ফিলিস্তিনে ইহুদি শাসন : খ্রিষ্টপূর্ব ১৩ শতকে ইসরাইলিরা এ অঞ্চলে প্রবেশ শুরু করে। স্থানীয়দের পরাজিত ও হত্যা করে ইহুদিরা। গঠন করে রাষ্ট্র। প্রথম রাজা হন কিং সল বা তালুত। তালুত লড়াই করেছিলেন আমালিকদের বিরুদ্ধে। তাদের সেনাপতি গোলিয়াথকে হত্যা করেন বেথেলহেমের জেসির ছোট ছেলে ডেভিড। সলের পরে রাজা ডেভিড জেরুসালেম শাসন করেন এবং একে ইসরাইল রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাথমিকভাবে, দাউদ শুধু ইয়াহুদা গোত্রের রাজা ছিলেন এবং ইবরান থেকে শাসন করেছিলেন; কিন্তু সাড়ে ৭ বছর পর, অন্যান্য বনি ইসরাইলীয় উপজাতি তাকে তাদের রাজা হিসেবে মেনে নেয়। কিং সলোমন হন ডেভিডের পরবর্তী রাজা। তার নেতৃত্বে ইসরাইলি রাষ্ট্র চূড়ান্ত বিকাশ ও প্রতিপত্তি লাভ করে। তালমুদ অনুসারে সলোমন ইহুদি ধর্মের ৪৮ জন নবীর অন্যতম। কিং সলোমনের মৃত্যুর পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৯৩০ অব্দে তার পুত্র রেহোবামের সময় ইসরাইলি রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তরের অংশ ইসরাইল, দক্ষিণের অংশ জুদাহ।
উভয় রাজ্যই প্রতিবেশীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ছিল জর্জরিত। আসিরীয় এবং ব্যাবিলনীয়দের সঙ্গে চলছিল ধারাবাহিক উত্তেজনা।
জেরুজালেমে আক্রমণ ও লুণ্ঠন : প্রতিবেশী রাজ্যগুলো সুযোগ পেলেই চড়াও হতো ইসরাইলি রাজ্যের উপর। শলোমনের মন্দির বেশ কয়েকবার লুণ্ঠিত হয়েছিল। রহবিয়ামের রাজত্বের পঞ্চম বছরে (সাধারণত ৯২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) মিশরীয় ফারাও শিশক (ইতিবাচকভাবে প্রথম শোশেঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত) মন্দির ও রাজার বাড়ির ধন-সম্পদ আর শলোমনের তৈরি সোনার ঢালগুলো নিয়ে যায়; রহবিয়াম সেগুলোকে পিতলের ঢাল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে। এক শতাব্দী পরে ইসরাইলের উত্তর রাজ্যের রাজা যিহোয়াশ জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রাচীরের একটি অংশ ভেঙে দেন এবং মন্দির ও প্রাসাদের ধন-সম্পদ নিয়ে যান।
অন্য একটি জটিল সন্ধিক্ষণে হিষ্কিয় মন্দিরের দরজা এবং দরজার চৌকাঠ থেকে সোনা কেটে ফেলেছিলেন এবং এগুলো রাজা সেনাখেরিবকে দিয়েছিলেন। বাইবেলে আছে ব্যাবিলনীয় রাজা যিহোয়াখিনের কথা। তিনি তার সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালে ৫৯৮ খ্রিষ্টপূর্বে জেরুজালেম আক্রমণ করেছিলেন। এ সময় নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার দ্বারা মন্দিরটি লুণ্ঠিত হয়।
প্রথম ধ্বংস যজ্ঞ, প্রথম নির্বাসন : খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে নেবুচাদনেজার আবারো জেরুজালেম ঘেরাও করেন। ৩০ মাস পরে অবশেষে ৫৮৭/৬ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে শহরের প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬/৭ অব্দে শহরটি তার সেনাবাহিনীর হাতে আসে। ১ মাস পরে তিনি কমান্ডার নেবুজারাদানকে পাঠান শহরটিকে পুড়িয়ে ফেলা এবং ধ্বংস করার জন্য। বাইবেল জানায়, ‘সে ইয়াহওয়েহের মন্দির, রাজপ্রাসাদ ও জেরুজালেমের সব বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।’ লুণ্ঠনযোগ্য সব কিছু তখন সরিয়ে নিয়ে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক জোসেফাসের মতে মন্দিরটি পোড়ানো হয় নির্মিত হওয়ার ৪৭০ বছর ৬ মাস, ১০ দিন পরে।
ব্যাবিলনীয়রা জীবিত ইহুদিদের বিতাড়িত করে ফিলিস্তিন থেকে। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের স্রষ্টা নেবুচাঁদের হাত দিয়েই শুরু হলো ধারাবাহিক উদ্বাস্ত ইহুদি সমস্যা। বাইবেলে দানিয়েলের পুস্তকে রাজা নেবুর আলোচনা রয়েছে। নেবুর হাতে উচ্ছেদ হবার ৫০ বছর পরে পার্শিয়ান রাজা সাইরাস এ অঞ্চল জয় করেন, ইহুদিদের আবারো জেরুজালেমে ফেরত আসতে দেন এবং ৫১৬ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে নতুন করে মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি ৫৮৫ বছর টিকে ছিল। রাজা হেরোডের আমলে দ্বিতীয় মন্দিরটি নতুন করে সংস্কার করা হয় এবং সম্প্রসারণ করা হয়। এর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল আনুমানিক-৫১৬ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে আনুমানিক-৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
বিভক্তি ও যিশু বিরোধিতা : খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেন। এ অঞ্চলে হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ সালে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর, ফিলিস্তিন টলেমি এবং পরে সেলিউসিডদের নিয়ন্ত্রণে আসে। গ্রিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ইহুদি ধর্ম বদলাতে থাকে। নতুন শাখা তৈরি হয়। যাদের বলা হতো হেলেনিস্টিক ইহুদি। গ্রিক সংস্কৃতির অনুসারী এই ধারাকে পথভ্রষ্ট মনে করা হতো।
খ্রিষ্টপূর্ব-৬৩ অব্দে জেরুজালেম দখল করেন রোমান জেনারেল পম্পেই। একে রোমের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেন। রোমান সংসদ হেরোড দ্য গ্রেটকে বানায় এ অঞ্চলের রাজা। ইহুদিদের প্রতি সদয় ছিলেন তিনি।
কিন্তু তখন ইহুদিদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের চরম দুর্দিন। তাদের সংশোধন ও পথনির্দেশের জন্য আগমন করলেন যিশু খ্রিষ্ট। তিনি ইহুদি র্যাবাইদের দুর্নীতির প্রতিবাদ করেন। একত্ববাদের শিক্ষা দেন। ইহুদিরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। রোমান রাজাকে লেলিয়ে দিল তার বিরুদ্ধে। ইহুদি বিচারকরা বিচারের নামে তার হত্যার আয়োজন করে। খ্রিষ্ট্রীয় বিশ্বাস মতে এরপর পন্থিয় পিলাতের আদেশে যীশুকে ক্রুশে মেরে ফেলা হলো।
চূড়ান্ত উচ্ছেদ : ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে যিশু খ্রিষ্ট ঘোষণা করেন- জেরুজালেম আসন্ন এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। তিনি বলেন : ‘তোমার উপরে এমন সময় উপস্থিত হবে, যে সময়ে তোমার শত্রুরা তোমার চারধারে জাঙ্গাল বাঁধবে, তোমাকে বেষ্টন করবে, তোমাকে চারদিক থেকে অবরোধ করবে এবং তোমাকে ও তোমার মধ্যবর্তী অনুসারীদের ভূমিসাৎ করবে, তোমার মধ্যে পাথরের উপর পাথর থাকতে দেবে না।’
যিশুর কথা কি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল? তা হয়েছিল রোমানদের দ্বারা। ৩০ বছর ধরে ইহুদি রাজ্যের সঙ্গে রোমানদের দ্বন্দ্ব ছিল চলমান। ৬৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সেনাপতি গেসিয়াস ফ্লোরাস মন্দিরের কোষাগার থেকে তহবিল বাজেয়াপ্ত করলে ইহুদিরা স্থানীয় রোমীয় সৈন্যদের হত্যা করে এবং রোমের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এর প্রায় ৩ মাস পরে সেস্টিয়াস গ্যালাসের নেতৃত্বে ৩০,০০০-এর অধিক রোমীয় সৈন্য বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে আসে। ইহুদিদের পরাজিত করতে পারেনি তারা। যখন শহর থেকে ফিরে যাচ্ছিল, তখন ইহুদি বিদ্রোহীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় ও তাদের পিছু ধাওয়া করে। যীশুর অনুসারিরা এই পরিস্থিতিতে জর্দান নদীর অপর তীরে পাহাড়ে পালিয়ে যায়।
