এক ফালি একটি জনপদের নাম গাজা। ভূমধ্যসাগরের তীরে দখলকৃত ফিলিস্তিনের একটি অবরুদ্ধ জনপদ। যাকে প্রায় সবদিক থেকেই ঘিরে রেখেছে দখলদার ও দখলরত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। একদিকে মিশরের সীমান্ত; কিন্তু সেটিও বন্ধ থাকে। ইসরাইল ও মিশরের যৌথ সম্মতি হলে সেই সীমান্তের রাফাহ ক্রসিং বহু শর্তে মাঝেমধ্যে সীমিত পরিসরে সীমিত সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়। যাকে পছন্দ হয় না, তাকে সীমান্ত পার হতে দেওয়া হয় না। আর যেইদিকে ভূমধ্য সাগরের অথৈ জলরাশি সেখানেও সশস্ত্র পাহারা বসানো ইসরাইলের। এমনকি আকাশ পথও বন্ধ তাদের। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ‘উন্মুক্ত কারাগার’। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ বসতি। ২০০৭ থেকেই অবরুদ্ধতার এই জুলুম।
এই গাজার সশস্ত্র যোদ্ধারা গত ৭ অক্টোবর ভোরে একটি অভিযান চালায় ইসরাইলের সীমান্ত পার হয়ে, ভেতরে ঢুকে। নিজেদের ভূমি দখল ও তাদের ওপর চলা হত্যা, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধই ছিল সফল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। অভিযানটি পরিচালনা করে গাজায় নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন হামাস-এর সামরিক শাখা ইযযুদ্দীন আলকাস্সাম ব্রিগেড। এতে পুরো ইসরাইল এবং দেশ-বিদেশে তার মিত্রদের মাঝে মাতম শুরু হয়ে যায়। এক থেকে দুদিনের মাথায় তারা প্রতিশোধের হুংকার দেয় এবং আকাশ পথে পাল্টা হামলা শুরু করে। তাদের হামলা ছিল ঢালাও। নির্বিচারে নারী-শিশু ও বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করতে থাকে ইসরাইল। গাজার বিভিন্ন জনবসতি, শরণার্থী শিবির, বিদ্যালয় ও ভবন ধসিয়ে দিতে থাকে বোমার আঘাতে। এর সঙ্গে শুরু করে অদ্ভুত ও পরিকল্পিত মিথ্যাচার। প্রথম কয়েক দিনের মাথায় পিলে চমকে দেওয়া একটি মিথ্যা কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি দাবি করেন, হামাসের যোদ্ধারা ৭ অক্টোবরের কয়েক ঘণ্টার অভিযানের সময় ৪০ জন ইসরাইলি শিশুর শির-শ্চেদ করেছে। এই মিথ্যাচারটি ছিল পরিকল্পিত এবং এটি করা হয়েছিল গাজায় ইসরাইলি পাল্টা হামলায় ফিলিস্তিনি হাজার হাজার শিশু এবং আরো কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিককে বোমা মেরে হত্যার বৈধতা দেওয়ার আগাম সনদ হিসেবে। সেজন্য বাইডেন উচ্চারিত ‘শিশু শির-শ্চেদের’ এই ফেইক তথ্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে মোটা শিরোনামে প্রচার হয় এবং এর অস্তিত্বহীন ‘বীভৎসতা’ নিয়ে উত্তেজক পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ চালানো হয়। এরপর নির্বিচার ইসরাইলি বোমাবর্ষণ ও গাজাবাসী ফিলিস্তিনি শিশু-নারী ও নিরীহ নাগরিক হত্যা চলতে থাকে। মিথ্যাচারের দুদিন পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, শিশু-শির-শ্চেদের ঘটনার যে তথ্য ইসরাইলি সূত্র থেকে পাওয়া গিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পশ্চিমা মিডিয়া ‘ইসরাইলি শিশু শির-শ্চেদের’ বাইডেনীয় বক্তব্যকে যত বড় পরিসরে চর্চায় এনেছিল, তথ্যটি মিথ্যা হওয়ার সংক্ষিপ্ত স্বীকারোক্তিটি ততোধিক ছোট পরিসরে প্রকাশ করে দায় সেরে নেয়। এর মধ্যেই ইসরাইল কর্তৃক পাল্টা হামলায় গাজার নিরীহ মুসলিম শিশুহত্যার অমানবিক পর্বটি অনেক দূর এগিয়ে যায়। মিথ্যাকে আসলে ঢালাও হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতির বীজ হিসেবে কাজে লাগানো হয় এখানে।
