অজ্ঞান পারিশার বুকে হঠাৎ কান্না শুরু করল সোনামানিক। মালিহা এগিয়ে এলো। সোনামানিককে তুলে নিল কোলে। সন্ধ্যা তখন আসি আসি করছে। হঠাৎ একদল দাঙ্গাবাজ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। হাতে রামদা। মুখে কালো মুখোশ। খাটের উপর অজ্ঞান পারিশার মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে দেখল ওরা। একজন বলল, ‘আরে, এ তো জোয়ান মেয়ে। বেশ সুন্দরীও। নিয়ে গেলে কেমন হয়?’ ‘আরে না, এই মেয়ে অজ্ঞান, শরীর ঠান্ডা, মরে গিয়েও থাকতে পারে।’ দলনেতা বলে। এ সময় মালিহাকে দেখে ফেলল ওরা। সোনামানিককে কোলে নিয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়েছিল সে। ‘আরে! এর কোলে বাচ্চা!’ কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল। ‘আজকের বাচ্চা মানেই আগামী দিনের মুসলমান। সুতরাং অঙ্কুরেই একে শেষ করে দিতে হবে।’ ‘হ্যাঁ, তবে হাতের কাজ আগে সেরে নাও।’ ওরা স্টিলের আলমারি আর কাঠের সিন্ধুকের সামনে হাজির হলো। নগদ টাকা, স্বর্ণ-রুপা আর দামি সব কাপড় লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই ফাঁকে চুপচাপ উঠোনে নামল মালিহা। জানে, পালাতে না পারলে নিজের জীবনের সঙ্গে সোনামানিকের জীবনও নিভে যাবে। পালাতেই হবে। এক পা দু’পা করে উঠোন পেরোলো সে। কোনোরকম বাইরে বেরিয়ে দৌড় দিল। টানা দশমিনিট দৌড়ে পাড়ার শেষ মাথায় গিয়ে থামল। উঠল পরিচিত এক সওদাগরের বাড়ি গিয়ে। রাতটা ওখানেই কাটানোর ইচ্ছা তার। ভোরে ফিরে আসবে বেগম সাহেবার কাছে।
৪. রাত তখন গভীর। ঘরের ভেতর ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। বাইরে ঝুমুর ঝুম বৃষ্টি। চারঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরল পারিশার। সঙ্গে সঙ্গে তার সোনামানিকের কথা মনে পড়ে গেল। সোনামানিককে বুকে জড়িয়েই জ্ঞান হারিয়েছিল সে। অন্ধকারে সারা খাট হাতড়ে ফিরল পারিশা। নেই! খাটে তার সোনামানিক নেই! কই গেল সোনামানিক? কই হারিয়ে গেল তার কলিজা? ঝট করে উঠে বসতে চাইল পারিশা। পারল না। শরীর দুর্বল।
প্রসবের ধকল এখনো কাটেনি। চাকরানি মালিহার নাম ধরে ডাকল একবার। দুর্বল গলার ডাক বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পাশের ঘরেও পৌঁছল না। শেষে কষ্টেসৃষ্টে উঠে বসল সে। বালিশের তলা হাতড়ে ম্যাচ হাতে নিল। লণ্ঠন জ্বেলে এই ঘরে ওই ঘরে সোনামানিককে খুঁজে ফিরল। বেদনায় ডুকরে উঠল তার বুক। হাহাকার শুরু হলো মনের ভেতর। দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়াল সে। উঠোনও খালি। কেউ নেই। চাকরানিও নেই। তার সোনামানিকও নেই।
‘তবে কি দাঙ্গাবাজরা এসেছিল? চাকরানিকে তুলে নিয়ে গেছে? মেয়েটা তো যুবতী। তার উপর সুন্দরী। নিয়ে গিয়েও থাকতে পারে। কিন্তু আমার সোনামানিক কই? দাঙ্গাবাজরা কি ওকেও নিয়ে গেছে! আমার সোনামানিককে কেন নিয়ে গেছে ওরা? মেরে ফেলবে না তো!’
হাহাকার শুরু হলো পারিশার বুকের ভেতর। পারিশা ঘরে ফিরে এলো। লক্ষ করল, পুরো ঘর উলট-পালট। আলমারির সিন্দুক ভাঙা। মালামাল আর জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো। হ্যাঁ, দাঙ্গাবাজরা এসেছিল।
সন্তান হারিয়ে পারিশা হয়ে উঠল উন্মাদিনী। ভয়ডর দূর হয়ে গেল মন থেকে। সারা দিন উপোস। তবুও দুর্বল শরীরে কোত্থেকে যেন প্রচণ্ড শক্তি এসে ভর করল। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়ল পারিশা। দাঙ্গাবাজদের আস্তানা চেনে সে। যাবে ওখানে। সোনামানিকের খোঁজ তার পেতেই হবে! পেতেই হবে!
