কোরআন গবেষণায় উইলিয়াম টিসডালের ভ্রান্তি বিলাস : ০৩

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পঞ্চম অধ্যায়ে টিসডাল দাবি করেন ইরানি জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের কিছু উপাদান কোরআনে পাওয়া যায়। এ অধ্যায়ের শিরোনাম হলো ‘Zoroastrian Elements in the QurÕan and Traditions of Islam’ ইসলামের কোরআন ও তার ট্রাডিশনে জরথুষ্ট্রীয় উপাদান। তিনি বলেন, ‘জরথুষ্ট্রবাদের এমন মশহুর গল্প রয়েছে যে, এই মতাদর্শের নবী আকাশভ্রমণ করেছেন। স্বর্গ ও পবিত্র গাছ দেখে এসে বিবরণ দিয়েছেন মানুষের সামনে।’ খুব সম্ভবত, ইসলামের নবী পারস্য রীতির এই গল্প থেকেই নিজের জন্য মিরাজের ধারণাটি তৈরি (develop) করতে পেরেছিলেন।

টিসডালের ভাষ্যমতে :

‘যেহেতু পারস্য রাজাদের কাহিনি আরবদের আগ্রহের জায়গায় ছিল, তাই তাদের গল্পকাহিনি জানা থাকারই কথা। রুস্তম ও ইসফান্দিয়ারের কথা আরবরা শুনে আসছিলেন যুগ যুগ ধরে। তাই বলা যায়, পারস্য রীতিনীতি ও গাল-গল্প আরবদের না-জানা থাকার কথা নয়। তবে আর্ট বিরাফের স্বর্গারোহন, তার আগে জরোয়াস্টারের ফরাসি উপকথা, তাদের স্বর্গের বর্ণনা, চিনভাতের সেতু, টালি গাছ, আদিম যুগের অন্ধকার থেকে আহরিমানের বেরিয়ে আসার মিথ ও কিংবদন্তি; এ ধরনের বিস্ময়কর কাহিনি আরবদের কাছে সম্পূর্ণ অজানাই ছিল। এসবের সঙ্গে তারা পরিচিত হয় মুহাম্মদের কল্যাণে। কারণ ইসলামের নবী এসব কিংবদন্তি ব্যবহার করেছিলেন।’ (১৫)

আমরা যদি টিসডালের টেক্সট বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, এখানেও তিনি সম্ভাব্যতা তত্ত্বকে (Theory of Probability) যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন। আরবরা ইরানি রীতির প্রসিদ্ধ কাহিনি ও ধারণাপ্রসূত গল্পের বিষয়ে অবগত ছিল। এই অবগতিকে ইসলামের নবী ব্যবহার করেছেন জরথুষ্ট্রবাদের সাহায্য নিয়ে। কিন্তু এ জাতীয় ধারণা ও সম্ভাব্য অনুমানের ভিত্তিতে কি কোনো বৈজ্ঞানিক কাঠামো দাঁড়াতে পারে? আলবত না। যে কোনো জ্ঞানীয় অবকাঠামো দাঁড় করাতে হলে তার জন্য প্রয়োজন নিশ্চিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। যা সম্ভব নয় থিউরি অব প্রোবাবলিটি দ্বারা। মহানবী (সা.) ইরানি কাহিনিকে কোরআনে ব্যবহার করেছেন, কোনো ঐতিহাসিক ভাষ্য কি-এর সত্যায়ন করে? কোনো পর্সিয়ানও তো এই দাবি করেনি আধুনিককালে প্রাচ্যবিদদের দ্বারা প্ররোচিত হবার আগে? না কোনো আরব, না কোনো অনারব ইরানি গল্প থেকে মেরাজের কাহিনির জন্ম হওয়ার ধারণা করল, যারা মেরাজকে অস্বীকার করছিল, তাদের কেউ অন্তত বলতে পারত, এটা তো আমাদের জানা ইরানি গল্পের অনুকরণ! ইসলাম যখন পারস্যে গেল, সেখানে পার্সিয়ান জাতীয়তাবাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বহুবিধ যুদ্ধ করেছে, বিদ্রোহ করেছে, ইসলামকেও আক্রমণ করেছে। তাদের কেউ কখনোই নিজেদের অতিচেনা গল্পের সঙ্গে কোরআনের মেরাজবৃত্তান্তকে মেলাতে পারেনি। কারণ সবাই জানত, উভয়ের মধ্যে কোনো মিল আদৌ নেই এবং মহানবী (সা.) ইরানি গল্পের দ্বারা অনুরক্ত হয়ে কোরআনে কিছু সংযোজন করেছেন, এমন বকোয়াজ বিশ্বাস করার সম্ভাব্যতা নেই। সম্ভাব্যতা তখন ছিল না। কিন্তু হাজার বছর পরে টিসডালের কল্পনায় সেই সম্ভাব্যতার চারা জেগে উঠেছে। এতে অবশ্য তিনি একা নন, পশ্চিমা পণ্ডিতদের অনেকেই সুর মিলিয়েছেন। কোনো প্রমাণের দরকার নেই, বলতে থাকাটাই মুখ্য। যেন বহুল উচ্চারিত মিথ্যাকে সত্যের মতো শোনায়।

বইটির ষষ্ঠ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হলো- কোরআনের অন্যতম উৎস আরবের হানিফিজম ও তার চিন্তাধারা। এ অধ্যায়ের শিরোনাম হলো- The Hanifs and Their Influence Upon Nascent Islam অর্থাৎ, নয়া ইসলামের উপর হানিফ ও তার প্রভাব। টিসডাল দাবি করেন, হানিফিজমের যতো মৌলিক নীতি ও বিধি আছে, তার সবগুলো কোরআনে মজুত আছে। যেমন একত্ববাদের স্বীকৃতি, মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান, জান্নাতে বিশ্বাস, মেয়েদের জীবন্ত কবর দেওয়ার নিন্দা, আল্লাহর সিফাতি নাম রব, রহমান ও গফুর ইত্যাদি। দ্বীনে হানিফের অনুসারিরা জাহেলি যুগেও একেশ্বরবাদে অটল ছিল।

