর ওয়ারকা ইবনে নওফলের সঙ্গে মহানবীর (সা.) সাক্ষাৎ হয় প্রথম অহি নাজিলের পরে। হজরত খাদিজার (রা.) মাধ্যমে। কারণ ওয়ারকা ছিলেন খাদিজার চাচাতো ভাই। ওয়ারকা ইবনে নওফল তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এমন কিছু বলেননি, যাতে অন্তত প্রমাণ করা যাবে মহানবী (সা.) কে তিনি কোরআনের কিছু শেখাচ্ছেন। সাক্ষাতের সংলাপই প্রমাণ করে, মুহাম্মদের (সা.) সঙ্গে ওয়ারকার প্রথম সাক্ষাৎ ও প্রথম আলাপন ছিল এটি।
সাক্ষাতে ওয়ারকা ইবনে নওফল মুহাম্মদকে প্রভাবিত করবেন তো দূরের কথা, উল্টো ওয়ারকা নিজেই প্রভাবিত হয়েছিল নবী মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায়। ওয়ারকা তাকে আল্লাহর সত্য নবী বলেই ক্ষান্ত হননি বরং সাহায্য করার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এক বর্ণনায় আছে, ‘ওয়ারকা নবি মুহাম্মদকে বললেন, হে আমার ভাতিজা! তুমি কী দেখেছ, বলো। অতঃপর আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দেখেছেন তার সবকিছু তাকে জানালেন। শুনে ওয়ারকা ইবনে নওফল বলেন, ইনি তো সেই ফেরেশতা, যাকে আল্লাহ হজরত মুসার কাছে প্রেরণ করেছিলেন।’ [১১]
এই হলো- মক্কার ভেতরের খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সম্পর্কের বাস্তবতা। মক্কার বাইরে নবুওয়তের আগে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুটি সফর করেছিলেন। উভয়ই ছিল সিরিয়ার দিকে, বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। একটি বালকবেলায়, যখন তার বয়স ছিল ১২ বছর।
সিরিয়ায় প্রথম সফরকালে খ্রিষ্টান পাদ্রী বুহাইরার সঙ্গে তার কাফেলার সাক্ষাৎ হয়। বুহায়রা দাওয়াত করেন কাফেলাকে নিজের ডেরায়। মহানবী (সা.) প্রথমে যাননি। পরে বিশেষভাবে তিনি মহানবী (সা.) কে চাইলেন।
নবীজি গেলেন, সাক্ষাৎ হলো। অল্প সময়ের সাক্ষাৎ। এবিষয়ক সব বর্ণনা জড়ো করে একটা শব্দও এমন পাওয়া যাবে না, যা থেকে প্রমাণিত হয়; পাদ্রী কোনো কিছু শিখিয়েছেন মহানবী (সা.)কে, বরং সব বর্ণনা দেখাচ্ছে, পাদ্রী মুহাম্মদের (সা.) নবুওয়তের সাক্ষ্য প্রদান করেন। নবুওতের সাক্ষ্য প্রদানের মানে হলো ঈসার (আ.) পরের মহান নবী হিসেবে স্বীকার করা। যার প্রতি শুধু ভক্তি ও শ্রদ্ধাই প্রকাশ করা যায়।
সেটাই তিনি করেছেন। তাহলে খ্রিষ্টান পাদ্রী কীভাবে নবী মুহাম্মদকে প্রভাবিত করলেন? যেখানে পাদ্রী স্বয়ং তার দ্বারা প্রভাবিত! পাদ্রী তার দুই কাঁধের মাঝখানে নবুওয়তের সীলমোহর দেখে নবুওয়তের সাক্ষ্যপ্রদান করেন। [১২]নবীজির দ্বিতীয় বাণিজ্যিক সফর হয় ২৫ বছর বয়েসে, হজরত খাদিজার অনুরোধে।
এ সফরে আরেক খ্রিষ্টান পাদ্রী তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রকাশ করেন। বিস্ময়কর বিষয়াদি তার মধ্যে অবলোকনের কথা বলেন। নবীজির সঙ্গে তার কোনো আলাপই হয়নি। [১৩] সেই সফরে তার (সা.) সঙ্গে ছিলেন মায়সারা নামে খাদিজার এক ক্রীতদাস। এরই মধ্যে একটি গাছের নিচে ক্যাম্প করার সময় জনৈক পাদ্রী গোলাম মায়সারাকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে গোলাম বলে, তিনি কোরাইশি যুবক, হেরেম শরিফের লোক।
শুনে পাদ্রী সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি একজন নবী হবেন। [১৪] এ সফরের ১৫ বছর পরে খাদিজাতুল কুবরার বয়স যখন ৪০ বছর, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন নবুওত লাভ করেন। টিসডাল কিংবা অন্যান্য পশ্চিমা পণ্ডিতের এ জাতীয় প্রচারণা মূলত তাদের কল্পিত সম্ভাব্যতা তত্ত্বের (Theory of Probability) উপর নির্ভরশীল। কোনো প্রমাণ বা তথ্য-উপাত্ত এখানে অনুপস্থিত। কিন্তু সম্ভাব্যতাকে যখন বাতিল করার স্পষ্ট প্রমাণ হাজির আছে, তখনও তাদের এমন প্রচারণা সত্যের প্রতি অবিচার। (চলবে)
লেখক : কবি ও গবেষক