৫. পরদিন। ভোর হয়নি তখনো। চারদিকে আলো-আঁধারী। মালিহা দুরুদুরু বুকে বেগম সাহেবার বাড়ি ফিরে এলো। দেখল, ঘরের দরজা হাটকরে খোলা। বাড়িঘর সব উলটপালট। আলমারি সিন্ধুক তছনছ হয়ে আছে। বেগম সাহেবার কোনো চিহ্ন নেই। সারাবাড়ি খাঁ খাঁ করছে। দাঙ্গাবাজরা কি নিয়ে গেছে বেগমসাহেবাকে? হতে পারে।
নারী অপহরণ করে ধর্ষণ করা উগ্র-দাঙ্গাবাজরা পুণ্যের কাজ মনে করে। ওরা নিয়ে গিয়ে থাকলে আর ফেরার আশা নেই। এ বাড়িও এখন নিরাপদ নয়। আবার হয়ত দাঙ্গাবাজদের আরেক দল এসে হাজির হবে। বাড়িঘর লুট করবে। তার চেয়ে জীবন নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়াই ভালো। সোনামানিকও বাঁচবে- সেও বাঁচবে। বেগম সাহেবা যদি ফিরেও আসে, সন্তানের খোঁজে অবশ্যই আগপাড়ায় তার বাড়ি এসে হাজির হবে। ভাবতে ভাবতে আগপাড়ার পথ ধরল মালিহা। হারিয়ানার রোহতক জেলার আগপাড়ায় তার স্বামীর বাড়ি।
৬. মালিহার বিয়ের পর সাফওয়ানের সংসারে ছয় ছয়টি বছর কেটে গেছে, ওদের সন্তান হয়নি। একটা সন্তানের জন্য বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে। মনটা কেমন ছোট হয়ে থাকে। জীবনটা কেমন পানসে লাগে। আজ আত্মাটা যেন শীতল হয়েছে। একটা সন্তান এসেছে ওদের সংসারে। হোক অন্যের, তবু সন্তান তো! একেই ওরা নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করছে! বুকের ভেতর জমে থাকা সব আদর মমতা দিয়ে বড় করে তুলছে। মালিহা তাকে সোনামানিক নামেই ডাকে। ধন সম্পদের প্রাচুর্য হয়তো মালিহার ছিল না। কিন্তু আদর-যত্নের প্রাচুর্য দিয়ে সেটা সে ঢেকে দিয়েছে। পরম আদর-যত্নে বেড়ে উঠছে সোনামানিক। তার বয়স এখন বার। দু’বছর আগেই নিজের জীবন কাহিনি জেনেছে সে। তারপর একরাতে স্বপ্ন দেখেছে মাকে। সেই থেকেই পাল্টে গেছে সোনামানিক। ঘরে আর মন টেকে না। শুধু ছটফট করে। আনচান করে।
মালিহা এখন আগপাড়ার এক বড়লোক বাড়ির চাকরানি। সকালে যায় বিকেলে ফেরে। ও বাড়িতে আজ বিয়ে। হাজার হাজার লোকের মেহমানদারি। মস্ত আয়োজন। সোনামানিককে আজ আদর করে বিয়ে বাড়ির খাবার খাওয়াবে মালিহা। তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। কতোদিন ধরে ভালোমন্দ খাওয়া হয় না। তাছাড়া, রোজ রোজ তাকে ভালোমন্দ খাওয়ানোর সামর্থ কী মালিহার আছে! বাড়ির সামনের খালি জায়গাটায় সোনামানিককে খেলায় লাগিয়ে দিয়ে মালিহা চলে গেল বাড়ির ভেতরে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাজে। ঘণ্টাদুয়েক পর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। মালিহা সোনামানিককে আদর করে খাওয়ালো। বাড়ির বেগম সাহেবা বাড়ি নেয়ার জন্য আরো দু’বাটি খাবার দিল মালিহাকে। বাটি দুটো দিয়ে সোনামানিককে বাড়ি পাঠিয়ে দিল সে।
বাড়ির গেটে তখন বহু মানুষের ভিড়। খাওয়া-দাওয়া সেরে মেহমানরা বেরিয়ে আসছে। কয়েকজন ফকিরও জুটেছে গেটে। এদের মাঝে একমহিলার গলা শুনে সোনামানিক আঁৎকে উঠল। তার বুক ধক করে উঠল। শাড়ির আঁচলে মহিলার মুখ ঢাকা। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আমাকে দু’মুঠো খেতে দিন। আমাকেও একটু খেতে দিন।’ মহিলার গলার স্বর শুনে সোনামানিকের বুক কেমন করে উঠল। বড় চেনা চেনা লাগল এই গলা। ভিড় ঠেলে সে মহিলার কাছাকাছি যেতে চাইল। তার আগেই চাকর-বাকররা গেট ফাঁকা করতে এলো। ফকিরদের ধাওয়া করল। গেট ছেড়ে ফকিররা দৌড়ে সরে গেল। কিন্তু অই মহিলা দুর্বল। জোরে দৌড়াতে পারে না। চাকরদের একজন এসে তাকে ধাক্কা মারল। মহিলা মাটিতে পড়ে গিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, ‘আমাকে তোরা মারিস না, ভাগ্যই আমাকে মেরে রেখেছে।’ সোনামানিক দৌড়ে এলো। মহিলার হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, ‘চলুন আমার সঙ্গে। খাওয়াব আপনাকে।’
