ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিনের জীবনী (৩)

ইসলামের নিরাপত্তায় ফিলিস্তিন

মুসা আল হাফিজ
ইসলামের নিরাপত্তায় ফিলিস্তিন

৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ইয়ারমুকের যুদ্ধ হয়। এটি ছিল এশিয়ায় রোমকদের ভাগ্যনির্ধারণী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের সুরক্ষিত দুর্গগুলো মুসলমানের হাতে চলে আসে। বায়তুল মাকদিস বিজয়ে বিলম্ব করা হয়। কারণ রক্তপাত ছাড়াই বিজয়ের পন্থা তালাশ করা হচ্ছিল। শহরটি অবরোধ করা হলো এবং নগরবাসী বুঝতে পারল প্রতিরোধের চেয়ে সন্ধি উত্তম। নগরীর নেতারা চাইলেন স্বয়ং খলিফা যদি আসেন, সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হবে।

৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ওমর (রা.) এলেন বায়তুল মাকদিসে। শহরের খ্রিষ্টানদের প্রধান ও বাইজান্টাইন সরকারের প্রতিনিধি সোফরোনিয়াসকে তিনি নিরাপত্তাপত্র দেন। যা সেখানকার নাগরিকদের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, উপাসনালয় ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করে।

চুক্তির ৩ দিনের মধ্যে স্থানীয়রা রোমান সৈন্যদের শহর থেকে বের করে দেয়। রোমানরা ইহুদিদের পবিত্র পাথরকে ময়লা দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। জায়গাটিকে ভাগাড়ে পরিণত করেছিল। ওমর (রা.) পবিত্র সেই পাথর তালাশ করছিলেন। তোরাহ বিশেষজ্ঞ কাব আহবার পাথরের স্থান নির্দেশ করলেন। ওমর (রা.) নিজেই পাথরের জায়গা থেকে ময়লা-আবর্জনা সাফ করলেন। নিজের চাদর বিছিয়ে তিনি ময়লা সরান।

এরপর ওমর (রা.) সাখরা বা প্রস্তরটিলা ও বোরাক বাঁধার স্থানটির কাছে মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি এমনভাবে বানানো হয়, যাতে ইহুদিদের উপাসনাস্থলে কোনো বিঘ্ন তৈরি না হয়।

উমাইয়া শাসনামলে খলিফা আবদুল মালেক বিন মারওয়ান দামেস্কের সঙ্গে সঙ্গে জেরুজালেমেও খেলাফতের বাইয়াত নেন এবং শহর পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি ৬৮৫-৮৯ খ্রিষ্টাব্দ তথা ৭৩ থেকে ৮৬ হিজরির মধ্যে মসজিদে সাখরার পুনঃনির্মাণ করেন এবং নতুন করে মসজিদে আকসা তৈরির জন্য মসজিদে আকসার দেয়ালঘেরা সব অংশ অন্তর্ভুক্ত করেন।

৬৩৮ থেকে ১০৯৯ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০০ বছর মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল ফিলিস্তিন। কোনো রক্তপাত, উপাসনালয় ধ্বংস কিংবা জাতিগত নিপীড়নের কোনো ঘটনা ঘটেনি তখন। অথচ মুসলিম বিজয়ের মাত্র ৩০ বছর আগে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরু জেরুজালেমে ভয়াবহ গণহত্যা চালান। ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম জয় করে সব গীর্জা ধ্বংস করেন এবং শহরের ৯০ হাজার খ্রিষ্টানকে হত্যা করেন।

ক্রুসেডারদের তাণ্ডব : মুসলিমদের হাত থেকে জেরুজালেম স্বাধীন করার জন্য ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পোপ দ্বিতীয় আরবান ক্রুসেড ঘোষণা করলেন। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই, মোতাবেক ২৩ শাবান ৪৯২ হিজরি, খ্রিষ্টান, সেনাপতি গডফ্রে ডিবো ইউনের নেতৃত্বে ক্রুসেড বাহিনী জেরুজালেমের বাব আস সাহেরা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে এবং ৪০ দিন পর্যন্ত শহর অবরোধ করে রাখে। শেষ অবধি শহরটির পতন হয়। ক্রুসেডারগণ ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় মেতে ওঠে। ঝড়ের মতো শহরে প্রবেশ করে নৃশংস হত্যালীলা চালায়। তাদের হাত থেকে নারী-শিশু বা বৃদ্ধ কেউ রক্ষা পায়নি। শহরের পথেঘাটে, সর্বত্র মানুষের কাটা হাত-পা মাথা স্তূপাকারে পড়ে ছিল।

