এই লেখা যখন লিখছি, পৃথিবী তখন ক্রন্দনরত অবস্থায় সেজদায় অবনত হয়ে অবলোকন করছে এক উন্মত্ত হিংস্র দানবের মানববিধ্বংসী আগ্রাসন। পৃথিবীর এমন এক হতভাগা জনপদের অসহায় মানুষের জন্য আমি লিখছি, ক্ষুধা নিবারণের জন্য যাদের কাছে খাদ্য নেই, বুকভাঙা তৃষ্ণায় পান করার জন্য একফোঁটা বিশুদ্ধ পানি নেই, বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি তারা পান করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। পান করছে গোলাপ ফুলের মতো তাদের পবিত্র শিশুরা, বীরগর্ভীনী নারীরা, বোমার আঘাতে কাতর শুশ্রুষাহীন মৃত্যুপথযাত্রী আহতরা। আমি লিখছি পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারের নিষ্পাপ নিরপরাধ মানুষের জন্য। আমি লিখছি পৃথিবীর একমাত্র স্বাধীন ভূখণ্ড গাজার জন্য।
সমস্ত পৃথিবী যখন অক্ষমতার অজুহাত তুলে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ইহুদিবাদী দানব রাষ্ট্র ইসরাইলের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে, আত্মস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার ভয়ে যারা জালিমের জুলুমকে নীরবতার অন্তরালে কার্যত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তাদের তথাকথিত সভ্য পৃথিবীর সমর্থন ব্যতিরেকে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থায় উদ্দীপ্ত হয়ে সিংহের মতো প্রতিরোধ করছে গাজার সাহসী সন্তানরা। প্রকৃত মুসলমানের এমন নজির পৃথিবীর আর কোথায় কে দেখাতে পারে?
ইহুদিবাদী ইসরাইলের এই পাশবিক আগ্রাসন সব পৃথিবীকে দুটি স্পষ্ট দলে বিভক্ত করে দিয়েছে। একদিকে মানবের অবয়বে জায়নবাদী দানব। তার মানবতা বিধ্বংসী অপরাধের সমর্থনে সর্বশক্তি নিয়ে সঙ্গে আছে বিশ্বব্যাপী মানবতা ফেরি করে বেড়ানো পশ্চিমের পিশাচরা। আর উম্মাহর ঐক্যের আশ্বাস ছড়ানো আরব সন্তানরা এখনো নীরবে বসে আছে তামাশাপ্রবণ দর্শকের ভূমিকায়। অপরদিকে সীমাহীন অসহায়ত্ব সত্ত্বেও আল্লাহর প্রতি অপরিসীম বিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে লড়ে যাচ্ছে অবরুদ্ধ গাজার সাহসী সন্তানরা। তাদের পক্ষে শুধু আল্লাহ এবং স্বয়ং আল্লাহ। তারা নিঃসহায়, কিন্তু সামর্থ্যবানের মতো ভীত নয়। তারা দুর্বল, কিন্তু সবলদের মতো কাপুরুষ নয়। তারা বুলেটের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তারা কামানের গালে পাথরের চপেটাঘাত করে প্রতিবাদ জানাতে পারে। তারা আল কুদসের জন্য হাসতে হাসতে হাজার বার জীবন দিতে পারে। কিন্তু জালিমের জুলুমের কাছে মাথা নত করতে পারে না। তারা সন্তানের শাহাদাতের সংবাদে বেদনার অশ্রু মুছে নিজেই রণাঙ্গনে ছুটে যেতে পারে। মরতে মরতে যারা গায় বিজয়ের গান, তাদের পরাজিত করতে পারে পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি আছে?
