ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিন নবীদের আবাসভূমি

শাহাদাত হোসাইন
ফিলিস্তিন নবীদের আবাসভূমি

ফিলিস্তিন অসংখ্য নবী-রাসুলের আবাসস্থল। হিজরত ভূমি। মহান আল্লাহর বরকতের ভূমি। এর বরকত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি (সুরা ইসরা : ১)। ফিলিস্তিন নিজের বুকে যতগুলো নবী-রাসুল ধারণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছে, অন্যকোনো ভূমি সেটা পারেনি। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রায় সব নবী এখানে এসেছিলেন। বরকতময় করেছেন এই জমিনকে। ফিলিস্তিনে আগত নবী-রাসুলের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরত : মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম খলিলুল্লাহ। ইরাকের বাবেল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়ে, পিতা আযরকে বললেন, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করেন? আমি আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে ¯পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি (সুরা আনআম : ৭০)। আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছাতে গিয়ে বাধা এবং অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হন। এক আল্লাহর ইবাদতের অপরাধে পিতা কর্তৃক দেশান্তরিত করার হুমকি দেয়া হয়। কোরআনে এসেছে- হে ইবরাহিম, তুমি কি আমার দেব-দেবি থেকে বিমুখ? যদি তুমি বিরত না হও অবশ্যই আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করব। নয়তো, তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও (সুরা মারইয়াম : ৪৬)। ঈমান রক্ষায় স্ত্রী সারা, ভাতিজা লূতসহ প্রথমে হাররান সেখানে থেকে হালবে তারপর ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরত করেন (আতলাসুল কোরআন : ৩০)। ফিলিস্তিনেই তার মৃত্যু হয় এবং জেরুজালেমে সমাহিত হন (কাসাসুল কোরআন ২ : ১৬৪)।

ইসমাঈল (আ.)-এর জন্মস্থান : বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরতের পর দীর্ঘ ২০ বছর পর্যন্ত নিঃসন্তান থাকলে, বিবি সারা ইবরাহিম (আ.) কে বললেন, আল্লাহ আমাকে সন্তান থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। আপনি বরং আমার দাসী হাজেরাকে বিবাহ করেন। হতে পারে আল্লাহ তার থেকে সন্তান দান করবেন। হাজেরার গর্ভে ফিলিস্তিনে ইসমাঈল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন (কাসাসুল আম্বিয়া ১ : ২০০)। পরবর্তীতে আল্লাহর আদেশে শিশু ইসমাঈলসহ হাজেরাকে মক্কায় রেখে আসেন। কোরআনে এসেছে, হে আমার প্রতিপালক, আমি আমার বংশধরদের কতিপয়কে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যাকায়, তোমার পবিত্র গৃহের কাছে (সুরা ইবরাহিম : ৩৭)। ইসমাঈল (আ.) মক্কায় সারা জীবন কাটান এবং মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত হন।

ইসহাক (আ.)-এর জন্মভূমি : ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বিতীয় পুত্র ইসহাক। স্ত্রী সারার গর্ভ থেকে ইসহাক (আ.)-এর জন্মের সুসংবাদ এমন সময় পান, যখন উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হন। যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ইবরাহিম (আ.) বলেন, সব প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাকে বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন (সুরা ইবরাহিম : ৩৯)। ইসহাক (আ.) ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সেখানেই বসবাস করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় নবুওয়াত প্রাপ্ত হলে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে তিনি ইরাকে গমন করেন। তবে তার ইন্তেকাল ফিলিস্তিনে হয় এবং সেখানেই কবরস্থ হন (আতলাসুল কোরআন : ৩৫)।

