আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক কেমন হবেন?

মাওলানা আসলাম শেখোপুরি (রহ.)

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাষ্ট্রনায়কের দায়বোধ : রাষ্ট্রনায়কদের জন্য অপরিহার্য হলো নিজের প্রজা সাধারণের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও করুণার আচরণ করা। তাদের সঙ্গে কঠোরতার আচরণ বর্জন করা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন প্রার্থনা করে বলেছেন, হে আল্লাহ! যে ব্যক্তিকে আমার উম্মতের কোনো শাখার শাসক বানানো হয়, এরপর সে লোকদের ওপর কঠোরতা আরোপ করে, আপনিও তার ওপর কঠোরতা আরোপ করুন। আর যে ব্যক্তি শাসনভার গ্রহণ করার পর লোকদের সঙ্গে নম্রতা অবলম্বন করে আপনিও তার প্রতি নম্রতা অবলম্বন করুন। শাসকদের জন্য অপরিহার্য হলো প্রজা সাধারণের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ করা। তাদের হেফাজত ও তত্ত্বাবধান করা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তিকে জনগণের সেবার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়, এরপর সে জন সাধারণের রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনা সেভাবে করে না যেভাবে নিজের পরিবার পরিজনের দেখাশোনা করে; এমন ব্যক্তি জান্নাতের সুবাসও পাবে না। খোলাফায়ে রাশেদিনের ওপর আমল করে দেখিয়েছেন।

দুস্থ-অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো : আজকের শাসকদের জন্য উচিত হলো খোলাফায়ে রাশেদিনকে নিজেদের শাসনের আদর্শ বানানো। হজরত উমর ফারুক (রা.) রাতের বেলা একজন পঙ্গু ও অন্ধ বৃদ্ধার দেখাশোনা করতেন। তার প্রয়োজনীয় কাজ করে দিতেন। সেই মহিলা মদিনার আশপাশেই থাকত। কিন্তু কিছুদিন পর হজরত উমর (রা.) দেখলেন, অন্য কোনো ব্যক্তি এসে তার আগেই কাজ করে চলে যায়। তিনি নিতান্ত হয়রান হলেন, কে সেই ব্যক্তি? সেই ব্যক্তিকে দেখার জন্য একদিন রাতের বেলা দাঁড়িয়ে থাকেন। এক সময় দেখতে পান হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এসেছেন। হজরত উমর (রা.) বললেন, আপনি ছাড়া এমন ব্যক্তি আর কে হতে পারে?

রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট না-করা : হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হজরত আয়েশা (রা.) কে বললেন, যখন হতে আমি খলিফা হয়েছি তখন হতে আমি মোটা খাবার খেয়েছি। মোটা কাপড় পরিধান করেছি। মুসলমানদের গনিমতের সম্পদ হতে আমার কাছে এই ইথিওপীয় ভৃত্য, উট ও পুরাতন চাদরটি ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার মৃত্যুর পর তুমি এ বস্তুগুলো হজরত উমর (রা.)-এর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। হজরত আয়েশা (রা.) তার মৃত্যুর পর এমনটিই করেন।

খাদেমকে সেবা করা : হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) গ্রীষ্মকালের এক দুপুরে আরাম করছিলেন। এ সময় এক দাসী তাকে পাখা দিয়ে বাতাস করছিল। পাখা দোলাতে দোলাতে তারও ঘুম এসে যায়। এ সময় হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করতে থাকেন! দাসীর চোখ খুললে ঘাবড়ে গিয়ে বলতে থাকে, আমিরুল মোমেনিন! আপনি একি করছেন? আমিরুল মোমেনিন দাসীকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, আমার মতো তুমিও মানুষ। তোমারও গরম লাগে। যেভাবে তুমি আমাকে পাখা দিয়ে বাতাস করেছ, আমিও যদি তোমাকে সেভাবে পাখা দিয়ে বাতাস করি, তা হলে সমস্যা কোথায়?

আইনের সমতা প্রতিষ্ঠা : শাসকের জন্য অপরিহার্য হলো জনসাধারণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা। এমন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যে টাকার বিনিময়ে ইনসাফ ও সমতাকে বিক্রয় করবে না। যার দৃষ্টিতে ধনী ও দরিদ্র সমান হবে। এ ব্যাপারে হজরত আলি (রা.) এর ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে। তার লৌহবর্ম এক ইহুদি ছিনিয়ে নিয়েছিল। হজরত আলি (রা.)-এর শাসনামল চলছিল। তিনি বাদী হয়ে তারই কর্মচারী বিচারপতি শুরাইহের আদালতে মামলা করেন। তিনি সাক্ষী হিসাবে নিজের ছেলে হজরত হাসান এবং নিজের ভৃত্য কুম্বারকে পেশ করেন। বিচারপতি শুরাইহ তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ করতে অস্বীকার করে বলেন, পুত্রের সাক্ষ্য পিতার জন্য এবং ভৃত্যের সাক্ষ্য মনিবের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এতে হজরত আলি (রা.) বলেন, আপনি হাসানের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করছেন! অথচ আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, হাসান ও হুসাইন জান্নাতি যুবকদের সর্দার। জান্নাতি যুবকদের সর্দারের সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করা যায়? বিচারপতি শুরাইহ বলেন, আমরা পৃথিবীতে অবস্থান করছি। আর আপনি জান্নাতের আলোচনা করছেন। আপনি নিজের দাবির স্বপক্ষে অন্য কোনো সাক্ষ্য পেশ করুন। ইহুদি দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করে হয়রান হয়ে যায় যে, ইসলামের সামাজিক সাম্য, সমতা ও ইনসাফ এতটা নির্ভেজাল? যখন আদালত হতে তার দাবি খারিজ হয়ে যায় তখন ইহুদি বাইরে বের হয়ে আরজ করে, আপনার সত্যবাদিতায় কোনো সন্দেহ নেই। এই লৌহবর্ম আপনার। এরপর সে হৃষ্টচিত্তে মুসলমান হয়ে যায়!

খলিফা আবু বকরের বেতন-ভাতা কী ছিল? : রাষ্ট্রনায়কের জন্য অপরিহার্য হলো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও কোষাগারের যথাযথ হেফাযত করা এবং জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করে আত্মসাৎ না করা। প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর আদর্শিক শাসনামল এ ব্যাপারে উত্তম মাইলফলক। তিনি হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর মতো মহান সাহাবির অনুরোধে নিজের জন্য যে ভাতা নির্ধারণ করেন তা এত কম ছিল যার মাধ্যমে ভালো কোনো খাবার পাকাবার ব্যবস্থা করা যেত না। একবার স্ত্রী মিষ্টান্ন খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, আমি এর চেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে নিতে পারি না। এরপর স্ত্রী কম খেয়ে খেয়ে যখন মিষ্টান্নের জন্য কিছু পয়সা সঞ্চয় করেন তখন এই ফরমান লিখে পাঠান, এই পরিমাণ টাকা আমার ভাতা হতে কমিয়ে দেবেন। কেননা, এ পরিমাণ টাকা ছাড়াও আমার দিন চলে যায়! শুধু তাই নয়, নিজের স্ত্রীর সঞ্চয়কৃত টাকাও তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে দেন! আজকের শাসকগণ ক্ষমতাকে আমানত মনে করে না, বরং বাপ-দাদার উত্তরাধিকার মনে করে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে আমানত মনে করে না, বরং গনিমতের সম্পদ মনে করে। এ কারণেই তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করে!

অনুবাদক : আবদুল কাইয়ুম শেখ, শিক্ষক

জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১।