সম্প্রতি ‘ট্র্যান্সজেন্ডার’ নামে একটি অদ্ভুত মতবাদ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এ মতবাদের অধিকারীদের উপস্থিতি জানান দিতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের কাছে নানারকম দাবিও তারা উত্থাপন করছে। শুধু কর্মসংস্থানের দাবি নয়, জাতীয় সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চায়, এমন দাবিতেও পথে নামছে এই অদ্ভুত রুচির মানুষরা।
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ কী? পশ্চিমা বিশ্বের উপর রাজত্ব কায়েম করে গড়ে ওঠা এ মতবাদের নাম ‘ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ’। অনেকে একে ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি’ বা লিঙ্গ পরিচয় মতবাদও বলে থাকেন। ইংরেজি শব্দ Transgenderism -এর বাংলা অর্থ হচ্ছে রূপান্তরকামীতা। রূপান্তরিত লিঙ্গ হলো সেসব ব্যক্তি, যাদের মানসিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গ চিহ্ন হতে ভিন্ন। রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিবর্গ যদি তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে ডাক্তারি সাহায্য কামনা করে তবে তাদের অনেকসময় রূপান্তরকামী নামে ডাকা হয়।
এই মতবাদ বলে, কোন পুরুষের যদি ‘নিজেকে নারী বলে মনে হয়’, তাহলে সে একজন নারী। সমাজ ও আইন নারী হিসেবেই তাকে বিবেচনা করবে। সেই পুরুষ শারীরিকভাবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হোক, তিন বাচ্চার বাপ হোক, কিছু আসে যায় না তাতে।
ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ বলে, ‘কোন নারীর নিজেকে যদি পুরুষ মনে হয়, তাহলে সে পুরুষ। যদিও তার মাসিক হয়, সে গর্ভবতী হয়, শারীরিকভাবে সে হয় ১০০ শতাংশ সুস্থ। নিজেকে পুরুষ মনে করা নারী যদি সন্তানের জন্ম দেয়, তাহলে সেটা ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের ভ্রান্তির প্রমাণ না। বরং ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের চোখে এটাই প্রমাণ করে যে, ‘পুরুষও সন্তান জন্ম দিতে পারে’!
এই মতবাদ অনুযায়ী কোনো বালকের যদি ‘মনে হয়’ সে বালিকা অথবা কোনো বালিকার যদি মনে হয় সে বালক, তাহলে এই ‘মনে হওয়া’র ভিত্তিতে সেই বালক কিংবা বালিকাকে চাহিবামাত্র হরমোন ট্রিটমেন্ট আর বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে কাটাকুটি করে নিজের শরীরকে বদলে ফেলার ‘অধিকার’ দিতে হবে। তার এই ‘মনে হওয়া’র চিকিৎসা করা যাবে না, বরং বদলে দিতে হবে শরীরকে।
একজন সমাজসচেতন গবেষক জানান, ‘ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের বক্তব্য এতটাই বিচিত্র, এতটাই বিদঘুটে যে প্রথম শোনার পর কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না আদৌ এমন কোনো মতবাদ থাকতে পারে। অনেকে মনে করেন হয়তো কোনো কারণে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। হয়তো এটা তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কোনো আন্দোলন। হয়তো এটা মানবিক বিবেচনা আর অধিকারের বিষয়। হয়তো লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চাওয়া, নিজেদের বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেওয়া মানুষের শারীরিক কোনো সমস্যা আছে।’
এ মতবাদের প্রধান দাবি : ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের প্রধান দাবি হলো- ‘জন্মগত দেহ যা-ই হোক না কেন, নিজেকে যে নারী দাবি করবে তাকে নারী বলে মেনে নিতে হবে, নিজেকে যে পুরুষ দাবি করবে তাকে মেনে নিতে হবে পুরুষ বলে, আইনি ও সামাজিকভাবে।
মানুষ ইচ্ছামতো পোশাক পরবে, ইচ্ছামতো ওষুধ আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বদলে নেবে নিজের দেহকে। আর কেউ যদি অস্ত্রোপচার না করেই নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করে, তাও মেনে নিতে হবে মুখ বুজে। রাষ্ট্র ও সমাজ কোনো বাধা দিতে পারবে না, বরং ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ হিসেবে এ ধরনের মানুষকে দিতে হবে বিশেষ সুবিধা। সেই সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একদম ছোটবেলা থেকে সবাইকে শেখাতে হবে যে, মানুষের মনটাই গুরুত্বপূর্ণ; দেহ না।’
যেভাবে চলছে ট্রান্সজেন্ডারবাদের প্রচার-প্রসার : পশ্চিমা দেশগুলোর স্কুলগুলোতে এই মতবাদ শেখানো হচ্ছে বলে জানা যায়। প্রবল আগ্রহে এই মতবাদকে গ্রহণও করে নিয়েছে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো। মধ্যপন্থি থেকে শুরু করে বামপন্থি, সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এই মতবাদ প্রচার করে চলছে উগ্রভাবে। আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের এক্সিকিউটিভ নির্দেশ, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পলিসিও ঠিক হচ্ছে নতুন এই মতবাদের আলোকে। এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে আইন তৈরি হচ্ছে এবং এই মতবাদ শেখানো হচ্ছে শিশুদের ক্লাসরুমে। এই বিচিত্র আদর্শকে উপস্থাপন করা হচ্ছে নাগরিক ও মানবাধিকারের প্রশ্ন হিসেবে। মানবাধিকারের নামে সারা বিশ্বজুড়ে এই মতবাদ ফেরি করে বেড়াচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসংঘ। বিলিয়ে বেড়াচ্ছে বিপুল অর্থ। ফলে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে পাকিস্তানের আদালতের রায়েও ঢুকে পড়েছে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ।