টিসডালের বক্তব্য : ‘হানিফিজম কর্তৃক উল্লিখিত মূলনীতির প্রত্যেকটিই কোরআনে রয়েছে। যেমন :

(১) তৎকালীন আরবদের নির্দয় রীতি অনুযায়ী শিশুকন্যাদের জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করার নিন্দাজ্ঞাপন ও নিষেধাজ্ঞা। (২) খোদাপাকের একত্বের স্বীকৃতি। (৩) মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান এবং লাত, উজ্জা ও অন্যান্য দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধকরণ । (৪) ভবিষ্যতে স্বর্গসুখের প্রতিশ্রুতি। (৫) পাপীদের জন্য জাহান্নামে সংরক্ষিত শাস্তির সতর্কবাণী। (৬) অবিশ্বাসীদের ওপর খোদাপাকের ক্রোধ ও নিন্দা। (৭) রহমান (দয়াময়), রব (প্রভু) ও গফুর (ক্ষমাকারী) উপাধির প্রয়োগ।’(১৬)।

টিসডাল দাবি করেন, ‘তার পরিবারের লোকেরা ছিল দ্বীনে হানিফের অনুসারী। তাই তাদের চিন্তাভাবনা তাকে প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক।

উদাহরণস্বরূপ, ওসমান ইবনে হুওয়াইরিস এবং ওয়ারকা ইবনে নওফল ছিলেন দ্বীনে হানিফের অনুসারী। যারা ছিলেন হজরত খাদিজার চাচাতো ভাই এবং উবায়দুল্লাহ ছিলেন তার ফুফাতো ভাই।’ (১৭)

কিন্তু বাস্তবতা কী? ওসমান ইবনে হুওয়াইরিস সম্পর্কে আমরা ইবনে হিশামের বর্ণনা উদ্ধৃত করছি। ‘তিনি নবুওয়তের তিন বছর আগে সিরিয়ায় চলে যান। সেখানে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন।’ ফলে নবীজির উপর তার প্রভাবের কোনো সম্ভাবনাও থাকতে পারে না। আর ওয়ারকা ইবনে নওফল তো দ্বীনে হানিফে থাকেননি।

তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। নবুওয়তের সময় তিনি অন্ধ ও বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। আল্লাহর রাসুল তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রথম ওহী নাজিল হওয়ার পরে। সে আলাপ আগেই করেছি। প্রকৃত অর্থে দ্বীনে হানিফের কোনো রূপরেখা আরবের কোথাও ছিল না তখন। ইবরাহিমের (আ.) বংশধর হিসেবে সেই সত্যবিশ্বাসের স্মৃতি অর্পণ করতেন কেউ কেউ। কিন্তু কীভাবে এর অনুসরণ করবেন, তা জানতেন না। সত্যের সন্ধান ও একত্ববাদের তৃষ্ণা কিছু হৃদয়কে ব্যাকুল রাখত। কিন্তু একত্ববাদ কী ও কেমন? সেটাও তাদের জানা ছিল না। সে বিষয়ে দ্বীনে হানিফের কোনো বয়ান হাজির না থাকায় ওরাকা ওসমানের মতো লোকেরা খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে যান।

কারণ দ্বীনে হানিফ কাউকে কোনো আকিদা বা নির্দেশনা দেবে, এতটুকু অস্তিত্ব নিয়েও জীবিত ছিল না। ফলে তা মহানবী (সা.) কে পথ দেখাবে এবং কোরআনের বিষয় ও ভাষ্যের জোগান দেবে, এটা সম্ভব ছিল না আদৌ।

দ্বীনে হানিফ হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর শিক্ষা ও হেদায়েত। ফলে বিকৃত ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও দ্বীনে হানিফের মধ্যেও কিছু মিল পাওয়া যায়। যেভাবে দূরবর্তী মিল পাওয়া যায় তিন ধর্মের সঙ্গে ইসলামের। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বংশসূত্রে যেমন ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এর বংশধর, তেমনি এ দুই নবী ছিলেন ইসলামের কাছে বিশেষ পয়গাম্বর। ইবরাহিম (আ.) কে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার আনিত হেদায়েতের অনুসারিদের তিনি মুসলিম নামে ঘোষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সূচনা প্রথম নবী ও প্রথম মানব থেকে। ইসলামের পরিপূর্ণতা নিশ্চিত হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বারা। ফলে নবীরা হচ্ছেন সম্পর্কিত অভিন্ন এক পরিবার। তাদের পারস্পরিক শিক্ষায় রয়েছে মিল ও যৌথতা। একে ধারণ করে ইসলাম চিরন্তন ও সর্বজনীন সেই সত্যের কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করেছে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : নবীরা আল্লাতি (বাপ শরিক) ভাই, তাদের মা (শরিয়ত) আলাদা বটে; কিন্তু বাবা (দ্বীন) এক ও অভিন্ন। (১৮)

সূত্র : 15. - The Original Sources of the Quran, p. 42. 16. - Ibid., p. 82. 17. Ibid. 18. মুহাম্মদ আল বোখারি, সহিহুল বোখারি, কিতাবু আহাদিসিল আম্বিয়া, ওয়াজকুর ফিল কিতাবি মারইয়াম অনুচ্ছেদ। ৪/১৪৭।

লেখক : কবি ও গবেষক