ইতিহাস অধ্যয়নের উসুলি প্রক্রিয়া : স্বীকৃতি ও বিকৃতি

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাসের প্রকৃতি এবং ইতিহাস শব্দটির বিভিন্ন ব্যবহারের মধ্যে প্রার্থক্য করতে ভাষার অক্ষমতা রয়েছে। তবুও সত্তা হিসেবে ইতিহাসকে পরিচিত করা যায়। সে অর্থে ইতিহাস হলো ইতিহাসবিদ এবং তার তথ্যের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া। কিংবা ইতিহাস হলো অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটি অবিচ্ছিন্ন কথোপকথন।

অনেকেই মনে করেন ইতিহাস হলো প্রতিষ্ঠিত সত্যের অনুসন্ধান। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই মতের প্রচলন ছিল খুব। পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। বহু লোক ইতিহাসকে তথ্যের ব্যাখ্যা এবং সেগুলোকে বিন্যস্ত করার প্রকল্প হিসেবে দেখেন। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসবিদ সত্যসৃষ্টি যেমন করেন না, তেমনি সত্য নির্বাচনও করেন না। বরং তিনি তথ্য অনুসন্ধান করেন, সেগুলো সংগ্রহ করেন, তারপরে নিজের ঐতিহাসিক ধারণার মাধ্যমে সেগুলোর ব্যবহার ঘটান। যার মাধ্যমে সত্য ও যথার্থতার একটি প্রস্তাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু এ প্রস্তাবনার সঙ্গে ইতিহাসবিদের মন-মানস, রুচি, অবস্থান এবং আত্মবিনিয়োগের মাত্রা ও বিচারসামর্থ্যরে সম্পর্ক গভীর। যা সীমাবদ্ধতার পরিসরকে অতিক্রম করতে পারে না। অতএব ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে বিচার ও প্রস্তাবনা। প্রশ্নহীন সত্য নয়। এর যথার্থতা ঐতিহাসিক যাচাই প্রক্রিয়ার যথার্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব জায়গায় পারদর্শিতা না থাকলে ইতিহাস চর্চা একটা স্টুপিড অকুপেশনে পরিণত হয়। ইতিহাসের অধঃপতন ঘটে। আসে বিকৃতি।

সময়ের পরিবর্তনের পরিক্রমাকে অধ্যয়ন করা ইতিহাসের কাজ। মানব সমাজের প্রতিটি দিক তার দৃষ্টিসীমায় থাকে। ঘটনাচক্র ও জীবনের চলমান ধারাবাহিকতাকে সে ভেতর ও বাইরের চিত্র ও চরিত্রের সমবায়ে বুঝার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত, চিকিৎসা, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মীয় এবং সামরিক উন্নয়ন সবই তার দৃষ্টিসীমায় থাকে। সবই তার আলোচ্য। প্রতিটি ভুবনে সে বিহার করে। সেই বিহার কোনো বিচ্ছিন্ন পরিক্রমা নয়। বরং এর মধ্যে রয়েছে শৃঙ্খলা। ইতিহাস তাই একটি বিজ্ঞান। যা পদ্ধতিগত চিত্রায়ন করে অতীতের ঘটনা ও তার অনুক্রমকে, এর কারণ ও প্রক্রিয়াকে। এই চিত্রায়নে ব্যবহৃত হয় তথ্যের উৎস ও ক্রনিকলস, ভাষ্য ও ভাষ্যকার, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও সরকারি নথি, অধ্যয়ন, বিবেচনা ও যুক্তিবিজ্ঞান। সমসাময়িক সাহিত্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূপ্রকৃতি, জীবনবিকাশের অব্যাহত অভিজ্ঞতা এবং জীবনধারার অধ্যয়ন মানুষের অগ্রগতিকে ব্যাখ্যা করার ঐতিহাসিক শৃঙ্খলায় যুক্ত। এই শৃঙ্খলার প্রয়োজনে জন্ম নিয়েছে ইতিহাস পাঠ ও বিচারের বিভিন্ন পন্থা ও অধ্যয়ন পদ্ধতি। আধুনিক জ্ঞানকলায় স্বীকৃত পদ্ধতিগুলোকে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এক. সাধারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দুই. ঐতিহাসিক পদ্ধতি, তিন. ঐতিহাসিকদের দ্বারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধার করা সূত্র, ধারণা ও পরিকল্পনার সমাবেশ। যা ঐতিহাসিক ভাষ্য গঠন করে।