পরের দিন সকালে তারা মসজিদে আকসায় ইবাদত ও আত্মরক্ষার জন্য অবস্থানরত মানুষের ওপর মৃত্যুতাণ্ডব চালায়। মুসল্লিদের রক্তে মসজিদের আঙিনা ভেসে যায়। সেনাপতি রেমন্ড দুপুরের সূর্য হেলার আগে এক হাঁটু রক্ত ও লাশের ওপর দিয়ে মসজিদে আকসায় প্রবেশ করে। এ বাস্তবতার স্বীকারোক্তি দিতে হয়েছে পশ্চিমা লেখকদেরও। ‘তারা এতো ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল যে, মসজিদে ওমরে যাওয়ার পথে তাদের ঘোড়া হাঁটু পর্যন্ত রক্তে ডুবে গিয়েছিল। দেওয়ালে আঁছড়ে আঁছড়ে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, অথবা নগর-প্রাচীর থেকে চরকির মত ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।’

তিনদিন ব্যাপী নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে ৯০ হাজার মুসলমানকে শহিদ করা হয়। কুব্বাতুস সাখরাকে গীর্জায় রূপান্তরিত করা হয়। মসজিদে আকসার এক অংশকে ঘোড়ার আস্তাবল বানানো হয়, অপর অংশকে ব্যবহার করা হয় মেজরদের বসবাসের জন্য। ১১৪৭ সালে দ্বিতীয় ক্রুসেডের নেতা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যান ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুই। খ্রিষ্টান দুনিয়ার নেতা পিটার তার উদ্দেশ্যে লিখলেন তিনি আশা করেন রাজা সেই পরিমাণে মুসলিম হত্যা করতে পারবেন, মুসেজ ও যশুয়া যে পরিমাণে আমোরাইট ও কানানি হত্যা করেছিলেন।

নিষ্ঠুর এই চরিত্র নিয়ে ৯১ বছর শাসন করে ক্রুসেডাররা। ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম জয় করেন সালাহুদ্দীন আইয়ুবী (রহ.)। ক্ষমা ও মহত্বের অতুলনীয় নজির তিনি প্রদর্শন করেন। একজন বেসামরিক খ্রিষ্টান বা ইহুদির রক্ত ঝরেনি সেদিন। বরং হাজার হাজার বন্দিদের নিজের পক্ষ থেকে অর্থসহায়তা দিয়ে মুক্তি দেন।

আইয়ুবী প্রথম শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে পারেননি। কেননা, তাতে খ্রিষ্টানদের টয়লেট, ঘর ও ময়লা-আবর্জনা ছিল। তিনি নিজ হাতে সেগুলো ঝাড়ু দেন ও পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে। ৫৮৩ হিজরি ৪ শাবান, দ্বিতীয় শুক্রবার, তিনি তাতে জুমার নামাজ আদায় করেন। ক্রুসেডের আগে মুসলিম শাসনামলে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিস্তিনে ইহুদির সংখ্যা প্রায় ৩ লাখে পৌঁছে। ক্রুসেডাররা অধিকাংশকেই হত্যা করে, অনেককে নির্বাসনে পাঠায়।

সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর বিজয়ের সময় ফিলিস্তিনে ইহুদি পরিবার ছিল মাত্র ১ হাজার। খুব মানবেতর জীবনযাপন করছিল তারা। আইয়ুবী তাদের নিরাপত্তা বিধান করেন।

