ইতিহাস সমাজ ও জাতির সামগ্রিক চিত্র। কালের দর্পণ। অতীত ইতিহাসের পথ ধরেই নির্মিত হয় ভবিষ্যতের চেতনা, উন্মোচিত হয় নতুন কোনো দিগন্ত। ইতিহাস পাঠ ও চর্চা করা মানেই একটি জাতির অতীত ও বর্তমানকে বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনায় সামনে আনা। এ ইতিহাস পাঠ করতে হলে, ইতিহাসের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার সঠিক প্রক্রিয়া জানা থাকতে হবে। নতুবা ভুল ইতিহাস ভুল নির্দেশনা দিবে। ‘ইতিহাস অধ্যয়নের উসুলি প্রক্রিয়া : স্বীকৃতি ও বিকৃতি’ শিরোনামে গত কিস্তিতে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। আজ এ আলোচনার বাকি অংশ তুলে ধরা হলো :
(গ) তথ্যসূত্রের স্তরর বা ধাপ জানা : প্রত্যেক শাস্ত্রে উৎসসূত্রের গুরুত্ব বিপুল, ব্যাপক। যে কোনো বিষয়ে গাদা গাদা গ্রন্থের রেফারেন্স দিলেই চলবে না, গ্রন্থগুলোকে হতে হবে আকরগ্রন্থ। আবার একই গ্রন্থ সব ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ হবে, তাও নয়। তেমনি ব্যক্তিত্ব বা রিসোর্স পার্সনও গুরুত্বপূর্ণ। সংশি¬ষ্ট বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বরেণ্য এবং কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের স্তর ও অবস্থান জানা থাকতে হবে। সে ভিত্তিতে তাদের রেফারেন্সের প্রভাব ও ক্রিয়াশীলতা স্বীকৃত হবে। প্রত্যেক জাতি ও বিষয়ের ইতিহাসে রয়েছে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। প্রত্যেকের উৎস সূত্রও আলাদা।
(ঘ) স্বভাবগত স্বাভাবিকতা ও প্রাকৃতিক নিয়মাবলির প্রতি লক্ষ্য রাখা : প্রাকৃতিক নিয়মাবলি আল্লাহতায়ালার সুন্নাতে কাওনি বা মহাজাগতিক শরিয়া। এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় না। ব্যক্তিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে, জাতিতে যুগ যুগ ধরে এই সব নিয়মের প্রতিফলন হচ্ছে। প্রকৃতির সহজাত নিয়মের লঙ্ঘন না হওয়াটাই যেহেতু আল্লাহর নিয়ম, তার বিপরীত অস্বাভাবিকতা দিয়ে যেহেতু জগৎ পরিচালিত হয় না। ফলে এই সব অনিয়ম ও অস্বাভাবিকতা ইতিহাসের কোনো স্বাভাবিক বাস্তরবতা নয়। ফিতরতের পরিপন্থি বিষয়, বক্তব্য ও ব্যাখ্যা দিয়ে ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করা হলে সেটা হবে অনৈতিহাসিকতা। মুজিজা ও কারামাতের উপস্থিতি যেখানে থাকবে, সেখানে সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত সূত্র থাকতে হবে। শুধু সম্ভাব্যতা দিয়ে কোনো স্বভাববিরুদ্ধ বিষয়কে আরোপ করে ঐতিহাসিকতাকে কল্প-কাহিনীর স্তররে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে কবুল করে না মুসলিম ইতিহাসকলা। বস্তুত মুসলিমদের ইতিহাস চর্চার বড় বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তরবতা ও স্বভাবসম্মত ঐতিহাসিক নীতিমালা। ইসলামপূর্ব যুগে ইতিহাসের উপর অলৌকিকতার প্রাধান্য ছিল। তা ছিল লোককথনের লিখিতরূপ। মুসলিম ইতিহাসকলা একটি ঘটনাকে সমস্তর প্রাকৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিতভাবে বিচার করে। এমনকি যে এলাকায় তা ঘটেছে, সেটা গ্রীষ্মপ্রধানা শীতপ্রধান, সেটাও ভুলে না। এতে মানুষ ও মেজাজ কীভাবে প্রভাবিত ও রূপায়িত হতে পারে, সেটাও খেয়ালে রাখে।