ইতিহাসের কোনো এক নির্দিষ্ট সংজ্ঞার সঙ্গে একমত নন ইতিহাসবিদগণ। তবে ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে ইতিহাস কথাটার তিনটি স্তরকে বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমত, ইতিহাস মানব-কার্যকলাপের সামগ্রিকতাকে বোঝায়। অর্থাৎ মানুষ তাদের ইতিহাসজুড়ে যেসব কাজসম্পন্ন করেছে, সেগুলো ইতিহাসের খাবার। তবে প্রতিটি ঘটনা ইতিহাসে পরিণত হবে, বিষয়টি এমন নয়। ইতিহাস তার নিজস্ব চলার স্রোতে যা কিছুকে অঙ্গীভূত করে নেবে, সেগুলো ঐতিহাসিক ব্যাপার হয়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত, ইতিহাস তার বিবরণীগুলোকে কালানুক্রমিক রেকর্ড হিসাবে শৃঙ্খলা দান করে। ঘটনাকে তার পূর্বসূরী ঘটনার পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখে না। ঐতিহাসিক পরম্পরায় দুটি উপস্তর রয়েছে। পহেলা স্তর উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী। অর্থাৎ ঘটনার পেছনে ন্যায্যতা আছে কি না, বিবরণ ও ঘটনার মধ্যে সমন্বয় ও যথার্থতা আছে কি না এবং ঐতিহাসিক পরিক্রমায় ঘটনা ও বিবরণগুলোর ব্যাখ্যাগুলো কী ও কেমন, সে বিষয়ক জ্ঞান জরুরি। দোসরা স্তর হলো, ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাগুলোর এমন রেকর্ডিং, যা থেকে শিক্ষা ও বার্তাগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। আল কোরআন বার বার আমাদের ঐতিহাসিক ঘটনার মুখোমুখি করে, ভ্রমণ করতে, ধ্যান করতে এবং পাঠ করতে বলে, এর মূলে আছে সেই ইবরত হাসিলের তাড়না। যেন অতীতের ভেতর থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পঠন-পুনর্পঠন করতে পারে মানুষ, সেখান থেকে লাভ করে শিক্ষা, পথের দিশা।

তৃতীয়ত, ইতিহাস একটি বিজ্ঞান, একটি একাডেমিক সিস্টেম। যা বৈজ্ঞানিক উপায় ও প্রক্রিয়া সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই ও বিশ্লেষণে জ্ঞানপ্রাজ্ঞ অন্তর্দৃষ্টি সরবরাহ করবে।

সেই উসুল আসলে কী, যা দিয়ে আমরা ইতিহাসের নামে চলতি বয়ানকে যাচাই করব? ইবনে খালদুন বয়ান করেছেন এর কাঠামো। ইতিহাসবিদের বয়ান কতোটা সত্যের কাছাকাছি, তা নির্ণয়ে দেখতে হবে যে ঘটনার বিবরণ তিনি দিচ্ছেন, সেই ঘটনা ঘটার কারণগুলো পরিপূর্ণ মাত্রায় তিনি জেনেছেন কি না, ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রেক্ষাপটগুলো, তার শুরু, বিকাশ ও মাত্রাগুলো তলিয়ে দেখেছেন কি না। এসব করতে গিয়ে তিনি ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছেন কি না। ঐতিহাসিক কখন সত্যের বিকৃতি ঘটান কিংবা ইতিহাসের নামে অসত্যকে চালিয়ে দেন? মোটা অর্থে কেন ও কখন ভুল করেন ইতিহাসবিদ? ইবনে খালদুনের মতে এর আছে সাত কারণ।

১. কোনো বিশেষ দল বা মতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ২. তথ্যের জোগানদাতা বা সূত্রের উপর নির্ভরশীলতা ৩. কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটার উদ্দেশ্য না-জানা ৪. কোনো বিশেষ অনুমানের উপর অগাধ বিশ্বাস ৫. কন্ডিশন বা অবস্থার প্রকৃত চেহারা না দেখা এবং এর সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক রিয়েলিটির সম্ভাব্য যোগসূত্র না বুঝা। ৬. সমাজের উচ্চ অবস্থানে থাকা মানুষের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের ভক্তি ও অতিপ্রশংসা। যা প্রকৃত তথ্যকে বিনষ্ট করে, অতিরঞ্জন করে। (আবার কারো প্রতি অতিমাত্রায় নিন্দা, যা প্রকৃত বাস্তবতার বদলে লেখকের মানসিকও অবস্থানগত বাস্তবতাকে বাস্তবতা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়।) ৭. সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিচিত্র অবস্থা ও চরিত্র সম্পর্কে না জানা।

অতএব, ইতিহাস অধ্যয়নের মূলনীতি এসব কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইতিহাসের জন্য উসুলি মানদ- প্রতিষ্ঠায় ইবনে খালদুনের পন্থা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বস্তুত জনগোষ্ঠীর মানসিক আচার-আয়তন, আবহাওয়া, ভৌগলিক গঠন, ভূ-প্রকৃতি, বাস্তব উপযোগ ইত্যাদিকে বাদ দিয়ে কোনো ঘটনার বিচার করা যায় না। আগে ঘটনা ও বর্ণনাগুলো স্বীকৃতি ও প্রসিদ্ধির বিচারে ইতিহাসে গৃহীত হতো। ইবনে খালদুনের মধ্যে বিকৃতির নজিরগুলো দেখালেন। ইতিহাস বিচারের বিচারপতি বানালেন সম্ভাব্যতা, বৌদ্ধিক যাচাই প্রক্রিয়া ও বাস্তব কার্য-কারণকে। তিনি দেখালেন ইতিহাস কোনো রাজা-বাদশা বা বীরপুরুষদের কাহিনির সমাহার নয়, ইতিহাস হচ্ছে জীবন ও কাল সম্পর্কিত মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর রূপায়ন। কিংবদন্তি থেকে ইতিহাসকে সমালোচনামূলক মেথডলোজির অধীনে নিয়ে এলেন। এর সহায়তায় মুসলিম ইতিহাসচর্চায় প্রাচীন ও পরবর্তী ধারার সমন্বয়ে কতিপয় মৌলিক উসুল স্বীকৃত হলো। যেমন-

(ক) বর্ণনার সনদ যাচাই করা : সনদ বা বর্ণনার সূত্র ও পরম্পরা জরুরি। তবে ঐতিহাসিক সনদের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসদের মতো কঠোরতার শর্ত আরোপ করেন না ইতিহাসবিদগণ। ইতিহাস রচনায় কখনো মুরসাল, কখনো মুনকাতে বর্ণনা গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হাদিসের অনুরূপ শর্ত ও নীতিমালা প্রযোজ্য হয়নি।

(খ) বর্ণনার বক্তব্য যাচাই করা : সনদ শুদ্ধ হলেই বর্ণনাকে গ্রহণ করেনি মুসলিম ঐতিহাসিক জ্ঞানকলা। এর জন্য মতন বা ভাষ্যকেও যাচাই করা হয়েছে। এজন্য অবলম্বন করা হয়েছে সূক্ষ্ম মানদ-। আধুনিক ইতিহাসবিদ্যায় যাকে বলে আভ্যন্তরীণ যাচাই প্রক্রিয়া, সেটা মুসলিম জ্ঞানকাণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাদিসের প্রয়োজনে। ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর আততাময়িজ হাদিসের মতন বা বক্তব্য যাচাইয়ের উপায় ও প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইবনে জাওজি (রহ.)-এর আল মাউজুয়াত, ইবনুল কায়্যিম (রহ)-এর আল মানারুল মুনীফ ফিস সাহিহি ওয়ায যায়ীফ গ্রন্থ দেখিয়েছে বর্ণনার ভাষ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। এসব কিতাবে এমন মূলনীতি রয়েছে, যার আলোকে সনদ বিচার না করে শুধু মতন দিয়েই বর্ণনার মান নির্ণয় করা যায়।

ঐতিহাসিক বর্ণনা যখন (১) অতিমাত্রার কোনো সংখ্যা উল্লেখ করে, (২) অস্বাভাবিক ফলাফলগুলো উল্লেখ করতে থাকে (৩) স্বভাববিরুদ্ধ বিষয়কে প্রদর্শন করে, (৪) সস্তা শৈলী দিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করে (৫) নীচু স্তরের বক্তব্য ও কটু মানসিকতা প্রদর্শন করে কিংবা (৬) কোরআন-সুন্নাহ ও শরয়ি বিধির বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে, তখন তার মতন বা ভাষ্যের দুর্বলতা প্রমাণিত হবে। মুসলিম ইতিহাসকলার বিচারপদ্ধতি এই নীতিমালা স্থির করেছে। (চলবে)।

লেখক : কবি ও গবেষক