আলেমরা দুনিয়াতে নবীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। নবীদের অবর্তমানে তাদের সব কাজ আঞ্জাম দেন। নবী (সা.) বলেছেন, আলেমরা নবীদের ওয়ারিস (আবু দাউদ : ৩৬৪১)। তারা নবীদের ওয়ারিস জ্ঞানে, গুণে, আদবে, আখলাকে। ভদ্রতায়, শিষ্টাচারে, আচার, আচরণে, ন্যায়, ইনসাফে। মোদ্দাকথা, নবীরা ধর্মীয়, সমাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যত ধরনের কাজ করেছেন সব ক্ষেত্রেই আলেমরা নবীদের ওয়ারিস। নবীরা যত ধরনের কাজ করেছেন, তাদের অনুপস্থিতিতে আলেমরা সবগুলো পরিচালনা করবেন। সভ্যসমাজ বিনির্মাণে নবীরা যেসব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, আলেমরাও সেই সব ক্ষেত্রে অবদান রাখবেন। সভ্যসমাজ বিনির্মাণে আলেমদের ত্যাগ ও অবদান তুলে ধরা হলো-
আদর্শ জাতি গঠন : পরিশুদ্ধ, নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ জাতি গঠনে আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের নৈতিকতা ও শুদ্ধতার শিক্ষা, আদর্শ জাতিগঠন ও সমাজ বিনির্মাণে মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। আল্লাহ বলেন, তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতগুলো, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন, কেতাব ও হেকমত (সুরা জুমআ : ২)। নবীজির অনুপস্থিতিতে এই কাজটি আলেমরা করে থাকেন। মসজিদের মিম্বারে, ওয়াজের ময়দানে, দরবারে, খানকায়, সেমিনার ও সেম্পজিয়ামে জনসাধারণের জন্য নসিহতমূলক বক্তৃতায় এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তাদের সঞ্জীবনী আলোচনা ছাত্রদের নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ ব্যক্তি হতে আত্মার খোরাক হিসাবে কাজ করে।
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ : ভালো কাজে আদেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধ করা সব মানুষের নৈতিক এবং ঈমানী দায়িত্ব হলেও এই কাজ পূর্ণাঙ্গ নিষ্ঠার সঙ্গে আলেমরাই পালন করেন। আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে, অন্যায় কাজ থেকে (সুরা আলে ইমরান : ১০৪)। আর করবেন-ই না বা কেন? তাদের প্রতি মহান আল্লাহর হুকুম রয়েছে যে, আলেমরাই জাতিকে সতর্ক করবেন। তাদের ভালো-মন্দ বোঝাবেন। সঠিক পথ দেখাবেন। আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সতর্ক করবে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে আসবে, যেন তারা বাঁচতে পারে (সুরা তাওবাহ : ১২২)।
শিক্ষাদানে আত্মত্যাগ : মুসলিম জাতিকে শিক্ষিত করতে যুগযুগ ধরে আলেমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। আমরা যদি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে তাকাই, তাহলে দ্বিধাহীন চিত্তে এই কথা স্বীকার করব যে, গোটা দেশে বিশেষত গরিব-অসহায় ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা আলেমদের দ্বারাই সাধিত হচ্ছে। তারা তাদের ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। নবী (সা.)-এর বিদায় হজের সেই আদেশকে কার্যকর করছেন। তিনি বলেছিলেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দেও (বোখারি : ৩৪৬১)। নবীজির বাণীকে পৌঁছানোর মাধ্যমে তারা সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন।
জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ : প্রত্যেক আলেম তার গোটা জীবনকে কোনো না কোনো জনসেবামূলক কাজে উৎসর্গ করেন। কিন্তু তারা সেই সেবাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেন না বা করতে চান না। কারণ তারা জনসেবা করেন ইবাদত হিসেবে। আর মানুষ দেখানো ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। রাসুল (সা.) বলেছেন, দুনিয়াবাসীর ওপর অনুগ্রহ কর, তাহলে আসমানের অধিপতি তোমার ওপর অনুগ্রহ করবেন (আবু দাউদ : ৪৯৪১)। জনসেবায় তারা রাসুলের এই কথাকে মূলনীতি মেনে চলেন। সেবার দ্বারা মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করেন; কিন্তু সেটাকে প্রকাশ করেন না।
নৈতিকতার ভিত তৈরি : ধর্মই মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। আর ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী আলেমরা সেই শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের নৈতিকতার ভিত মজবুত করেন। আলেমরা সমাজকে শিক্ষা দেন, সদা সত্য কথা বলতে এবং মিথ্যা পরিহার করতে। নবীজি বলেছেন, সত্য আত্মার জন্য শান্তিদায়ক আর মিথ্যা অশান্তকারক (তিরমিজি : ২৫১৭)। সতর্ক করেন মানুষকে নীতিনৈতিকতার পতন ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে যেন তারা বেঁচে থাকতে পারেন। সুদ, ঘুষ ও সব ধরনের ধোঁকা প্রতারণা থেকে বিরত থাকতে নসিহত পেশ করেন। উৎসাহিত করেন অন্যকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, কে সেই ব্যক্তি যে, আল্লাহকে (গরিব, অসহায়দের) উত্তম ঋণ দেবে, এরপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন (সুরা হাদিদ : ১১)।
দেশ রক্ষায় আলেম সমাজ : নবীজি বলেছেন, দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ (সাখাবি : ৯০২)। তাই আলেমদের হৃদয় সদা-সর্বদা দেশ প্রেমে মজে থাকে। প্রকৃত আলেম কখনো দেশবিরোধী কাজে জড়াতে পারেন না বরং তারা দেশ রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত থাকেন। যেমন তারা জীবন দিয়েছেন ৪৭-এর ইংরেজ খেদাও অন্দোলনে। একাত্তরে জীবন দিয়েছেন স্বজাতির জালেমদের বিরুদ্ধে। জাতিকে মুক্ত করেছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। আলেমরা সর্বদা জাতির নিরাপত্তার জন্য সজাগ থাকেন। সজাগ থাকেন জাতির জীবন ও ঈমান রক্ষার জন্য।
অপতৎপরতা রোধ : সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে। অপরাধী ও কুচক্রি যারা সর্বদা সমাজে ফাসাদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে থাকে; কিন্তু নিজেদের নিরাপরাধ ও শান্তিকামী বলে প্রকাশ করে। আল্লাহর ভাষায়- যখন তাদের বলা হয়, দুনিয়াতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তারা বলে, আমরাই মীমাংসাকারী (সুরা বাকারা : ১১)। আলেমরা এমন কুচক্রীদের ব্যাপারে সমাজকে সচেতন করেন। অসৎ লোকদের অপতৎপরতা থেকে সমাজকে রক্ষা করতে আলেমরা সর্বক্ষণ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন। মসজিদের মিম্বারে মিম্বারে জোড়াল আওয়াজ তুলে অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের জনসাধারণকে সতর্ক করেন।
রাজনীতিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা : রাজনীতি আমাদের সমাজ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নোংড়া লোকেদের আনাগোনায় রাজনীতির মাঠ কলুষিত হয়। রাজনীতিকে নববী আদর্শে ফিরে নিতে এদেশের কিছু- আলেম নিরলসভাবে কাজ করছেন। চেষ্টা করেছেন স্বচ্ছ রাজনীতি করতে এবং দেশের মানুষকে ন্যায় ইনসাফের সুফল পাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে। মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মুফতি আমিনী (রহ.) প্রমুখ বাংলার রাজনীতির মাঠে ইনসাফ কায়েমের চেষ্টা করেছেন আমরণ।
বিধর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা : ইসলাম মুসলমানদের অধিকারের পাশাপাশি অন্যান্য সব ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। আর ইসলামের এই বিধান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আলেমরা। কোথাও কোনো বিধর্মী লাঞ্ছিত বা অপদস্ত হলে আলেমরা তার বিরোধিতা করেন। ইসলাম কারো প্রতি অন্যায়-অবিচার করে না এবং জুলুমণ্ডঅত্যাচারকে সাপোর্টও করে না। নবী (সা.) বলেছেন, জুলুম কেয়ামতে অন্ধকারে থাকবে (মুসলিম : ২৫৭৮)। তাই যখন কোথাও কোনো জুলুম-অত্যাচার হয়, আলেমরা সেটার ব্যাপারে সোচ্চার হন। মানুষকে সতর্ক করেন, জুলুম, অন্যায় ও অবিচার থেকে বিরত থাকার জন্য।
কিতাব ও হেকমতের পাঠদান : আলেমরা সমাজকে ঐশী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। নবী (সা.)-এর উপর যে শিক্ষার দায়িত্ব এসেছিল, তার ইন্তেকালের পর আলেমরা সেই গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন। জাতিকে আসমানি শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। আল্লাহ বলেন, তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতগুলো, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কেতাব ও হেকমত (সুরা জুমুআ : ২)। আর যে জাতি আসমানি শিক্ষায় শিক্ষিত তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠজাতি। তাই, বলা যায়- আলেমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
লেখক : শিক্ষা পরিচালক- ভরসা মাদ্রাসা, রংপুর।