এরপর রোমানরা বড় অভিযান পরিচালনা করে। ৭০ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে রোমান সেনাপতি টাইটাস ইহুদি রাষ্ট্রে আক্রমণ করেন। সৈন্যবাহিনীকে তিনি গ্রামাঞ্চল থেকে বড় বড় গাছ কাটার নির্দেশ দেন। জেরুজালেমের চারপাশে জাঙ্গাল বা খুঁটি স্থাপন করে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ (৪.৫ মাইল) প্রাচীর নির্মাণে গাছগুলোকে ব্যবহার করা হয়। ৩ মাসের মধ্যে রোমীয় সৈন্যরা নগর ও এর মধ্যস্থিত মন্দিরে লুটপাট চালায় এবং পুড়িয়ে দেয়। তারা এমনভাবে মন্দির ধ্বংস করে যে, একটা পাথরের উপর আরেকটা পাথর অবশিষ্ট ছিল না। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী জেরুজালেম ও বাকি অঞ্চলে কমপক্ষে আড়াই থেকে পাঁচ লাখ ইহুদি প্রাণ হারিয়েছিল।’
শহরের সম্ভাব্য সব কিছুই তারা ধ্বংস করে। টেম্পল মাউন্ট হয়ে উঠে আবর্জনার স্তূপ। দেভিরের পশ্চিম প্রাচীর ছাড়া শুধু টেম্পল প্ল্যাটফর্মকে ঠেকা দেওয়া বিশাল প্রাচীরগুলোই ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল। টেম্পল ভাঙার কাজ শেষ হলে টাইটাসের সৈন্যরা আপার সিটির রাজসিক বাড়িগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু করল, হেরডের সুন্দর প্রাসাদটি ভূপাতিত করা হলো। প্রত্নতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন, রোমান সৈন্যরা তাদের কাজ সম্পন্ন করতে খুবই নিষ্ঠাবান আর নির্মম ছিল। বাড়িগুলো ধসিয়ে দেওয়া ও আবর্জনার নিচে চাপা পড়ার পর সেগুলো আর কখনো পরিষ্কার করা হয়নি। জেরুজালেমে আর কখনো লোক বসতি হবে, এমনটা বিশ্বাস করতে মুসাফিরদের কষ্ট হতো।
তারা ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করে, নিষিদ্ধ করে তাদের। তাদের উদ্বাস্তুতে পরিণত করে। ‘আমরা কিতাবের মধ্যে বনি ইসরাইলকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, তোমরা জমিনে দুইবার বিশৃঙ্খলা ও ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে এবং বড় ধরনের বাড়াবাড়ি করবে। যখন ওই দুই ফেতনার প্রথমটার সময়-কাল উপস্থিত হবে, তখন আমরা তোমাদের উপর আমাদের এমন জঙ্গি শক্তিশালী লোককে বিজয়ী করব, যারা তোমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে। এটা এমন এক ওয়াদা ও ভবিষ্যদ্বাণী, যা অবশ্যই সংঘটিত হবে।’
ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দা কানানিরা এই সব নিপীড়ন ও নির্বাসন থেকে রক্ষা পায়। খ্রিষ্টধর্ম বিকশিত হলে তারা একে গ্রহণ করে ধীরে ধীরে। (চলবে)
তথ্যসূত্র : ১. স্যামুয়েল, ৫ : ৬-৭ : ৬ ২. Mandel, David. Who’s Who in the Jewish Bible. Jewish Publication Society, 1 Jan 2010, p. 85 3. Book of Kings: 1 Kings 1-11; Books of Chronicles: 1 Chronicles 28-29, 2 Chronicles 1-9 4. Rashi, to Megillah, 14a 5. ১ রাজাবলি, 14 : 25; 2 eskvewj, 12 : 1-12 6. ২ রাজাবলি, 14 : 13-14 7. ২ রাজাবলি, 18 : 15-16 8. রাজাবলি, 24 : 13 9.রাজাবলি, 25 : 9 10. ২ রাজাবলি, 25 : 13-17 11.De Souza, P., Piracy in the Graeco-Roman World, Cambridge University Press, 2002. 12. Sanders, Ed P. (1993). The Historical Figure of Jesus. Allen Lane Penguin Press.P. 11 13. Allison, Dale C.; Crossan, John D.. The Historical Jesus in Context. Princeton Univ Press.P. 4, 14.লূক, ১৯ : ৪৩, ৪৪, ১৫. মথি, ২৪ : ১৫, ১৬. ১৬. লূক, ১৯ : ৪৩, ৪৪ ১৭. কারেন আর্মস্ট্রং : জেরুজালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইথ, ২. ইসরাইল, হাসান শরীফ অনূদিত, অন্যধারা, বাংলাবাজার ঢাকা. ১৮. সুরা ইসরা : ৪-৫।