লুত (আ.)-এর আবাস : আল্লাহর নবী লুত (আ.)-এর আবাসস্থলও বৃহত্তর ফিলিস্তিনে। তিনি ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। কোরআনে এসেছে- লুত তার (ইবরাহিমের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করল (সুরা আনকাবুত : ২৬) এবং তার সঙ্গে ফিলিস্তিনে হিজরত করেছিলেন। পরবর্তীতে ইবরাহিম (আ.)-এর পরামর্শ সাপেক্ষে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা সাদুম ও আমুরায় চলে যান। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে যা বর্তমান মৃত সাগর এবং তার তীরবর্তী এলাকা। সেখানকার লোকেরা নিকৃষ্ট, ঘৃণিত স্বভাবের ছিল। তারা সমকামিতায় আসক্ত ছিল। লুত (আ.) তাদের এহেন ঘৃণিত কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। কোরআনে এসেছে এবং আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ (সমকামিতা) করছ, যা তোমাদের আগে সারাবিশ্বের কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত পুরুষদের কাছে গমন কর নারীদের ছেড়ে। বরং তোমরা সীমালংঘন করেছ (সুরা আরাফ : ৮০, ৮১)। উক্ত আপরাধের কারণে সাদুম ও আমুরাবাসীর ওপর আসমানি গজব নেমে এলে আল্লাহর হুকুমে তিনি পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে চলে যান এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন (কাসাসুল কোরআন ২ : ১৫৪)।

ইয়াকুব (আ.)-এর মাতৃভূমি : ইয়াকুব (আ.) যার অপর নাম ইসরাঈল। তিনি ইসহাক (আ.) পুত্র এবং ইবরাহিম (আ.) এর পৌত্র। জন্ম ফিলিস্তিনে। ভ্রাতা ইসুর সঙ্গে মনোমালিন্য হলে, মা রাফকাহের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে চলে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর স্ত্রী-সন্তানসহ ফিলিস্তিনে চলে আসেন (কাসাসুল কোরআন ২ : ১৬৬)। ইয়াকুব (আ.)-এর বারোজন পুত্র ছিল। শেষ বয়সে মিশরে হিজরত করেছিলেন এবং সেখানেই মৃত্যু হয়। মিশরেই তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালীন সময় তিনি সন্তানদের ওয়াসিত করেছিলেন, মিশর ত্যাগকালে তার লাশ যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়া হয়। ওয়াসিয়্যাত অনুযায়ী তার লাশ ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয় এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে সমাহিত করা হয় (আতলাসুল কোরআন : ৩৫)।

ইউসুফ (আ.)-এর শৈশব : ইউসুফ (আ.)। যার ঘটনাকে কোরআন আহসানুল কাসাস বলেছে। ইয়াকুব (আ.) ছেলে। জন্ম দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে। পিতার সঙ্গে ফিলিস্তিনে আসেন। শৈশবের কিছুদিন ফিলিস্তিনেই কাটে। বিমাতা ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কুয়ায় নিক্ষিপ্ত হন। কোরআনে এসেছে- হত্যা কর ইউসুফকে কিংবা ফেলে আস তাকে অন্য কোনো স্থানে। তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, তোমরা ইউসুফকে হত্যা কর না, বরং ফেলে দাও তাকে অন্ধকূপে, যাতে কোনো পথিক তাকে উঠে নিয়ে যায়, যদি তোমাদের কিছু করতেই হয় (সুরা ইউসুফ : ৯, ১০)। এক বণিক কর্তৃক কুয়া থেকে উত্থিত হয়ে মিশরে দাস হিসাবে বিক্রিত হন। নবুওয়াতপ্রাপ্ত ও মিশরের মন্ত্রী হলে, স্বীয় পিতা ও ভাইদের সেখানে নিয়ে যান। মৃত্যু অবধি সেখানে থাকেন এবং সেখানেই সমাহিত হন (কাসাসুল কোরআন ৩ : ১২)। কিন্তু মৃত্যুকালীন ওয়াসিয়্যাত অনুযায়ী তার লাশকেও ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে স্থানান্তারিত করা হয় (আতলাসুল কোরআন : ৪৮)।

