ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য

কবিতা ও শিল্পের ভাষা
আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য

আজ ১৮ ডিসেম্বর। আন্তর্জাতিক আরবি ভাষাদিবস। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণসভার ২৮তম অধিবেশনে আরবি ভাষাকে এর দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০১২ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক অন্যতম সংস্থা ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে ১৯০তম অধিবেশনে সেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষাদিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

২০১২ সাল থেকে ইউনেসকোসহ আরব বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ এ দিবসটি বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা ও সভা-সেমিনারের মাধ্যমে পালন করে থাকে। আরবি ভাষার গুরুত্ব বাড়াতে, এর প্রচার-প্রসারে এবং বিশ্বময় এ ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে দিবসটি অনন্য ভূমিকা পালন করে। ২০১৩ সাল থেকে এ দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন আরবীয় সংস্থা ও ইউনেসকোর যৌথ উদ্যোগে একটি স্লোগান বা আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। ২০২৩ সালের জন্য দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে -

‘আরবি : কবিতা ও শিল্পেরভাষা।’

মূলত আরবি ভাষার সামগ্রিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে এবং কবিতা, শিল্প ও সাহিত্যে এর শক্তিশালী অবস্থানকে জানান দিতেই এ বিষয়টি প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। আরবি সাহিত্যের প্রাচীন ও বর্তমান ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায় আরবরা কবিতাকে উপজিব্য করে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে রেখেছে।প্রাচীন ও আধুনিক অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক এই ভাষায় তাদের কবিতা ও গদ্য রচনা করেছেন। গীতি-কবিতা ও কসিদার মাধ্যমে তাদের বেদুঈনজীবন, প্রেম, লড়াই ও সাহসের উপাখ্যান ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষত ইসলামপূর্ব যুগে কাব্যই ছিল তাদের সাহিত্য রচনার একমাত্র মাধ্যম। এছাড়া চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন সময়ে রংয়ের তুলিতে ক্যালিগ্রাফি ও চিত্রকলাসহ শৈল্পিক অনেক কাজ উপহার দিয়েছেন। এই ভাষার শৈল্পিকশ্রেষ্ঠত্বের সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ হিসেবে আল্লাহতায়ালা নাজিল করেছেন আলকুরআনুল কারীম। যাতে রয়েছে শিল্প ও সাহিত্যের সকল নান্দনিক দিক। শুধু কোরআনে কারীমের শব্দবাক্যকে কেন্দ্র করেই লিখিত হয়েছে হাজারও কিতাব। অসংখ্য অগণিত পদ্য ও গদ্য। ক্যলিগ্রাফার ও শিল্পীদের তুলিতে কোরআনের একেকটি আয়াত সেজেছে বর্ণিল সাজে। ফলশ্রুতিতে কবিতা, গদ্য ও শিল্পকর্মের নান্দনিক সব আয়োজনে আরবি ভাষা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা।

বিশিষ্ট আরবিসাহিত্যিক আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনায় আরবি ভাষা কাব্যিক ভাষা শিরোনামে কিতাব রচনা করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন যে আরবি ভাষা কাব্যিক ভাষা হিসেবে সর্বজন বিদিত। কবিতা রচনায় অত্যন্ত উপযোগী ভাষা। এর প্রতিটি হরফের সুর ঝংকার হৃদয়কে আন্দোলিত করে। তিনি বলেন অন্য কোনো ভাষা আরবির মতো কাব্যিক ভাষা হতে পারে বলে আমার জানা নেই। তাই ‘আরবি ভাষা কবিতা ও শিল্পের ভাষা’ প্রতিপাদ্যটি আরবি ভাষার জন্য যথাযথ।

বরাবরের মতো এবারও জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আরবের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এবারের প্রতিপাদ্যের জন্য এই শিরোনাম ঘোষণা করে। বিষয়টি নির্ধারণের কারণ হিসেবে তারা তাদের প্রকাশিত সংবাদে জানায়, ‘আরবি ভাষা যুগযুগ ধরে অসংখ্য কবি ও শিল্পীদের প্রেরণার উৎস। বর্তমান বিশ্বেও আরবি ভাষা সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা। এই ভাষার সংরক্ষণ, বিকাশে যেন কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা আরও এগিয়ে আসে সেজন্য এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেন আরবি ভাষার গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। আরবি কবিতা ও শিল্পচর্চার আরো বিস্তৃতি ঘটে।

আাজকের এ দিবসটি পালনে সাউদি আরবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ফেকালটিতে রয়েছে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান। আরবি ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশি ছাত্রদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে একটি অনুষ্ঠান। দিবস উপলক্ষ্যে বাদশাহ সালমান আরবি ভাষা একাডেমি গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন আয়োজন করে চলেছে। বিভিন্ন দেশের আরবি ভাষা একাডেমিও দিবসের প্রতিপাদ্য ছাড়াও বিভিন্ন শিরোনামে সেমিনারের ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে ‘মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ’ দিবসটি পালন করে আসছে। এবছরও মারকায কর্তৃপক্ষ কবিতাপাঠ, বক্তৃতা উপস্থাপন, আরবি কুইজ প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। মারকাযের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দারুল আরাবিয়া দিবস উপলক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষাদিবস : প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ র্শীষক একটি বই প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন মাদ্রাসা, মারকায এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে দিবসটি আয়োজনের মাধ্যমে সবার কাছে আরবি ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।আরবি ভাষা শিখতে আগ্রহী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগ আর সি মজুমদার হলে একটি সেমিনারের ঘোষণা দিয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবদুল কাদিরের সভাপতিত্বে প্রফেসর ড. যুবাইর এহসানুল হক মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।এছাড়া প্রত্যেক দেশে অবস্থিত সাউদি দূতাবাস দিবসটি পালনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

যা হোক, ১৮ ডিসেম্বর আরবি ভাষাদিবস হলেও আরবি সব সময়ের জন্য আমাদের কাছে সমান গুরুত্বের। আরবি আমাদের দ্বীনের ভাষা।

কোরআনের ভাষা। আমাদের প্রিয়নবীর ভাষা। তাই দিবস পালন আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং সবসময় গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের সবাইকেই আরবি ভাষার প্রচারপ্রসারে ভূমিকা রাখতে হবে। এ ভাষার খেদমতে সবাইকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনীয় সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মুসলিমদের কোরআনে কারীম শেখানোর মাধ্যমে আরবি ভাষার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিতে আলেম-সমাজকে কাজ করতে হবে। তালিবুল ইলমদের উচ্চতর আরবি ভাষা শিখতে এবং এ ভাষায় গভীরতা অর্জনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। শুধু কোরআনে কারীম ও এবাদতের ভাষা হিসেবেই নয় বরং জীবন্ত ও ব্যবহারিক ভাষা হিসেবেও আরবি ভাষা এবং আরবি শব্দের ব্যাপক প্রচারে সচেষ্ট হতে হবে। আরবি ভাষার প্রচারে আরবি মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

সার্বিক উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোরআনের ভাষা আরবি প্রতিটি হৃদয়ে স্থান করে নিক। এ ভাষা ছড়িয়ে পরুক সবখানে, সব প্রতিষ্ঠানে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে স্কুল ও মাদ্রাসার সিলেবাসে অধিক পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত হোক আরবি বিষয়াদি।

আরবির ভালোবাসায় জেগে ওঠুক প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি প্রাণ। আরবি ভাষার একজন একনিষ্ঠ খাদেম ও সেবক হিসেবে আজকের দিনে এই আমার প্রত্যাশা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত