সুফি সমাচার ও তাদের অবদান
ইফতেখার জামিল
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ব্রিটিশ আগ্রাসনের আগে বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ‘ধনী-সুখী’ অঞ্চলের একটি। এক্ষেত্রে সুফিদের ভূমিকাটা ছিল অনেক বড়। পনের শতকের একজন সুফির কথা কল্পনা করুন। তার মৌলিক কাজগুলো ঠিক কী ছিল?
ক. তিনি হয়তো ময়মনসিংহের শহরতলীতে একটা খানকাহ-মাদ্রাসা নির্মাণ করতেন। মানুষকে শেখাতেন তাওহিদ-ইবাদাত-রিয়াজাত। সহজভাষায় মানুষের আত্মিক-দার্শনিক প্রশ্নের সমাধান দিতেন। মানুষ বুঝতে পারত তাদের জীবনের একটা বিশেষ মর্ম আছে, একটা বিশেষ লক্ষ্য আছে। অনেকের কাছে এই দিককে গুরুত্বহীন মনে হলেও এর তাৎপর্য অপরিসীম। আপনার যদি মনে হয়, জীবনের কোনো মর্ম নেই, ইচ্ছা-চেষ্টা-পরিশ্রমের কোনো লক্ষ্য নেই, তবে একটা জীব-জানোয়ারের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কোথায়?
খ. খানকার পাশাপাশি তারা খুলতেন লঙ্গরখানা। গরিব-বিধবা-মুসাফির-বিপদে পড়া মানুষদের খাবারের চিন্তা দূর করতেন তারা। কিছু নথিতে দেখা যায়, একেকটা লঙ্গরখানায় প্রতিবেলা হাজারখানেক মানুষ খাবার খেতে পারত। তৎকালীন জনসংখ্যা-জনমিতির হিসাব ধরলে বর্তমানের বিচারে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ হাজার মানুষের মতো। অর্থাৎ বর্তমানে ১ হাজার মানুষকে আপনার খুব বড় সংখ্যা মনে না হলেও তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এটি বর্তমানের বিচারে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের পর্যায়ে পড়বে। সংখ্যাটা কত বিপুল ধরতে পারছেন? আপনি যদি সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণির রুটি-রুজির চিন্তা দূর করতে পারেন, তাহলে একটা রাষ্ট্রের উন্নতি কীভাবে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? আজকে আপনি যাদের খাওয়াচ্ছেন, আগামীকাল তার অবস্থা ভালো হবে। সে আপনার লঙ্গরখানায় দান করবে। মনে রাখবেন, একজন মানুষ যতটুকু খেতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন করতে পারে। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা জরুরি। তৎকালীন সুফিরা লঙ্গরখানায় হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ভেদ করতেন না। হিন্দু মানুষটাও কিন্তু আল্লাহর বান্দা; যদি কুকুর-বিড়ালকে অভুক্ত রাখলে গোনাহ হতে পারে, তবে হিন্দুকে ‘বঞ্চিত’ করলে কেন গোনাহ হবে না?
গ. প্রতিটা দরবারে লঙ্গরখানার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। অনেক সুফি-সাধক দরবারের পাশে উদ্যান-বাগান নির্মাণ করতেন। আপনার কাছে উদ্যান-বাগানকে তাৎপর্যহীন মনে হলেও সুফি-দরবেশরা জানতেন, জীবনে সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আল্লাহ মানুষকে শুধু ধৈর্য ধরতেই নির্দেশ দেননি, ‘সুন্দরভাবে’ ধৈর্য ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে সৌন্দর্যের স্থান অনেক ব্যাপক : ব্যবস্থাপনা-আদব-আখলাক-হেকমত-স্থাপত্য এসবই সৌন্দর্যের অংশ। খানকার পাশে উদ্যান-বাগান থাকলে হয়তো বিকেলে আশপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে লোকজন এখানে বেড়াতে আসবে। উদ্যান-বাগান মানে; কিন্তু শুধু ফুল-ফল-লতাপাতা নয়, আপনি এমন ফল-ফুল দেখছেন, যেগুলো আপনাদের গ্রামে সহজে দেখা যায় না। আপনাদের গ্রামে শুধু বনজ আম-জাম পাওয়া যায়, সুফি-উদ্যানে এসে পেলেন ‘হাড়িভাঙ্গা’ আমের স্বাদ। সন্ধ্যায় বাগানে বসল কবিতা-সাহিত্যের আসর। আপনি যদি সুফিদের খানকা-দরবার কল্পনার সময় এসব সৌন্দর্যের কথা ভাবতে না পারেন, তবে কখনোই তাদের প্রভাবের রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন না।
ঘ. প্রতিজন সুফিই ছিলেন সামরিক সক্ষমতার অধিকারী। খানকা-লঙ্গরখানা-বাগান কি সমাজের সবাই ‘প্রশ্ন’ ছাড়া মেনে নিত? বণিক-মহাজনদের স্বার্থে আঘাত লাগা সত্ত্বেও তারা সবকিছু চুপচাপ মেনে নিত ভাবলে অনেক বড় ভুল হবে। প্রত্যেক সুফির থাকত ‘পার্সোনাল মিলিশিয়া।’ তারা সবসময় ছোটোখাটো বিবাদ-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। মুরিদ-ভক্তদের জালেমদের থেকে রক্ষা করতেন। অনেক পীরের নামেই দেখবেন, শহীদ-গাজী প্রযুক্ত। এর থেকে সামরিক প্রস্তুতির বিষয়টি খুবই পরিষ্কারভাবে ধরা যায়।
পুনশ্চ :
ক. বর্তমানে বাঙালি সুফিদের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, তারা ‘লিবারেল’ ছিলেন। মূলত ধর্মকে ব্যক্তির মধ্যে আটকে রেখে পুঁজিবাদী-জালেমি ব্যবস্থাকে প্রশ্নহীন রাখতেই এমন অপচেষ্টা চালানো হয়। সুফিরা মোটেই ‘নিরীহ-নির্বিরোধী’ ছিলেন না। তারা যে কোন সামরিক-রাজনৈতিক হুমকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। সাহিত্য-অর্থনীতি-দর্শন-রাজনীতিতে ব্যাপক ইন্টারভেনশন করতে সক্ষম ছিলেন।
খ. পাশাপাশি ‘সালাফি’ ধারার অনেকে সুফিদেরকে ‘ভ্রান্ত-অশিক্ষিত’ হিসেবে দেখেন, এটিও অনেক বিপদজনক। মনে রাখবেন, সুফিরা বৃহত্তর সিলসিলা-নসবের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতেন। বাংলা অঞ্চলের সুফিদের অনেক পীর ভাই হয়তো উত্তর ভারত-লাহোর-বুখারা-বাগদাদে বাস করতেন। বাংলা অঞ্চলের কোনো সুফি বিভ্রান্তি ছড়ালে বাগদাদ-উত্তর ভারতের সুফিরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে রাখতেন। অর্থাৎ সুফিদের ‘স্বাধীন-প্রশ্নহীন’ মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
গ. সব সুফি-দরবেশের মধ্যে উল্লেখিত চার বৈশিষ্ট্য সমানভাবে পাওয়া যেত, এটা বলার সুযোগ নেই। তবে সবার মধ্যেই কমবেশি হারে এসব বৈশিষ্ট্যগুলো থাকত। কারো মধ্যে কোনো অংশ বেশি থাকবে, কারো মধ্যে কম; এটা যে কোনো ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সত্য। সুফিদের নির্দোষ-নিষ্পাপ মনে করারও কোনো সুযোগ নেই, প্রয়োজনও নেই। একমাত্র নবী-রাসুলরাই নির্দোষ হতে পারেন।
লেখক : আলেম ও গবেষক