তারা বিশ্বের সব মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, জায়নবাদীদের জন্য এ কোনো সাধারণ যুদ্ধ নয়, সর্বাত্মক ধর্মযুদ্ধ। সারা বিশ্বের সব নৈতিকতা আর যুদ্ধনীতি ভূলুণ্ঠিত করে উন্মত্ত হাতির মতো হাজারে হাজারে হত্যা করছে অসহায় শিশু আর নিরপরাধ নারীদের। কারণ তারা জায়নবাদীদের অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে জন্মভূমির মুক্তি চায়, স্বাধীনতা চায়, মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। তারা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছে এক মহাসত্য- মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই। মানবাধিকার শুধু তেল আবিবে থাকে, গাজায় নয়। মানবাধিকার শুধু ওয়াশিংটনে আছে, কাবুলে নয়। ব্রিটেনে আছে, বাগদাদে নয়। মানবাধিকার নামের কালো কৌতুক শুধু পৃথিবীকে বোকা বানানোর জন্য পশ্চিমের ক্রুসেডের অস্ত্র। গণতন্ত্র শুধু পশ্চিমের পক্ষে পৃথিবীর গলা চেপে ধরার সাঁড়াশি কৌশল। আমরা যাকে বলছি জাতিসংঘ, সেটা শুধু পশ্চিমের সব অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জন্ম নিয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন শুধু তেলআবিবে শান্তি রক্ষা করতে পারবে, গাজায় নয়। নিজেদের জীবন দিয়ে গাজার মুসলমানেরা দেখিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীর প্রধান অপরাধের নাম এখন ইসলাম। পশ্চিমের কাছে সন্ত্রাসী হওয়ার জন্য মুসলমান হাওয়াই যথেষ্ট। মুসলমানের জন্য জেনেভা কনভেনশন নয়।
তারা পৃথিবীর মানুষের জন্য মানবতার নতুন সনদ রচনার আহ্বান ছড়িয়ে দিচ্ছে আরবে আজমে এশিয়ায় আফ্রিকায় ইউরোপে আমেরিকায়। পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষ হওয়ার আবেদন। তাদের প্রতিটি শিশু নারী বৃদ্ধ যুবক চিৎকার করে বলছে, আমরা মুসলমান। ইসলাম কোনো অপরাধের নাম নয়। তবু এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তারা সভ্য পৃথিবীর পৈশাচিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। শতাব্দীকাল ধরে তারা লড়ে যাচ্ছে সত্যের পক্ষে। তাদের পক্ষে দাঁড়াতে পারছে না মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ওআইসি। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বিকলাঙ্গ শিশুর মতো অসহায় হয়ে আছে আরবলীগ।
পৃথিবীর প্রতিটি যুগে এমনই করে এক একটি দল আজন্মমৃত্যু সত্যের জন্য লড়ে গেছে। মিথ্যার কর্তৃত্বময় পৃথিবীতে তারা সত্যের সেনানি। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে ধ্বংস পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও কখনো সত্যের পরাজয় ঘটেনি। কস্মিনকালেও ঘটবে না। যারা যুগে যুগে কালে কালে সত্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তারা মৃত্যুর অনেক অনেক অনেক ঊর্ধ্বে-মৃত্যুঞ্জয়। সত্যকে পরাজিত করতে পারে সে শক্তি কার? সত্য চিরকাল বিজয়ী, চিরদিন অপরাজেও। যারা সত্যের সৈনিক, হয়তো তাদের মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু পরাজয় অসম্ভব। হয়তো তাদের বিপর্যয় হতে পারে, কিন্তু বিনাশ অসম্ভব। গাজায় যারা আজ লড়ে যাচ্ছে, তাদের পূর্বপুরুষ এমন করেই জালিমের রক্তচক্ষু বুলেট-বারুদ উপেক্ষা করে আমৃত্যু লড়ে গেছে, তাদের উত্তর পুরুষও জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে পবিত্র