ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসমাঈল সিদ্দিকী

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডার নামে এক অদ্ভুত মতবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্নভাবে এ মতবাদ লালনকারীরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে এবং ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আর কিছু মিডিয়াও খুব পজিটিভলি জাতির সামনে এদের উপস্থাপন করছে। ট্রান্সজেন্ডারের প্রচলন এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি সুস্থ সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছেন বিভিন্ন মহলের বিশেষজ্ঞরা।

ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ কী : ট্রান্সজেন্ডার বলতে মূলত বোঝায়, যাদের এমন একটি নিজস্ব যৌন পরিচয় বা যৌন অভিব্যক্তি রয়েছে, যা তাদের জন্মগত যৌনতা থেকে ভিন্ন।

যার প্রবক্তারা পৃথিবীবাসীকে এমন এক পথের দিকে আহ্বান করছে, যেখানে শরীর নয়, মনই ব্যক্তির আসল লিঙ্গ-পরিচয়। অর্থাৎ একজন পুরুষের যদি মনে হয় সে নারী, তাহলে সে নারী। আবার একজন নারীর যদি মনে হয় সে পুরুষ, তাহলে সে পুরুষ। তাদের দাবি হলো; তাদের বাহ্যিক লিঙ্গ আর বিকৃত চিন্তাগত লিঙ্গ দুটো ভিন্ন ভিন্ন। এরা আরো দাবি করে; ডাক্তারের সাহায্যে তাদের মনের রূপকে বাস্তবেই রূপান্তর করা সম্ভব। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে; তথাকথিত লিঙ্গ পরিবর্তন তথা সার্জারির মাধ্যমে কেউ আসলে পুরুষ থেকে নারী বা নারী থেকে পুরুষ হয় না। মূলত এগুলো এক ধরনের কসমেটিক সার্জারি। এ ধরনের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শুধু বাহ্যিকভাবে কিছু পরিবর্তন আনা যায়, সৃষ্টিগত লিঙ্গের কোনো পরিবর্তন করা যায় না।

ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? : আল্লাহতায়ালা আমাদের শ্রেষ্ঠ উম্মত বানিয়েছেন এবং সুন্দর অবয়বে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। এ সুন্দর অবয়ব আল্লাহ প্রদত্ত আমানত ও নেয়ামত। এতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা কিংবা শরয়ি বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে এ স্বাভাবিক অবয়বে কৃত্রিম উপায়ে বিকৃতি সাধন করা শয়তানি ফাঁদ এবং চরম ঘৃণ্য কাজ। শয়তানের এই জঘন্য ফাঁদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা আগেই আমাদের সতর্ক করেছেন এবং আল্লাহর আদেশ মানার পরিবর্তে যে শয়তানি মিশন বাস্তবায়ন করবে, সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে মর্মে সাবধান করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাকে (শয়তানকে) অভিসম্পাত করেছেন এবং সে (শয়তান) বলেছে, আমি তোমার দাসদের এক নির্দিষ্ট অংশকে (নিজের দলে) গ্রহণ করবই এবং তাদের পথভ্রষ্ট করবই; তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করবই, আমি তাদের নিশ্চয় নির্দেশ দেব, ফলে তারা পশুর কর্ণচ্ছেদ করবেই এবং তাদের নিশ্চয় নির্দেশ দেব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই। আর যে আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, নিশ্চয় সে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১১৮-১১৯)।

হাদিসেও এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করা হয়েছে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি ঘটায় তাদের অভিসম্পাত করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) এমন সব নারীর ওপর অভিসম্পাত করেছেন, যারা অঙ্গে উল্কি আঁকে ও অন্যকে দিয়ে উল্কি আঁকায় এবং সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়ে আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে (তিরমিজি : ২৭৮২)।

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ পুরুষদের মধ্যে নারীর বেশ ধারণকারীদের এবং নারীদের মধ্যে পুরুষের বেশ ধারণকারিণীদের অভিশাপ দিয়েছেন। (মিশকাত : হাদিস নং ৪৪২৯)।

বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার : সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি বাংলাদেশেও ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অদ্ভুত রুচির মানুষরা সরকারের কাছে নানারকম দাবিও উত্থাপন করছে। শুধু কর্মসংস্থানের দাবি নয়, জাতীয় সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চান, এমন দাবিতেও পথে নামছেন এই মতবাদ লালনকারীরা। শোনা যাচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘হিজড়া’ পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারবে এরা। নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার মনোনয়নপত্রে ‘লিঙ্গ’ পরিচয়ে সংশোধন এনে ‘পুরুষ’ ও ‘মহিলা’র পাশাপাশি ‘হিজড়া’ যুক্ত করার মাধ্যমে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ক্ষমতাবলে বিধিমালায় এই সংশোধন এনেছে নির্বাচন কমিশন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। (প্রথম আলো : ৩১ ই মার্চ ২৩)। ‘ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের রাজনৈতিকবিষয়ক প্রথম সচিব কর স্টৌটেন বলেন, বাংলাদেশ সরকার ট্রান্সজেন্ডার এবং তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে এগিয়ে আছে। এটা খুবই প্রশংসনীয়। নো পাসপোর্ট ভয়েস এর ট্রান্সজেন্ডার অধিকারবিষয়ক শুভেচ্ছা দূত হো চি মিন ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ থেকে এগিয়ে আছে।’ (সমকাল) এই খবরটি যদি সত্য হয়, তবে দেশে সুদূরপ্রসারী ভয়াবহ প্রেক্ষাপট তৈরি হবে। যা দিনশেষে একটি সভ্য সমাজকে অসভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করবে বলে ধর্ম ও সমাজবিশেষজ্ঞ বিজ্ঞমহলের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

ট্রান্সজেন্ডার সামাজিকীকরণে হবে ভয়াবহ বিপর্যয় : ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এতে সমস্যা কী, সবাই তো আর এক রকম হয় না। ওদের সংখ্যাই বা আর কত। তারা তো আমাদের কোনো সমস্যা করছে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই মতাদর্শ পলিসি বাস্তবায়নের ফলে বিভিন্ন সামাজিক, স্বাস্থ্য এবং আইনগত সমস্যা গত কয়েক বছরে অনুধাবন করা যাচ্ছে। এটি হাজার হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গভিত্তিক সিস্টেমকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। এ মতবাদ সমাজের ভারসাম্যতা ও স্বাভাবিক রীতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক সামাজিক বিশৃঙ্খলা। সঙ্গে সঙ্গে জেনা-ব্যভিচারের রাস্তাও আরো সুগম আরো সহজ হয়ে যাবে। কারণ ট্রান্সজেন্ডার মেয়েদের যদি মহিলা বিশেষায়িত স্থান তথা মহিলা হোস্টেল ইত্যাদিতে প্রবেশের অবাধ অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে সুকৌশলে ব্যভিচারের পথকে আরো সহজ করে দেওয়া। কারণ আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো মাধ্যমে শরীরের কিছু পরিবর্তন আসলেও তাদের সৃষ্টিগত লিঙ্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। সুতরাং এভাবে একজন ট্রান্সজেন্ডার মেয়েকে (যে কি না বাস্তবে একজন পুরুষ) মহিলা বিশেষায়িত স্থানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া তার জন্য ধর্ষণের পথ খুলে দেওয়া নয় কি? গবেষণায় দেখা গেছে ট্রান্সজেন্ডার স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ হিসেবে নিজেদের মনে করলেও বা সমাজে উপস্থাপন করলেও তারা অনেক মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণ মানুষের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি আত্মহত্যা চিন্তা এবং ২২ গুণ বেশি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করে এরা। তাছাড়া এদের মাঝে মাদকাসাক্ত, নিজে নিজের ক্ষতি করা (self-harm)), ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদির প্রবণতাও অনেক বেশি।

ট্রান্স বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অবস্থান : বিশ্বের বিখ্যাত টেক বিলিনিয়ার ইলন মাস্ক ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। এই বিষয়ে তিনি মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট দিয়ে পিতামাতাকে সচেতন রাখেন। এই বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন করাতে সম্প্রতি তিনি একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি (what is a woman) শেয়ার করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ ভিডিওটি দেখেছে। (কালবেলা : ১৫ নভেম্বর ২০২৩)।

স্কুলের পাঠ্যক্রমে ট্রান্সজেন্ডার বা এলজিবিটি মতাদর্শ অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে গত ২০ সেপ্টেম্বর কানাডার লক্ষ লক্ষ (মিলিয়ন মার্চ) পিতামাতা রাস্তায় নেমে আসেন। (কালবেলা : ১৫ নভেম্বর ২০২৩)। সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রাখতে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো এলজিবিটির বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। এমনকি উগান্ডা পশ্চিমা ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বিশ্বের ব্যাংকের ঋণ স্থগিত করার মতো অর্থনৈতিক ব্যাপারকেও উপেক্ষা করেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছে। জেন্ডার আইডেন্টিটি ইস্যুতে ইতালির সরকার পরিবর্তন হয়। সম্প্রতি হ্যাংগেরি ট্রান্সজেন্ডাদের লিগালাইজেশন বন্ধ ঘোষণা করেছে।সব ধরনের সমস্যাকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের উচিত, এ ধরনের মতবাদ যারা লালন করে, এ মতবাদ বিস্তারে যারা সক্রিয় ভূমিকায় আছে তাদের চিহ্নিত করা, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে এমনসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, যার সমাধান বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

লেখক : ইসলাম বিষয়ক গবেষক