পরামর্শের বরকত ও সাফল্য

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা আল্লাহতায়ালার আদেশ। নবী ও অনুসরণীয় ব্যক্তিদের কর্মপন্থা। যাদের বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, আর তারা পার¯পারিক পরামর্শক্রমে কাজ করে (সুরা শুরা : ৩৮)। পরামর্শের আলোকে কৃতকাজে আল্লাহর বরকত থাকে। ভুল ও বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। হাসান (রহ.) বলেন, আল্লাহর শপথ! পরামর্শের কারণে আল্লাহতায়ালা সেই জাতিকে শুধু অধিক সঠিক পথই দেখান (আল-জামে : ৩৯৬)। আমাদের উচিত বরকত পেতে সব কাজ পরামর্শ সাপেক্ষে করা।

কোরআনের বর্ণনায় পরামর্শ : কোরআন মানুষকে পরামর্শভিত্তিক কাজের উপদেশ দেয়। আদেশ করে। সুরা শুরায় মোমেনদের গুণাবলির বর্ণনায় এসেছে, যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামাজ কায়েম করে, পার¯পারিক পরামর্শক্রমে কাজ করে (৩৮)। সুরা আলে-ইমরানে নবীজিকে সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা বলেন- কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজেকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন (৫৯)। আল্লাহতায়ালা কর্তৃক প্রিয়নবীকে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কাজ করার আহ্বান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পরামর্শের গুরুত্ব কতটা!

নবীজি সর্বাধিক পরামর্শকারী : পরামর্শ ব্যক্তিকে লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেয়। ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখে। আনাস (রা.) বলেন যে, ইস্তেখারার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, আর পরামর্শের কারণে কেউ লজ্জিত হয় না (ফেরদাউস : ৬২৩০)। জগতের নির্ভুল ব্যক্তি নবীজি সর্বাধিক পরামর্শকারী ছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি জগতে এমন কাউকে দেখিনি, যিনি তার সাথীদের সঙ্গে নবীজির থেকে অধিক পরামর্শকারী ছিলেন (ইবনে হিব্বান : ৪৮৭২)। আমাদেরও উচিত প্রত্যেক কাজ আমানতদার, জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্পন করা।

পরামর্শ জ্ঞানীদের গুণ : সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, মানুষ তিন শ্রেণির। পূর্ণাঙ্গ, অপূর্ণাঙ্গ এবং অমানব। পূর্ণমানব, যাকে আল্লাহ পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং জ্ঞান দিয়েছেন। সে কোনো কাজের ইচ্ছা করলে জ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করে। যার কারণে সে সঠিকতার ওপরেই থাকে। অপূর্ণাঙ্গ মানব, যাকে আল্লাহ পূর্ণাঙ্গ দ্বীনএবং জ্ঞান দিয়েছেন। কিন্তু কাজের সময় সে কারো পরামর্শ নেয় না বরং বলে, আমি কার পরামর্শ নেব? ফলে সে সঠিক ও বেঠিক উভয়টি করে। আর অমানব হলো, যার দ্বীন ও জ্ঞান কোনোটাই পূর্ণাঙ্গ নয় এবং সে কখনো পরামর্শও করে না। যার কারণে সে সর্বদাই ভুল করে (আল-জামে : ৩৯৫)। ইবুন ওয়াহাব (রহ.) বলেন, পরামর্শের কারণে কেউ ধ্বংস হয়নি এবং একক কাজে কেউ সৌভাগ্যমণ্ডিতও হয়নি (আল-জামে : ৩৯৫)।

নবীজির জন্য মুসা (আ.)-এর পরামর্শ : মেরাজের রাতে নবীজি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ৫০ ওয়াক্ত নামাজসহ ফেরার পথে মুসা (আ.)-এর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ হয়। তিনি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহ আপনাকে কত ওয়াক্ত নামাজ দিয়েছেন? নবীজি বললেন, ৫০ ওয়াক্ত। এটা শুনে মুসা (আ.) নবীজিকে পরামর্শ দেন যে, আপনার উম্মত দুর্বল। তারা ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে সক্ষম হবেন না। আপনি বরং আল্লাহর কাছে ফিরে যান এবং নামাজের পরিমাণ; রাকাত সংখ্যা কমানোর আবেদন করেন। তার পরামর্শক্রমে নবীজি একাধিকবার আল্লাহর কাছে যান এবং নামাজকে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসেন এবং আল্লাহতায়ালা পাঁচে-পঞ্চাশ ওয়াক্তের সাওয়াব দেয়ার অঙ্গীকার করেন (আল-বেদায়াওয়ান-নেহায়া ৩ : ২১৫)। ইবাদতের আধিক্য এবং অল্প আমলেই অধিক সাওয়াব অর্জনের বাহ্য কারণ কিন্তু পরামর্শ।

উম্মে সালমার সঙ্গে নবীজির পরামর্শ : ষষ্ঠ হিজরিতে উমরার উদ্দেশে নবীজি হুদাইবিয়া পৌঁছেন। দূত মারফত কোরাইশদের অবগত করান যে, তিনি শুধু ওমরার উদ্দেশ্যে এসেছেন। কোরাইশরা নবীজিকে ওমরা করতে বাধা দেন, তবে নবীজির সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে রাজি হন। নবীজি সন্ধিতে রাজি হলে, কোরাইশরা এমন সব শর্তারোপ করে যেগুলো স¤পূর্ণরূপে মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ছিল। সাহাবিদের কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও নবীজি সেই সন্ধি স্থাপন সম্পন্ন করেন, সাহাবিদের কোরবানি ও মাথামুণ্ডন করতে বলেন, তারা নির্জীব হয়ে বসে থাকেন। নবীর আদেশ কার্য করে উম্মুখ ব্যক্তিরা আজ নিথর হয়ে বসে আছে। নবীজি তাদের অবস্থা দেখে তাবুতে যান। স্ত্রী উম্মে সালমা (রা.) কে তাদের অবস্থা জানালে, তিনি পরামর্শ দেন। আপনি তাবু থেকে বের হয়ে সাহাবিদের কিছু না বলে নিজের কোরবানি এবং মাথামুণ্ডন সম্পন্ন করুন। আশা করি তাতে কাজ হবে। প্রকৃতপক্ষেই, নবীজির মাথামুণ্ডন দেখে, সাহাবিরা নিজেদের কোরবানি ও মুণ্ডন সম্পন্ন করে ফেলেন (আল- বেদায়াওয়ান-নেহায়া৪ : ৩২৪)। এটাই পরামর্শের শক্তি। নারী কিংবা পুরুষ, যে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি থেকে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

মিশরের বাদশাহর পরামর্শ : ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় সব কাজ পরামর্শ সাপেক্ষে করা উচিত। এতে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। ইউসুফ (আ.) জেলখানায় বন্দিকালীন মিশরের বাদশাহ আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলে, তিনি স্বীয় সভাসদদের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে পরামর্শ ও সাহায্য চেয়েছিলেন। যার বিবরণ কোরআনে এভাবে এসেছে, বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটাতাজা গাভী- এদের সাতটি শীর্ণ গাভী খেয়ে যাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। হে পরিষদবর্গ! তোমারা আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বল, অর্থাৎ এ সম্পর্কে পরামর্শ দাও (সুরা ইউসুফ : ৪৩)। এই পরামর্শের কারণেই বাদশাহ ইউসুফ (আ.)-এর সন্ধান পান। ইউসুফ (আ.) কর্তৃক স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা জেনে, আগত দুর্ভিক্ষ রোধে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হন।

খন্দক খননে সালমান ফারসির পরামর্শ : হিজরি পঞ্চমবর্ষে ইসলামের শত্রুরা একজোট হয়ে ১০ হাজারের বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনায় আক্রমণের জন্য বের হয়। তাদের খবর সম্পর্কে অবগত হলে, আহুত যুদ্ধের প্রতিরোধ ও কর্মপন্থা নির্ণয় করতে নবীজি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন। প্রতিথযশা সাহাবি সালমান ফারসি (রা.) নবীজিকে খন্দক বা পরিখা খননের পরামর্শ দেন। নবীজি তার পরামর্শ অনুযায়ী পরিখা খনন করেন (আল-বেদায়াওয়ান-নেহায়া৪ : ১৮৬)। এর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের কাফের বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি দান করেন। আর পরিখা খননের মূলে ছিল পরামর্শ।

পরামর্শ ত্যাগ করা উচিত নয় : ছোট-বড় কোনো কাজেই পরামর্শ পরিহার করা উচিত নয়। দুনিয়াতে একমাত্র নবীজিই ছিলেন এমন ব্যক্তি যার পরামর্শের দরকার ছিল না। অথচ তিনিই প্রত্যেকটি কাজ পরামর্শ সাপেক্ষে করেছেন। তাই, অন্য কোনো ব্যক্তির জন্য একক সিদ্ধান্তে কাজ করা উচিত নয়। মারওয়ান ইবনে হাকিম (রহ.) স্বীয় ছেলেকে উপদেশের ছলে বলেছিলেন, জীবনে কখনো পরামর্শ পরিত্যাগ করবে না। যদি কেউ পরামর্শ অমুখাপেক্ষী হওয়ার যোগ্য হতেন, তবে তিনি হতেন নবীজি (আল-জামে : ৩৯৪)। তিনিই যখন পরামর্শের জন্য আদিষ্ট হয়েছেন, তখন অন্য কারো পরামর্শ ত্যাগ করার সুযোগ নেই। পরামর্শের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়। বিরোধ ও অশান্তি দূর হয়।

লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা, রংপুর