ভূমির স্বাধীনতা আর বাইতুল মাকদিসে সিজদার অধিকারের জন্য লড়েই যাবে। যতক্ষণ বাইতুল মাকদিস শত্রুর উদ্ধৃত আক্রমণ থেকে মুক্ত হবে না, পৃথিবীর কোনো শক্তি কিছুতেই তাদের দমন করতে পারবে না। জয়নবাদীরা জানে না, হাজার বার গাজা দখল করে নিলেও বাইতুল মাকদিস কস্মিনকালেও তাদের হবে না। সব মধ্যপ্রাচ্য দখল করে নিলেও পৃথিবী থেকে মুসলমান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। ইসলামকে যতই সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করুক, পৃথিবীর আদি থেকে ইসলাম ছিল, অন্ত পর্যন্ত ইসলাম থাকবে। যারা ইসলামকে গোলাবারুদ দিয়ে মুছে ফেলতে চায়, পৃথিবীর ইতিহাসে হাজার হাজার বার তারা নিজেরাই মুছে গেছে। আরো লাখো কোটিবার তারা মুছতে থাকবে, হারতে থাকবে, নিশ্চিহ্ন-নির্বংশ হতে থাকবে। কারণ ইসলাম একমাত্র আল্লাহর ধর্ম। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তাদের যুদ্ধ স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে। জায়ানবাদী দানবের পাশবিক আঘাতে গাজায় যখন আমাদের ভাইয়েরা শহীদ হয়, আমাদের শিশুরা গন্ধরাজ ফুলের মতো সাদা কাফন জড়িয়ে হাসিমুখে শুয়ে থাকে, আমাদের মায়েরা যখন নবীযুগের নারী সাহাবীদের মতো সম্ভ্রমে শরীরে জড়িয়ে নেয় শাহাদাতের চাদর, তাদের পশ্চাতে এসে দাঁড়ান বনি ইসরাইলের হাতে শহীদ হওয়া হাজার হাজার নবীদের মিছিল। আসমান থেকে শুভ্র ডানার ফেরেশতারা কাতারে কাতারে নেমে আসেন মণি-মুক্তার তশতরিতে করে বেহেশতি সুগন্ধি নিয়ে। নেমে আসে জরিন সুতোয় বোনা রেশমি কাপড়ের কাফন নিয়ে। আমার ভাইয়ের বুকে যে বুলেট বিঁধে, তার ফলা এসে লাগে আমাদের কলিজায়। আমাদের নিষ্পাপ শিশুরা যখন বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন শরীর নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, আমরা অসহায় অক্ষমতায় তরপাতে থাকি পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। আমাদের হাত আকাশের দিকে উত্তোলিত রাখি মোনাজাতে। আমাদের চোখ থেকে অষ্টপ্রহর বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে অনুতাপের অস্ত্র। কিন্তু কাঁটাতারের সীমান্ত অতিক্রম করে আমরা যেতে পারি না। এ আমাদের অক্ষমতা নাকি কাপুরুষতা, আমরা নির্ণয় করতে পারি না।
আমরা তো পাঠ করেছি বদরের ইতিহাস। আমরা অতিক্রম করে এসেছি খায়বার, বনু কুরাইজা, বনু নজির আর বনু কাইনুকার যুদ্ধ। পরাজয়ের গ্লানি কোনোকালেই আমাদের ছিল না। আমরা হজরত ওমরের হাতে বিজিত পেয়েছি বাইতুল মাকদিস। সেখানে সেজদার অধিকার দিয়েছিলেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। তবু আমরা আজ সেজদার অধিকার থেকে বঞ্চিত। আজ আমাদের শরীর ভরা শুধুই শীতল রক্ত। আমাদের অন্তর ভরে আছে নেফাকের অন্ধকারে। ঈমান আমাদের জাগাতে পারে না সাহসে চিৎকারে জিহাদে। জীবিত থেকেও আমরা মৃতদের অধম। মাবুদ, পরাজয়ের এই কলঙ্কিত কারাগার থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিচরণ করতে চাই কালিমা লেখা পতাকার পাগড়ি মাথায় জড়িয়ে। আমরা আপনার পৃথিবীতে ঘোষণা করতে চাই আপনার একক রাজত্ব। আপনি আমাদের প্রথম কেবলা অধিকারের শক্তি দিন। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আপনার শত্রুদের কুপোকাত করার কুওত দিন। তুফান আল আকসা যেনো আমাদের ঘুমন্ত উম্মাহর শত বছরের পুরোনো ঘুম ভাঙতে পারে।
লেখক : কবি ও গবেষক