মহিলা তাকাল সোনামানিকের দিকে। তার মন কেমন আকুলি-বিকুলি করে উঠল। বুকের ভেতরে মমতার কুঠুরিগুলো আচমকা খুলে গেল। বার বছরের বেদনার রক্তক্ষরণ নিমিষেই থেমে গেল। সে হেঁটে চলল সোনামানিকের পিছু পিছু। বাড়ি গিয়ে সোনামানিক তাকে বারান্দায় বসাল। বিয়ে বাড়ির খাবারের বাটি তার সামনে মেলে ধরল। মুখের কাপড় সরিয়ে খেতে শুরু করল মহিলা। তখনই মহিলার মুখের উপর চোখ পড়ল সোনামানিকের। সঙ্গে সঙ্গে চমকে গেল সে। তার চারপাশ যেন থমকে গেল। এ সেই মুখ, স্বপ্নে যে মুখ সে দেখেছিল। যে মুখ থেকে সে মা ডাক শুনেছিল। তার বুকের ভেতর শুরু হলো উথাল-পাতাল ঢেউ। বুক ভেঙে তার এলো কান্না। চোখভেঙে শুধু নামল অশ্রু। সোনামানিক একদৌড়ে বিয়েবাড়ি চলে এলো। দাঁড়াল মালিহার আঁচল ধরে। স্বপ্নে দেখা মায়ের মুখ বাস্তবে দেখার কথা বলল তাকে। মালিহা পাত্তা দিল না। বলল, ‘তোমার কাছে তো সব মহিলাই ‘মা’।’ সোনামানিকের পীড়াপীড়ি থামল না। বাধ্য হয়ে মালিহা বাড়ি এলো। বারান্দায় বসা মহিলাটিকে দেখে সেও থমকে গেল। তার পৃথিবী নিশ্চল হয়ে এলো। এ তার বেগম সাহেবা! দাঙ্গাবাজরা যাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেছিল সে। যার সন্তানকে পরম মমতায় সে লালনপালন করেছে। সেই বেগম সাহেবা এখন তার সামনে! তার চেহারায় আগের সেই অবয়ব আছে, জৈলুশ নেই। সরলতা আছে, আকর্ষণ করার সেই দ্বীপ্তি নেই। না খেতে খেতে মুখের চামড়া বসে গেছে। তবু সেই প্রভাব রয়ে গেছে। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসা চোখে বেদনার ছাপ। চুল আলুথালু। স্বামীর শোক আর সন্তান হারানোর বেদনায় তিলে তিলে ক্ষয়ে গেছে জীবনের বারটি বছর। তবু সন্তান ফিরে পাওয়ার আশায় ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে আছে সে। মালিহা বেগম সাহেবাকে ডেকে উঠল। বলল, ‘আপনি বেঁচে আছেন বেগম সাহেবা! আমি আপনার চাকরানি মালিহা, এই আপনার মানিক! আপনার সোনামানিক!’ আর বলতে পারল না সে। কান্নার গমকে তার গলার স্বর আটকে এলো। অবাক হয়ে সোনামানিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল পারিশা। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ‘মানিক! আমার সোনামানিক!’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল সে। দুর্বল শরীরে কোত্থেকে যেন প্রচণ্ড শক্তি এসে ভর করল। দৌড়ে সোনামানিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। পরম আদুরে গলায় বলল, ‘সোনামানিক আমার! আয় কোলে! কত বছর পর খুঁজে পেলাম তোকে। আয় সোনামানিক! অায় বুকে!’ সোনামানিক আর স্থির থাকতে পারল না! পরম সুখবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল! বাঁধভাঙা আনন্দে চাঁদরাঙা হয়ে উঠল তার পৃথিবী! সে তাকাল মায়ের দিকে! এই তো! দু’হাত দূরেই তার মা! পরম প্রিয় মা! মায়ের কোল! সোনামানিক আর স্থির থাকতে পারল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের কোলে! তার বুকের ভেতরের সুখ, চোখের অশ্রু আর ঠোঁটের হাসি একাকার হয়ে গেল।
লেখক : কবি ও গল্পকার