এর পরে বা আগে মুসলিম শাসন ইহুদিদের প্রশ্নে ন্যায়ভিত্তিক আচরণ করেছে। তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং যে ইহুদিরা মুসলিম শাসিত অঞ্চলে ছিলেন, তারা নিরাপত্তা, সম্মান ও অগ্রগতিকে আলিঙ্গন করতে পারছিলেন।

১৫ শতক থেকে ২০ শতক অবধি উসমানি শাসনামলে ফিলিস্তিন কোনো ইহুদি বা খ্রিষ্টান নিপীড়নের ঘটনা দেখেনি। কিন্তু ইউরোপে তখন ইহুদিদের উপর নির্মমতা চূড়ান্ত আকার নিয়েছে।

ইউরোপের কালো দিনগুলো : ইউরোপে নির্বাসিত ইহুদিদের বহন করতে হয় খ্রিষ্ট-বিরোধিতার দায়। বাইজেন্টাইন রাজারাও তাদের প্রতি সদয় ছিলেন না। ইহুদিরা ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে। রোমানরা খ্রিষ্টান হলো। যীশু খ্রিষ্টের অনুসারিরা ইহুদিদের খ্রিষ্টের শত্রু হিসেবে দেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ইহুদিরা ছোট্ট শিশুদের হত্যা করে তাদের রক্ত পাসওভার ব্রেডের সঙ্গে মেশায়।

উদ্দেশ্য : খ্রিষ্টের শেষ ভোজসভাকে অসম্মানিত করা। যাতে খ্রিষ্টান বিশ্বকে নিশ্চিহ্ন করার আন্তর্জাতিক চক্রান্তে অংশ নেয়া যায়। সরকারিভাবে বর্ণবাদী নীতি গ্রহণ করা হয়, যেন ইহুদিদের সঙ্গে কেউ কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে না পারে। ১১৭৯ এবং ১২১৫ সালে ল্যাটারান কাউন্সিলে গৃহীত স্পেশাল চার্চ লেজিসলেশন মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিদের সাধারণ শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। তাদের বাড়ি-ঘর থেকে সেবা গ্রহণ করা যাবে না। তাদের সঙ্গে আহার করা অপরাধ, তাদের সঙ্গে লেনদেন করা যাবে না, তাদের শিশুদের প্রতি মমতা পোষণ করা যাবে না। ‘এর শাস্তি হিসেবে গীর্জার সদস্যপদ বাতিল এবং পরবর্তীতে সম্পত্তি ক্রোকের মতো বিধান রাখা হয়েছিল।’

ইউরোপের দেশে দেশে এরপর ইহুদিদের জীবন ছিল বিচিত্র দুর্গতিতে জর্জরিত। ১২২৭ সালে পোপ নবম গ্রেগরি আরো কিছু ডিক্রি জারি করেন : মুসলিম ও ইহুদিদের আলাদা পোশাক পরা বাধ্যতামূলক, খ্রিষ্টানদের উৎসবের সময় তারা রাস্তায় বেরোতে পারবে না, কোনো সরকারি চাকরি তারা করতে পারবে না। ১৪৯২ সালে মুসলিম স্পেনের পতন হয়। সেখানে শুরু হয় ইনকুইজিশন। মুসলিমদের মতো লাখ লাখ ইহুদিকে হয় ধর্ম বদলাতে হয়েছে, নয় মরতে হয়েছে বা ছাড়তে হয়েছে দেশ। ‘অনেক ইহুদি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে স্পেনে থেকে যায়’ আবার অনেকেই ‘পালিয়ে যায় মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যে। সেখানে তাদের স্বাগত জানানো হয়।’

তখন ৭০, ০০০ ইহুদি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। ১৫০,০০০ ইহুদি চলে যায় নির্বাসনে। খ্রিষ্টানদের হাতে ইহুদিদের এই বিনাশ ৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমের ধ্বংসলীলার পর সবচেয়ে বড় বিনাশযজ্ঞ। কিন্তু ইহুদি নিধন ও বিতাড়ন তখন শুধু স্পেনেই হয়নি। ইংল্যান্ডে ১২৯০ সালে, ফ্রান্সে ১৩৯১ সালে, অস্ট্রিয়ায় ১৩৯১ সালে ইহুদি নিধন ও নির্বাসন ঘটে।