দাউদ (আ.) : দাউদ (আ.) আল্লাহর প্রিয়নবী। যিনি একই সঙ্গে নবী ও বাদশাহ ছিলেন। পর্বতমালা ও পাখণ্ডপাখালি দাউদের অনুগত ছিল। আল্লাহ বলেন, আমি পর্বত ও পক্ষীগুলোকে দাউদের অনুগত করে দিয়েছিলাম (সুরা আম্বিয়া : ৮০)। সুরা সাবায় এসেছে, আমি দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম এই আদেশ মর্মে যে, হে পর্বতমালা, তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং হে পক্ষী সব তোমরাও। আমি তার জন্য লৌহকে নরম করেছিলাম (১০)। নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তালুতের দলে যুদ্ধে শরিক ছিলেন। তিনিই বাদশাহ জালুতকে হত্যা করেন। তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে সেখানকার শাসক ও নবী হিসাবে মনোনীত হন। তিনি আসদুদ, বাইতে দুজান, আবু গাওস, বাইতুল মুকাদ্দাস এবং রামলার শাসক ছিলেন। ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে রামলাগামী পথের ডানপার্শ্বে একটি পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয় (আতলাসুল কোরআন : ৬৪)।

সুলাইমান (আ.) : সুলাইমান (আ.) দাউদ (আ.)-এর পুত্র। আল্লাহর নবী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমগ্র পৃথিবী শাসনকারী শাসকদের অন্যতম। আল্লাহতায়ালা পশুপাখি, বায়ুমণ্ডল ও জিন্ন জাতিকে তার অধীন করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, সুলায়মান দাউদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে লোক সব, আমাকে উড়ন্ত পাখির ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটা সু¯পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব (সুরা নামল : ১৬)। এই মহান নবীর জন্ম, বসবাস সবই ছিল ফিলিস্তিন কেন্দ্রিক। তিনি ঐতিহাসিক বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদের নির্মাতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৯২৩ অব্দে ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে তাকে দাফন করা হয় (আতলাসুল কোরআন : ৬৮)।

ইয়াহইয়া (আ.) : জন্ম ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে। যাকারিয়া (আ.)-এর দোয়ার ফসল ছেলে ইয়াহইয়া। তার মর্যদা, তাকওয়া, জনপ্রিয়তা ও আল্লাহর দিকে আহ্বান-এর কারণে তিনি ইয়াহিদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার কারণে বাইতুল মুকাদ্দাসে ভেতর হায়কল ও কোরবানি করার মধ্যবর্তী স্থানে তাকে শহিদ করা হয় (কাসাসুল কোরআন ৭ : ৬২)।

ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও ফের আগমন : ঈসা ইবনে মারইয়ামের জন্ম ফিলিস্তিনের বাইতে লাহামে। যিনি পিতা ব্যতীত আল্লাহর কুদরতের সাক্ষী হিসাবে দুনিয়াতে আগমন করেন। তিনি দোলনায় থাকাবস্থায়, নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দেন এবং মায়ের সতীত্বের সাক্ষ্য দেন। সুরা মারইয়ামে এসেছে- মারইয়াম বলল, কিরূপে আমার পুত্র হবে, যখন কোনো মানব আমাকে ¯পর্শ করেনি এবং আমি কখনো ব্যভিচারিণীও ছিলাম না। সে বলল, এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ সাধ্য (২০-২১)। অন্যত্র এসেছে, তিনি দোলনায় থাকাবস্থায় এবং পরিণত বয়সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন এবং তিনি হবেন পুণ্যবানদের একজন (সুরা আলে-ইমরান : ৪৬)। তিনি ফিলিস্তিন অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মায়ের সঙ্গে মিসরেও গমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে আবার ফিলিস্তিনে চলে আসেন। অভিশপ্ত ইয়াহুদিরা তাকে জারজ সন্তান এবং তার মাকে দুঃশ্চরিত্রা বলে অপবাদ ও কষ্ট দিতে থাকে। তিনি তাদের বিপক্ষে বদণ্ড দোয়া করলে আল্লাহর গজব তাদের ওপর আসতে থাকে। তখন তারা ঈসাকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু আল্লাহ স্বীয় কুদরতে তার নবীকে জীবতাবস্থায় আসমানে তুলে নেন। সুরা নিসায় এসেছে- আর নিশ্চয়ই তারা তাকে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ তাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (১৫৭-১৫৮)। কেয়ামতের আগে তিনি পুনরায় দুনিয়াতে আসবেন। বায়তুল মুকাদ্দাসে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। দাজ্জালকে হত্যা করবেন। ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন। এরপর তার মৃত্যু হবে এবং নবীজির রওজার পাশে সমাহিত হবেন।

লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা, রংপুর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত