বাংলা ভাষা-সাহিত্যে মুসলমানের অবদান
মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ খান
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীর প্রত্যেক সৃষ্টি জীবের মনের ভাব প্রকাশের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষাশৈলী। আর তন্মধ্যে মানুষের ভাষায় রয়েছে আলাদা এক বৈচিত্র্য। কেন না, সৃষ্টি জীবের মধ্যে শুধু মানুষের ভাষাই যুগে যুগে পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়। আর মানুষের এই ভিন্ন ভাষাশৈলী ও বিভিন্ন বৈচিত্র্য আল্লাহর এক অন্যতম কুদরতি নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তার নিদর্শনাবলির অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণ বৈচিত্র্য; নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা রূম : ২২)।
পৃথীবীজুড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভাষা রয়েছে। তন্মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম হিসেবে বিবেচ্য। কারণ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বপ্রথম বাঙালি জাতিই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। তাই ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলা ভাষার সূচনাকাল : পৃথিবীর সাড়ে ৩ হাজার ভাষা শতাব্দীকাল থেকে শতাব্দীকাল পরিবর্তন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ঠিক তেমনি বাংলাভাষাও পরিবর্তিত। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন ‘বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে’। বাংলা ভাষা অন্তত হাজার বছরের পুরোনো বিভিন্ন ভাষা থেকে নানা পর্যায়ে পরিবর্তনের পরে বর্তমান আধুনিক রূপে এসেছে। এ দেশে আর্যদের আগমনের আগে মানুষ কোন ভাষায় কথা বলত, তার সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি। তবে এতটুকু জানা যায় যে, বাংলা ভাষা প্রচলনের আগে এ দেশের মানুষরা ‘অসুর’ ভাষাভাষী ছিল।
তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, ‘বাংলা ভাষা পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দ থেকে দশম খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে সৃষ্ট’। মূলত বাংলাভাষার প্রচলন বৌদ্ধ আমল থেকেই শুরু হয়, পরবর্তীতে পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তা ভাষা হিসেবে পরিপূর্ণ রূপধারণ করে। এমনকি পাল রাজাদের রাজদরবারে বাংলাভাষা ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। তাই সে যুগের মানুষ খুব দ্রুতই বাঙালি সাংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। আর দশম শতকে এসে বাংলা ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসের সূচনা হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)।
বাংলা ভাষায় মুসলমানের অবদান : বৌদ্ধ ও পাল রাজাদের আমলে এদেশে বাংলা ভাষার বেশ প্রচলন ও চর্চা হয়েছিল। কিন্তু ১০৭০ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজাদের হটিয়ে হিন্দু সেন রাজারা ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশ শাসন করে। হিন্দু সেন রাজাদের আমলে বাংলা ভাষায় নেমে আসে এক মহাপ্রলয়! এমনকি রাজপুরুষদের চাপে পড়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ফতোয়া জারি করে ‘অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ যে মানবরচিত বাংলা ভাষায় শ্রবণ করবে, সে রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (অধ্যাপক আবদুল গফুর, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলমান, পৃ. ৮৯) মানুষ বঞ্চিত হয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা থেকে। বর্তমানে আমরা যে ভাষা নিয়ে গর্ব করি, তার সূচনা হয়েছিল মুসলিম শাসন আমলে। যখন মানুষ বাংলা সাহিত্যচর্চা ছেড়ে দিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বাংলাকে ইতরে ভাষা বলে গালি দিচ্ছিল, তখন এ দেশে আগমন করে তরুণ তুর্কী ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী! ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন : ‘মুসলমান আগমনের আগে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর মতো দ্বীনহীন বেশে পল্লি কুঠিরে বাস করিতেছিল। ‘বাঙলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের আগে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল।
নাপিতেরা নস্যাদার থেকে নস্য গ্রহণ করে শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করতে ছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা ‘পত্রাধার তৈল’ এই লইয়া ঘোর বিচারের প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের কাছে অপাঙক্তেয় ছিল তেমনি ঘৃণা, অনাদার ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।’ (সূত্র : শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন (বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব) ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা দেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ভাগ্যাকাশে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল শুকতারা। মুসলমান শাসক হুসেন শাহ, গৌড়ের শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটরা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন।
এ সব ইতিহাস সামনে রেখে শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, ‘মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি (অতিরঞ্জন) হয় না। বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।’ (সূত্র : শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন (বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব)। মুসলমান শাসকগণের উদার মানসিকতায় বাংলা সাহিত্যে যে নবজীবনের সূচনা হয়েছিল, সে সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বাংলার মুসলমানদের যতখানি হাত রহিয়াছে হিন্দুদের ততখানি নহে। এদেশের হিন্দুগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাতা বটে; কিন্তু তাহার আশৈশব লালনপালন ও রক্ষাকর্তা বাংলার মুসলমান। স্বীকার করি, মুসলমান না হইলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মনোরম বনফুলের ন্যায় পল্লির কৃষক কণ্ঠেই ফুঁটিয়া উঠিত ও বিলীন হইত, কিন্তু তাহা জগতকে মুগ্ধ করিবার জন্য উপবনের মুখ দেখিতে পাইত না বা ভদ্র সমাজে সমাদৃত হইত না।’ মুসলিম সুলতান ও অমাত্যগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় বেড়া-জাল ছিন্ন করে হিন্দু-মুসলিম উভয় কবিদের মিলিত প্রচেষ্টায় এদেশে শুরু হয় সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চা। মধ্যযুগের এ সাহিত্যচর্চার ধারা ভারত উপমহাদেশ, পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশেও বিদ্যমান।
লেখক : শিক্ষক