ভিয়েনা ও লিনয থেকে ১৪২১, কোলন থেকে ১৪২৪, অসবার্গ থেকে ১৪৪৯, বাভারিয়া থেকে ১৪৪২, মোরাভিয়া থেকে ১৪৫৪, রেগিয়া থেকে ১৪৮৫, ভিসেনযা থেকে ১৪৮৬, পারমা থেকে ১৪৮৮, মিলান ও লুক্কা থেকে ১৪৮৯ এবং তাসকানি থেকে ১৪৯৪ সালে ইহুদি বিতাড়নের ঘটনা ঘটে। নির্বাসনকে ইহুদিরা তখন অলঙ্ঘনীয় অসুখ মনে করত। ধীরে ধীরে তারা পোলেন্ডে পা রাখে।

নিকৃষ্ট চরিত্র, বর্ণবাদ, খ্রিষ্টবিরোধিতা, ষড়যন্ত্রপ্রিয়তা এমনকি প্লেগ ছড়ানোর অজুহাতসহ নানা কারণে ইউরোপে হত্যালীলাই ছিল ইহুদিদের নিয়তি। কিন্তু ইহুদিরা মুসলিম স্পেনে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক রেনেসাঁ উপভোগ করেছে। কিন্তু ইউরোপের বাকি অংশে হত্যালীলা তাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছিল।

১২১০ সালে ইউরোপের ঘৃণা ও মৃত্যু থেকে পালিয়ে ৩০০ রাব্বি ফিলিস্তিনে আসেন। মুসলিমরা তাদের আতিথ্য করলেও ১২২৯ সালের ক্রুসেড তাদের বংশকে ধ্বংস করে দেয়।

স্পেনে মুসলিম পতনের পরে উসমানিদের শাসিত বলকানসহ অন্যান্য অঞ্চলে ইহুদিরা আশ্রিত হয়। সেখানকার সেফারদিকরা ধর্মগ্রন্থে তালাশ করতে থাকে নিজেদের উত্তরণ। কিন্তু ধর্ম তো দুঃসময়ে তাদের সাহায্য করেনি। ফলে ধর্মের যা কিছু তাদের রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা করবে, তাকেই নিজেদের মতো করে কাজে লাগায়। তারা ইহুদিদের প্রতিশ্রুত দেশ, একজন মসিহের আগমন ইত্যাদি মিথকে নিজেদের অনুকূলে সাজায়। সেফারদিকদের একটা দল বলকান অঞ্চল ফিলিস্তিনে পাড়ি জমায়। এখানে গালিলির সেফেদে বসতি গড়ে। কারণ মসিহের আবির্ভাবের সময় আসছে এবং তিনি গালিলিতেই নিজেকে প্রকাশ করবেন। সবার আগে তাকে স্বাগত জানাতে সেখানে হাজির থাকতে চেয়েছিল ইউরোপের নির্বাসিতরা।

ক্রমাগতভাবে নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকি দিতে থাকা পৃথিবীতে ইহুদিদের জন্য উসমানি ভূমি ছিল একখণ্ড বিশ্রাম। ইসাক লুনিয়াহ (১৫৩৪-৭৩) ও পরবর্তী কাব্বালাহ আন্দোলন তাদের শেখাল, আর কোথাও কোনো বিশ্রামের সুযোগ নেই। ইহুদিদের কোনো মাতৃভূমি নেই। ফলে নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, জাতিগত ঐক্য এবং জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশলই হবে তাদের অভিভাবক। এর ভেতর থেকেই বের হবে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র। কাব্বালিস্টরা এজন্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের দৃষ্টিকে জেরুজালেমের প্রতি ধাবিত করতে চাইল। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রগঠন তখন তো অলিক কল্পনা। কিন্তু কাব্বালাদের বিচারে যখন তা হবে, তখন তা বাস্তব। কিন্তু যখন তা হচ্ছে না, তখন তা আশা, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা। এই আশা, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা আমাদের বেঁচে থাকাকে অর্থ, ঐক্য ও লক্ষ্য প্রদান করবে। ইহুদিদের জ্ঞানগত রেনেসাঁ ঘটে গিয়েছিল মুসলিম স্পেনে। এবার তারা সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে দুনিয়াকে বদলে দেবার কর্মযজ্ঞে মগ্ন হলো। যে খ্রিষ্টীয় বিশ্ব তাদের নিপীড়ন করছে, তাদের বদলে দেবার সর্বপ্লাবী কর্মপ্রয়াস শুরু হলো। ফরাসি বিপ্লব ইউরোপে খ্রিষ্টানদের সঙ্গে ইহুদিদের সমান্তরাল করে দিল।