(ঙ) গ্রন্থকারের দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান ও রচনাপদ্ধতি অবগত হওয়া : গ্রন্থকারের লেখার নীতি ও চিন্তা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। একজন শিয়া ও একজন সুন্নীর কাছে মুসলিম ইতিহাসের একই ঘটনা একইভাবে ধরা দেয় না। বিশেষত যখন তারা ঘটনার বিশ্লেষণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে নিজস্ব রঙ চড়িয়ে ঘটনাগুলোর বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও ফলাফলকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে নেওয়ার প্রবণতা ইবনে সাবার অনুসারিরা শুরু করে। একে নতুন মাত্রা দেয় খারিজিরা। এর মাধ্যমে খারেজিরা রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করে। যার কেন্দ্রমূলে ছিল নিজেদের আকিদার আলোকে কোরআন-সুন্নাহের নিজস্ব চিত্রায়ন এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির রঙ লাগানো। একে নিজেদের আকিদা ও রাজনৈতিক অবস্থানের অনুকূলে কাজে লাগানো। শিয়াদের ইতিহাসচর্চা এই বিষয়টাকে স্থায়ী ভেদনীতির বিষয়ে পরিণত করে। নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ ও অবস্থানের আলোকে কাউকে মহিমান্বিত, কাউকে তিরস্কৃত করতে চেয়েছে পছন্দের ইতিহাসবিদদের মধ্যস্তরতায়। আবার সালাফি প্রবণতা নিজেদের ধারা ও ঘরানার বয়ানগুলোকে এতো তীব্রভাবে সত্য ও একমাত্র সত্য বলে ধরে নেয়, যা এক ধরনের আকিদার চরিত্র লাভ করে।
এ জাতীয় ইতিহাস চর্চা শেষ অবধি ঐতিহাসিকতা থেকে বিচ্যুত হয়, বিকৃতিকে চাপিয়ে দেয়। কিন্তু মুসলিম ইতিহাসকলা ভারসাম্য ও সত্যসন্ধানের যথার্থতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্নে। এমনকি কেউ যদি শিয়াদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করেন, তাকেও বলা হয়েছে গালি বা গোড়া শিয়াবিরোধী, কেউ যদি সুন্নীদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করেন, তার ব্যাপারেও সত্য উচ্চারণ করেছেন প্রকৃত ঐতিহাসিক, যদিও তিনি শিয়া হয়ে থাকেন। এখানে অবশ্য ইবনে সাদ, তাবারি, ওয়াকেদি, যাহাবি, ইবনে কাসির, ইবনে কুতাইবা, দিনাওয়ারী, মাসউদি, আল বেরুনি, ইয়াকুবি, বালাজুরি, খতিবে বাগদাদি, ইবনুল আসির, ইবনে আসাকির, ইবনে খাল্লিকান, ইবনে খালদুন, মিনহাজ উস সিরাজ, আবুল কাসেম ফেরেশতা থেকে নিয়ে আধুনিককালের শিবলি নোমানি, সোলায়মান নদবি, ত্বহা হোসাইন, আমীর আলী, শাকির আরসালান, সুহাইল তাক্কুশ প্রমুখের ঐতিহাসিক পদ্ধতি ও সবলতাণ্ডদুর্বলতা আলোচনার আওতায় আসবে। যখন আপনি ইউরোপ, আমেরিকা, চীন কিংবা রাশিয়ার ইতিহাস নিয়ে বলবেন, সেখানেও রয়েছে কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিত্ব, স্বতসিদ্ধ গ্রন্থ, প্রামাণ্যতার ঐতিহ্য এবং তর্কাতর্কি। অন্য জাতির ইতিহাস চর্চায় তাদের স্বীকৃত উপাদানগুলোকে অবিকৃত ও যথাযথভাবে কাজে লাগানো মুসলিম ইতিহাসের শিক্ষা। ইবনে জরীর তাবারি, ইবনে হাযম, ইমাম বায়হাকি, আল বেরুনি প্রমুখের ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে রয়েছে এর স্পষ্ট প্রতিফলন।
(চ) বিবরণের পূর্ণতা : ইতিহাসের ঘটনাগুলির আংশিক ও খণ্ডিত বিবরণ সমস্যা তৈরি করে। উদ্বৃতিগুলো খণ্ডিত হলে আরো জটিলতা তৈরি হয়। তা ঘটনাবলির প্রতি এমন মনোভাব তৈরি করে, বাস্তবতার সঙ্গে যার আছে ভিন্নতা। এ প্রক্রিয়া মানুষ ও সত্যের প্রতি অবিচার করে। এমন বিবরণের শিকার হলে যে কেউ আব্বাসীয় রাষ্ট্রকে হিংস্র, কঠোর ও স্বৈরাচারী হিসেবে দেখবে। আব্বাসি বিরোধীদের বক্তব্যকে সে অনুসরণ করবে। গোটা শাসনামলকে অন্যায়ভাবে বিচার করবে।
কেউ যদি শুধু সামরিক তথ্যের আলোকে উসমানি সালতানাতের দিকে তাকায়, সে ভুলভাবে বিচার করবে। তার মনে হবে উসমানীয়রা শুধু সামরিক দিকগুলোতে সফল হয়েছিল এবং অন্য সমস্তর দিকগুলোতে ব্যর্থ হয়েছিল।
কেউ যদি জায়দি, ইমামি কিংবা বাতেনি-ইসমাইলি শিয়া রাষ্ট্রগুলোকে বিশ্বাসের দিকে না তাকিয়ে শুধু বাহ্যিক কৃতিত্বের দিক থেকে দেখে, তাহলে সে ভুল বিচার করবে। সে দেখবে সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তাদের কতো প্রভাব! অপরদিকে সে তাদের বিপজ্জনক দিকগুলোর প্রশ্নে অন্ধ থেকে যাবে। অতএব, এখানে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব যেমন আলোচ্য, তেমনি আকিদার বিপজ্জনক প্রয়োগ সম্পর্কেও আলোচনা হচ্ছে ঐতিহাসিকতার দাবি।
(ছ) পরিভাষার ব্যবহার : প্রতিটি জাতি, ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শাস্ত্রের স্বতন্ত্র পরিভাষা রয়েছে। এগুলোকে যথাস্থানে ব্যবহার করতে হবে। পরিভাষার অপপ্রয়োগ বা ভ্রষ্ট ব্যবহার চলবে না। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে যুক্ত আছে তার ঐতিহ্য। পরিভাষাগুলো, আপন অর্থ, কৃতিত্ব এবং মাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। ইসলামের পরিভাষাগুলোর সুষ্ঠু, পূর্ণাঙ্গ ও যথাস্থানে যথাযথ ব্যবহার ঐতিহাসিকতার দাবি।
(জ) সাধারণীকরণ পরিহার : সাধারণীকরণের পদ্ধতি ঐতিহাসিকতার শত্রু। কেউ যদি দেখান, বিদ্রোহীরা প্রতিরোধ ছাড়া হজরত উসমান (রা.) কে হত্যা করতে পারল। ফলে বুঝা যায়, মদিনার সব লোক উসমান বিন আফফানকে সমর্থন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন অথবা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন! এমন সিদ্ধান্ত যেমন অনৈতিহাসিক, তেমনি কোনো এক কালের দু’চারজন কবির কবিতা দিয়ে সে সময়ের সব মানুষের নৈতিকতা বিচার করাও শিশুসুলভ। দু-একজন ব্যক্তি, দু-চারটি ঘটনা বা সমকালিন বাস্তবতার বিচ্ছিন্ন কোনো প্রবণতাকে প্রধান বিষয় বানিয়ে গোটা সময়কালকে এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা এমন এক অন্যায়, যা মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে সংগঠিত হয় দেদার। এরকম অনৈতিহাসিক ও জ্ঞানবিরোধী সাধারণীকরণের ক্ষতি থেকে সাবধান থাকবেন ইতিহাস লেখক, ইতিহাসের পাঠক।
(ঝ) ঘটনাবলির ব্যাখ্যায় গ্রন্থকার নিজের মসলক, মানসিক ঝোক ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারক না হওয়া : নিরপেক্ষ, সত্যনিষ্ঠ ও নির্মোহ অবস্থানে থাকা। ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে ব্যাখ্যাকারীর চিন্তা-চেতনা ও পারিপার্শিকতার সম্পর্ক প্রগাঢ়।
লেখক : কবি ও গবেষক