৭ অক্টোবরের পর পর ইসরাইল ও তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা অনেক রকম হুমকি-হুংকার দিয়েছে, নানারকম মিথ্যাচার করেছে; কিন্তু শিশু শির-শ্চেদের এই মিথ্যাটি উচ্চারণ করে ‘সন্ত্রাসী’ ট্যাগিংয়ের পুরোনো ফর্মুলা ব্যবহার করে তারা ঢালাও ও নির্বিচার হত্যার পাশবিক অনুশীলন করতে চেয়েছে এবং করেছে। তাদের এই কাজে ঠান্ডা মাথায় সহযোগিতা করেছে তাদের সমাজের মিডিয়া। পশ্চিমের ক্ষমতা ও মিডিয়া মিথ্যার বীজ বপন করেছে, সেই বীজকে বৃক্ষ বানিয়েছে, পরে সেই বৃক্ষ দেখিয়ে মানুষ হত্যা করেছে এবং জনপদ ধ্বংস করেছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান ক্ষমতা ও মিডিয়ার এই হাত ধরাধরি মিথ্যাচার নতুন ঘটনা নয়, আর এবারের গাজা-ইসরাইল ঘটনায় এ ধরনের মতলবি মিথ্যাচার এটাই শেষ ছিল না।
কয়েক দিনের মাথায় ১৭ অক্টোবর রাতে গাজার একটি হাসপাতালে বোমা মেরে ৫০০ মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তী কয়েক দিনের হিসাবে নিহতের এই সংখ্যা ৮০০ পার হয়ে যায়। অথচ ১৮ই অক্টোবর, ঘটনার ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরাইলের তেলআবিবে এসে হাজির হন এবং ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণ ইসরাইল ঘটায়নি, অন্য কেউ ঘটিয়েছে। অর্থাৎ ইসরাইলি কোনো কোনো কর্মকর্তা হাসপাতাল হত্যাকাণ্ডের পর পর নিজেদের কর্তৃত্ব দাবি করে টুইট করার পর যখন বুঝেছে এ ঘটনার দায় নেওয়া ঠিক হবে না- তখন তারা বক্তব্য উল্টে দেয় এবং বলতে শুরু করে, এটি গাজার ভেতর থেকেই ফিলিস্তিনি ‘ইসলামি জিহাদ’ গোষ্ঠী ঘটিয়েছে। বাইডেন সেই উল্টো করে দেওয়া ইসরাইলি বক্তব্যকেই নিজের দাবি হিসেবে সামনে আনেন। তিনি এবার বলেন, এ হাসপাতালে বোমা বিস্ফোরণের কাজ ইসরাইলের নয়, এটি করেছে ফিলিস্তিনিরাই। নিরীহ গাজাবাসীর ওপর পরবর্তী সময়ে হামলাগুলো নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য এটাও ছিল একটা শক্ত ও মোটা মিথ্যা।
গাজা এখন রক্ত আর লাশের জনপদ। শহরের উঁচু ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপ। লাশ দাফনের মতো ফাঁকা জায়গা, লাশ ঢাকার মতো পর্যাপ্ত কাফনের কাপড় আর জানাযা-দাফনের মতো নির্বিঘ্ন সময় নেই গাজায়। হাসপাতালগুলোতে হাজার হাজার নারী-শিশু ও বেসামরিক ফিলিস্তিনি মুসলিম ক্ষতবিক্ষত মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এসবের নিয়ন্ত্রণ দখলদার ইসরাইলের হাতে। পৃথিবীর ‘বড় মুরব্বি’ আমেরিকা নৌবহর, বোমারু বিমান ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। হাসিমুখে বাইডেন ইসরাইলি নেতাদের বলেছেন, ‘আমিও একজন জায়নবাদী’। অর্থাৎ নির্বিচার হত্যা, জুলুম, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্নসঙ্গী। তিনি এই কথা বলেছেন হাসপাতাল-বিস্ফোরণ ও ৮ শতাধিক হাসপাতাল-নিবাসী বোমাদগ্ধ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর। এরপর গত ২৪-২৫ অক্টোবরের খবর সামনে এলো। এক দিনে গাজায় সবচেয়ে বেশি বোমা হামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আশ্রয়ের জায়গায়, পানি সরবরাহের জায়গায় এবং শরণার্থী শিবিরে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে।
হত্যা ও ধ্বংসের আগে ও পরে এরা মিথ্যাচার করেছে এবং করছে। মিথ্যা তো সবসময়ই খারাপ। মিথ্যা তো সবসময়ই পরিত্যাজ্য ও ধ্বংসাত্মক। কিন্তু জায়নবাদী শক্তি ও তার বড় পৃষ্ঠপোষকের মিথ্যা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মিথ্যা। একতরফা ‘যুদ্ধ’ এবং নিরীহ মানুষ হত্যার নির্বিচার অভিযানেও এরা মিথ্যাকে ব্যবহার করে মারণাস্ত্রের মতো। বৈধতার ক্ষেত্র তৈরির অজুহাতের উপলক্ষের মতো। আর এদের সঙ্গে পৃথিবীর ‘বোকা’ মানুষদের যারা তথ্য ও বোধের সেবা দিয়ে থাকে- সেই নামজাদা গণমাধ্যমগুলো এসব মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার মতো করে প্রচার করে। মিথ্যার দাবি ও আওয়াজকে বড় করে মানুষের জীবন ও জনপদের অস্তিত্বকে ক্ষুধার্ত হায়েনার গ্রাসে উঠিয়ে দেয়।এই ইহুদি-খ্রিষ্টীয় মোড়ল শক্তির মিথ্যাচারের ইতিহাস ও নজির অগণিত; সম্ভবত তাদের ইতিহাসের ওতপ্রোত অপরিহার্যতা এসব মিথ্যাচার। বদ খাসলত ও বদ কিসমতির কারণে হয়তো ভবিষ্যতেও এই অভিশাপ থেকে তারা সহজে মুক্ত হতে পারবে না।এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইরাকে হামলা এবং ইরাক ধ্বংসের আগেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে। একারণে দুনিয়ার নিরাপত্তার জন্য সে দেশের ওপর হামলা করতে হবে এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে বিচারের মাধ্যমে হত্যা করতে হবে। তাদের দাবি ও যুক্তি প্রচার হতে থাকে গণমাধ্যমে। পৃথিবীবাসী ধরে নেয়, একটি ‘ন্যায্য’ হামলাই হচ্ছে। ক্ষেত্র তৈরি হয়, হামলা হয়, লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়, সাদ্দামের ফাঁসি হয়, দেশ ধ্বংস হয়। পরে বুশ-ব্লেয়ারের পক্ষ থেকেই জানানো হয়, ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র পাওয়া যায়নি ইরাকে। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাদের মিথ্যাচার মিথ্যা হিসেবে সামনে আসে। গণমাধ্যমগুলো সেই মিথ্যার স্বীকারোক্তির কথা দুই বাক্যে উচ্চারণ করে। কোনো পর্যালোচনা-জবাবদিহি তাদের পরিবেশনায় উঠে আসে না। রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে এসে তারা একসঙ্গে মিথ্যার ডিঙি ডাঙায় তুলে নিয়ে যায়। মানবতার সঙ্গে এ এক অদ্ভুত পরিহাস, এ এক নারকীয় জুলুম। দেশ দখল করবে, লাখো মানুষ মারবে, লাখো নারী-শিশু হত্যা করবে আবার মিথ্যা দাবি করবে এবং প্রচারযন্ত্র সেই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। এভাবেই তারা চলবে এবং চলতে চাইবে। কিন্তু এভাবে কি সবসময় তারা চলতে পারবে? মিথ্যা নিজেই তো ধ্বংসশীল ও ধ্বংসাত্মক। আল্লাহতায়ালা অপকর্মের বিচার আখেরাতে করবেন। কখনো কখনো কিছু বিচার দুনিয়াতেও করেন; কিছু সময় আগে অথবা পরে। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তুমি কিছুতেই মনে করো না জালিমরা যা কিছু করে আল্লাহ সে সম্পর্কে বে-খবর।’ (সুরা ইবরাহীম (১৪) : ৪২)। [সূত্র:আল কাউসার]।
লেখক : বিশিষ্ট আলেম, সাংবাদিক ও গবেষক