নেপোলিয়ান তাদের সহায়তায় রাখলেন বিশেষ ভূমিকা। আধুনিকতা নতুন দৃষ্টিকোণের কেন্দ্রে নিয়ে এলো তাদের। রিফর্মেশন এবং প্রটেস্ট্যান্ট ও এংলিকান বিপ্লব খ্রিষ্টহত্যা ও বিরোধিতার দায় থেকে তাদের নিষ্ক্রীতি দিল। তাদের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে খ্রিষ্টানদের বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষায় পরিণত করলো। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস ও চেতনায় এমন সব সংকট তৈরি করল, যার ফলে সংঘাত ছিল অবধারিত।

১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল অবধি ৩০ বছরের যুদ্ধে চার থেকে আট মিলিয়ন খ্রিষ্টান সরাসরি যুদ্ধে এবং রোগ ও দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল। ইহুদিদের শত্রু রোমান ক্যাথলিক ও অর্থোক্স চার্চ প্রভাব হারায়। খ্রিষ্টানরা ভাগ হয় অগণিত দলে-উপদলে। বাদ যায় না প্রোটেস্ট্যান্ট-এংলিকানরাও। তাদের মধ্যে জন্ম নেয় মোরাভিয়া, লুথারিয়া, ক্যালভিনিয়া এবং প্রেসবাইটেরিয়ান ব্যাপটিস্ট, কংগ্রেগেশানালিস্ট, মেথডিস্ট, ইভানজেলিকান, মডার্নিস্ট ও এংলো ক্যাথলিক ইত্যাদি শাখা। ইহুদিরা সবার উপরেই বিছিয়ে দেয় প্রভাবজাল। ১৮ এবং ১৯ শতকে বার্লিনভিত্তিক Haskala আন্দোলন বুদ্ধিভিত্তিক পরিবর্তনের নতুন মাত্রা বিস্তার করে। অইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে একীকরণ, ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ে শিক্ষার উন্নতি, হিব্রু এবং ইহুদি ইতিহাসের শিক্ষাদান ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে ইহুদি চিন্তাধারার মেলবন্ধন তৈরিতে তা বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ঔপনিবেশিকতা জেরুজালেমের পথে তাদের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে সামনের পথকে সুগম করল। তারপরও ইহুদিবিদ্বেষ ইউরোপীয় গণজীবনে মোটেও কম ছিল না। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে ইউরোপ-আমেরিকার বাসিন্দাদের অনেকের বাড়িতেই একটি সাইন বোর্ড ঝুলানো থাকত। যাতে লেখা থাকত Dogs and Jews are not allowed! কুকুর ও ইহুদির প্রবেশ নিষেধ।

হিটলার ও নাৎসিদের ঘৃণায় ইহুদিরক্তে কম রঞ্জিত হয়নি বিশ্ব যুদ্ধকালীন ইউরোপ। ইহুদিদের যে চিত্র অঙ্কিত ছিল পশ্চিমা সাহিত্যে, তাকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা জরুরি ছিল।

ইহুদি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করলেন। উনিশ শতকে দেখা গেল পশ্চিমা দুনিয়ার চালকশ্রেণির মন ও মস্তিষ্ক ইহুদিদের দখলে চলে গেছে প্রায়। চরম দুর্গতি থেকে উত্তরণের পথে এ অগ্রগতি ছিল বিস্ময়কর।

লেখক : কবি ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত