সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবী ১১৩৭ সালে ইরাকের তিকরি নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের গর্বিত এক সেনানায়ক। মুসলমানদের প্রথম কিবলা, অসংখ্য নবী-রাসুল, সাহাবি ও তাবেয়িদের স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়ের উদ্দেশে ১১৮৭ সালের ৪ এপ্রিল সংঘটিত হিত্তিনের যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। এ যুদ্ধে বেশ কিছু ইহুদি সেনা নিহত হওয়ায় ক্রুসেডাররা মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে যায়। দুর্বল হয়ে পড়ে সৈন্যদের
মনোবল। আর আসকালান ও গাজা চলে আসে মুসলমানদের কবজায়। অপরদিকে মুসলমানগণ ছুঁটেছিলেন ইমানিয়্যাতের বলে বলীয়ান হয়ে প্রিয় আকসা বিজয়ের লক্ষ্যে। হিত্তিনের যুদ্ধ আল আকসা বিজয়ের পথকে সুগম করে দেয়।
প্রাথমিক আক্রমণ : কৌশলগতভাবে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.) প্রথমে একদল জানবাজ দুঃসাহসী মুজাহিদকে জামালুদ্দিন শারবিন বিন হাসান রাযির নেতৃত্বে জেরুজালেম শহরের উপকণ্ঠে প্রেরণ করেন। মুসলমান সৈন্যদল যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আগেই ক্রসেডারদের অতর্কিত হামলায় সবাই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। এ হামলায় আমীর জামালুদ্দিনসহ আরো অনেক মুজাহিদ প্রাণ হারায়। সালাহউদ্দীন (রহ.)-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি ভীষণভাবে মর্মাহত হন এবং তিনি সেনাসদস্যদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে শহরে চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইয়ুবী বাহিনী ক্রুসেডারদের দুর্গ রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি প্রবলভাবে মিনজানিকের গোলাবর্ষণ এবং মুষলধারে তির বর্ষণ করতে থাকে। যাতে করে প্রতিরোধকারীরা তাদের অবস্থান থেকে সরে যায়। গোলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে একদল জানবাজ মুজাহিদ সীমানা প্রাচীরের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয় এবং তারা ১২ দিন জেরুজালেম অবরোধ করে রেখে ছিলেন।
চূড়ান্ত লড়াই : ১১৮৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বড় বাঁধা অতিক্রম করে নগরের প্রাচীরের ওপর ইসলামি বাহিনী চড়তে সক্ষম হয়। নগর প্রাচীরে উঠেই মুজাহিদগণ ইসলামি পতাকা উড্ডীন করেন। কালিমার পতাকা উড়তে দেখে নগর রক্ষাকারী বাহিনী এ কথা বিশ্বাস করে নেয় যে, আর মুসলিম বাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। আসলে তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। তবে তারা তাদের একগুঁয়েমি চালিয়েই গেল। লোকজন গীর্জায় জমা হয়ে প্রার্থনা করতে লাগল। পাপের কথা স্বীকার করে, নিজেদের পাথর দিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে এবং তারা আল্লাহর কাছে রহমতের আশা করতে থাকে। মুসলিমদের হাতে বন্দি হওয়া থেকে বাঁচতে প্রার্থনায় মগ্ন হয়। মহিলারা বিভিন্নভাবে পুরুষদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। এমনকি মহিলারা তাদের মেয়েদের মাথার চুল পর্যন্ত কর্তন করে দেয়। কিন্তু ক্রসেডররা এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমান সৈন্যদলের ওপর আক্রমণ করলে তারা নাস্তানাবুদ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় অস্ত্র উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকে এবং ২৬ রজব ৫৮৩ হিজরি ক্রসেডররা সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.) এর কাছে নিজেদের অস্ত্র সমর্পণ করে সবাই আত্মসমর্পণ করে।
বিজয়ী বেশে আল আকসায় প্রবেশ : ২৭ রজব ৫৮৩ হিজরি শুক্রবার মুসলিম উম্মাহর একটি স্মরণীয় দিন। বর্বর ইহুদি ও ক্রসেডরদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল নবী-রাসুলদের পবিত্রভূমি ও আমাদের প্রথম কিবলা আল আকসা; বাইতুল মুকাদ্দাস। এদিন নগরীর প্রাচীরে প্রাচীরে উড্ডীন করা হয় কালিমা খচিত পতাকা। বাইতুল মুকাদ্দাস বিজেতা সালাহউদ্দীন আল আইয়ুবী (রহ.) মসজিদে প্রবেশ করে সর্ব প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন এবং আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন (ইসলামের ইতিহাসে কুদসের যুদ্ধ)।
আইয়ুবীর মহানুভাবতা : খ্রিষ্টানদের এমন দুঃসাহসিকতা এবং লজ্জাজনক অবস্থানের পরেও সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.) তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করেছিলেন। খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক লেন পোল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.)-এর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ‘খ্রিষ্টান পাদ্রীদের মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে মহানুভবতা শেখা উচিত।’ (সালাহউদ্দীন ও ফিলিস্তিন ২১৬পৃঃ)। ইতিহাসে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.) ও অন্যান্য মুসলিম শাসকগণ মহানুভবতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।