১
গাঁয়ের পথ ধরে হেঁটে আসছিল এক নারী। দেখেই নড়ে উঠল ছেলেটি। একদৌড়ে চলে এলো তার পেছনে। চিৎকার করে ডেকে উঠল ‘মা’ বলে। চমকে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সেই নারী। পেছনে ফিরল ঝটকরে। ১২ কি ১৩ বছরের এক কিশোর। অবাক রকমের সুন্দর। এক্কেবারে রাজপুত্রের মত। দাঁড়িয়ে আছে তার মুখোমুখি। মায়াভরা চোখের দৃষ্টি তার মুখের উপর। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তির তির করে। কী যেন বলতে চায়।
‘কি বাবা! আমাকে তোমার মা ভেবেছিলে!’
‘হু’ বলেই চুপ করে গেল ছেলেটি। মুখখানা মেঘের মতো ভার হয়ে গেল। চোখের কোণ ভিজে উঠল।
‘আরে খোকা, কাঁদছো যে!’
‘আরে না! কাঁদছি নাতো! চোখে কি একটা পড়ল, তাতেই পানি চলে এসেছে।’ দু’হাতে চোখ ডলতে ডলতে পেছনে ফিরল ছেলেটি। হাঁটতে শুরু করল গাঁয়ের পথ ধরে।
ছেলেটি হারিয়ানার রোহতক জেলার আগপাড়ার এক বস্তিতে থাকে। রোজ ভোরেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আগপাড়ার বুকচিরে যে পথ চলে গেছে শহরের দিকে, সেই পথের পাশে এসে দাঁড়ায়। সামনের রাস্তা ধরে নাক বরাবর তাকিয়ে থাকে। মাঝবয়সি কোনো নারী দেখলেই চঞ্চল হয়ে উঠে। কাছে গিয়ে চোহারা দেখার চেষ্টা করে। মুখঢাকা সব নারীকেই তার কাছে মা বলে মনে হয়। তার উপর একবার কারো চোখ পড়লে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে উপায় নেই। রাজপুত্রের মতোই দেখতে সে। অথচ শরীর রোগা-পটকা। গায়ের জামা ময়লা। পাজামার দু’তিন জায়গায় তালি। পায়ে জুতো নেই। চুল উস্কুখু¯ু‹। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত চরম দরিদ্রের চিহ্ন। তবু অদ্ভুত মায়াবী তার চোখমুখ। অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছে সে।
‘দিনেরবেলা। আগপাড়ার পথের পাশে দাঁড়িয়ে সে। হঠাৎ শহরের দিক থেকে হেঁটে এলেন এক নারী। তার সামনে এসে থেমে গেলেন তিনি। পরম আদুরে গলায় ডেকে উঠলেন, মানিক আমার! আয় কোলে! কত বছর পর খুঁজে পেলাম তোকে! আয় আমার সোনামানিক!’
স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছিল একসময়। মায়ের কোলে আর দোল খাওয়া হয়নি তার। স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেছে। সেই থেকে ঘরে মন টেকে না তার। ভোর হলেই ছুটে আসে। আগপাড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। অপরিচিত নারী দেখলেই ছুটে যায়। মাকে খুঁজে ফেরে। এমন করে করে কেটে গেছে দু’বছর। ছেলেটি তার গর্ভধারিণী মায়ের দেখা আজো পায়নি।
২
পারিশা প্রসব বেদনায় কাতর। ছটফট করছে। দাইমা পাওয়া যাচ্ছে না। গুজরাটজুড়ে চলছে মুসলিম নিধন। মুসলমানদের বাড়িঘর লুট করে বেড়াচ্ছে উগ্রহিন্দুরা। ওদের ভয়ে বাড়িঘর সব বিরান। ঘরে ঘরে শুধু পালাই পালাই। এ সময় দাইমা পাওয়া যাবে কোথায়?
পাড়াজুড়ে দাইমা খুঁজে মালিহা ফিরে এলো। মালিহা এ বাড়ির চাকরানী। গত দু’বছর ধরে সে-ই পারিশার একমাত্র সঙ্গী। পারিশার সব কাজকর্ম সে-ই দেখাশোনা করে।
মালিহার পিছু পিছু দুই মুসলিম যুবক বাড়িতে ঢুকল। বলল, ‘হিন্দুদের হাতে মারা গেছেন ফরহাদ খান। লাশও পাওয়া যায়নি। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
বনেদি ব্যবসায়ী ফরহাদ খান পারিশার স্বামী। ভারতের গুজরাট শহরে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের বড় ব্যবসা ছিল তার। মিথ্যা গুজবকে কেন্দ্র করে হঠাৎ ফুঁসে উঠে উগ্রহিন্দুরা। দা, ছুরি আর পিস্তল নিয়ে মুসলিমদের ওপর চড়াও হয়। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে। যুবকদের হত্যা করে। যুবতীদের ধর্ষণ করে। শুরু হয় গণহত্যার মহাউৎসব।
ফরহাদ খানের নেতৃত্বে আইনের সাহায্যে নিতে থানায় গিয়েছিল কয়েকজন মুসলিম যুবক। ফেরার পথে ওদের ওপর আক্রমণ করে হিন্দুরা, দা, ছুরি আর ধারালো তলোয়ার নিয়ে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ফরহাদ খান।
পারিশা তার স্ত্রী হয়ে এসেছে ২ বছর হলো। মেয়েটির বয়স মাত্র ২০। তার শাশুড়ি মারা গিয়েছে ১ বছরও হয়নি। দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের হাতে শ্বশুরটাও মারা গিয়েছেন মাত্র চারদিন আগে। আর আজ মারা গেল তার স্বামী। প্রসব পীড়ায় এমনিতেই আধমরা পারিশা, তার ওপর এ সময় স্বামীর মৃত্যুর খবরে প্রচণ্ড শক খেলো বেচারি। আর এ কারণেই কী না, হঠাৎ প্রসব বেদনা বেড়ে গেল তার। কঁকিয়ে উঠল সে।
মালিহা মাথার কাছে হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। শুধু অসহায় চোখে বেদনাকাতর পারিশাকে দেখছে। ধীরে ধীরে পারিশার প্রসবব্যথা আরো বাড়ল। ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান প্রসব করল সে।
প্রসবের ধকল সামলে উঠার পর শোয়া থেকে উঠে বসল পারিশা। চাকরানী তার কোমরের কাছে কোলবালিশ দিয়ে ঠেশ দিয়ে দিল। সন্তানের দিকে তাকাল পারিশা। ওরে আমার ‘মানিক, আমার সোনামানিক’ বলে উঠল সে। মমতা এসে ভর করল তার মনে। তার মানিককে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখতেই থাকল সে।
হঠাৎ স্বামীর কথা মনে পড়ে গেল তার। সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর বইতে শুরু করল প্রচণ্ড ঝড়, সে হয়ে উঠল অস্থির, তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস, সে বলতে শুরু করল, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আগেই চলে গেছে আমাকে একা করে। আজ আপনি চলে গেলেন। আপনার সন্তান জন্ম নিয়েছে। সে জানে না, তার আগমনের দিন তার বাবা বিদায় নিয়েছে। সে জানে না, যে ঘরের অতিথি হয়ে সে এসেছে, তার জন্মের আগেই সে ঘর বিরান হয়ে গেছে।’
এসব বলতে বলতে সোনামানিককে বুকে জড়িয়ে নিল পারিশা। দুঃখের সব স্মৃতি এসে ভর করল তার মনে। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে। (নির্যাতিত কাশ্মীরিদের নিয়ে রচিত জুলুমের সাতকাহন ‘কন্যার চোখে বন্যা’ (ধারাবাহিক চলবে)।
লেখক : কবি ও গল্পকার