বাংলাদেশে ট্র্যান্সডেন্ডার : বাংলাদেশেও বেড়ে চলেছে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রচার ও প্রসার। নারী থেকে পুরুষ ও পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হতে দেখা যাচ্ছে অনেককে। এদের সংখ্যা যদিও এখনো কম, কিন্তু এর ভয়াবহতা নিয়ে শংকিত সমাজসচেতন বিশেষজ্ঞ মহল।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩-এ দৈনিক প্রথম আলোতে ‘নারী থেকে পুরুষ হয়েছেন তিনি, এখন জটিলতা বাংলাদেশ রেলওয়ের চাকরিতে’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে শারমিন আক্তার ঝিনুক নামে এক নারীর কথা বলা হয়েছে। এই মহিলা শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু ‘অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট’ হওয়ার কারণে তিনি ‘নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত’ হয়েছিলেন। নতুন নাম নেন জিবরান সওদাগর।
জিবরান বলেন, ‘আমি একজন নারী ছিলাম। মাসিকসহ সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমি অন্য ছেলে বা পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছি। স্কুল ড্রেস ওড়না পরা বা মেয়েদের মতো পোশাক পরা পছন্দ করত না। এক সময় এক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। চার বছর ধরে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আমার মনে হয়, আমি যদি পুরুষ হতাম তাহলে সে এভাবে চলে যেত না।
এছাড়া আরো অনেক পুরুষ নারীতে ও নারী পুরুষে রূপান্তরিত হতে দেখা গেছে নানা মাধ্যমে।
দেশে ট্র্যান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় আইন : এদিকে গত ৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার নগরীর একটি হোটেলে ‘ট্র্যান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা ও সুরক্ষা আইন-২০২৩’-এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়রুল আলম শেখ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই আইনটি পাস করা হবে বলে জানান।
ট্র্যান্সডেন্ডার আতঙ্কের কেন : বেশ ক’বছর ধরে বাংলাদেশেও ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগী মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। তাদের কর্মতৎপরতার কিছু কিছু ফলাফল সম্প্রতি সবার সামনে এলেও এর সত্যিকারের মাত্রা এবং পরিধি এখনো অধিকাংশেরই অজানা। ব্যাপারটাকে স্রেফ কিছু মানসিক রোগী কিংবা বিকৃত রুচির মানুষের উদ্ভট কর্মকাণ্ড মনে করে ভুল করছেন অনেকে। এর পেছনে বিশাল এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী এক নেটওয়ার্ক আছে মনে করছে সমাজসচেতন ব্যক্তিবর্গ। তাদের বক্তব্য, ‘আমরা যখন প্রতিক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে ভাবছি, ওরা তখন সামনের দশটা ধাপ ভেবে রেখেছে। বছরখানেকের মধ্যে হয়তো আমাদের এ বাংলাতেই ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের বৈধতা দেওয়া হবে। বিষাক্ত এ মতবাদ গ্রাস করে নেবে আমাদের সমাজকে। ফলে সমাজে ট্যান্সজেন্ডারবাদের হুমকি নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সমাজসচেতন ব্যক্তিবর্গ।
তাদের মতে, এ মতবাদ সমাজের ভারসাম্যতা ও স্বাভাবিক রীতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে তৈরি করছে মারাত্মক সামাজিক বিশৃঙ্খলা।’ এছাড়া, ‘সাধারণ মানুষের তুলনায় এদের মধ্যে ১৪ গুণ বেশি আত্মহত্যা চিন্তা এবং ২২ গুণ আত্মহত্যার আশঙ্কা থাকে বলে জানা গেছে একটি জরিপ থেকে।
ট্র্যান্সজেন্ডার বিষয়ে ইসলাম যা বলে : কোরআন ও হাদিসের সমন্বিত রূপ ইসলাম মানুষের কল্যাণে নিবেদিত এক অতুলনীয় মাইলফলক। ইসলামের অকাট্য দাবি, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে বিপরীত লিঙ্গের বেশ ধারণ করা এবং অনুকরণ করা নিষিদ্ধ। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ পুরুষদের মধ্যে নারীর বেশ ধারণকারীদের এবং নারীদের মধ্যে পুরুষের বেশ ধারণকারিণীদের অভিশাপ দিয়েছেন। (বাখারি শরিফ; মিশকাত, হাদীস নং ৪৪২৯)।
ট্র্যান্সজেন্ডার তথা যারা আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি ঘটায় তাদের অভিসম্পাত করা হয়েছে মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ সেসব মানুষদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন যারা তার সৃষ্টিতে বিকৃতি আনে’। -(বোখারি: ৪৮৮৬)।
সম্পূর্ণ সুস্থ শরীর নিয়ে কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করে, বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরে, অনুকরণ করে এবং ‘লিঙ্গ পরিবর্তন করে তাদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাকে (শয়তানকে) অভিসম্পাত করেছেন এবং সে (শয়তান) বলেছে, আমি তোমার দাসদের এক নির্দিষ্ট অংশকে (নিজের দলে) গ্রহণ করবই। এবং তাদের পথভ্রষ্ট করবই; তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবই, আমি তাদের নিশ্চয় নির্দেশ দেব, ফলে তারা পশুর কর্ণচ্ছেদ করবেই এবং তাদের নিশ্চয় নির্দেশ দেব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই। আর যে আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, নিশ্চয় সে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা নিসা: ১১৮-১১৯)।
লেখক : কবি ও গবেষক