নতুন বছরকে ঘিরে সবার মাঝেই কম বেশি পরিকল্পনা কাজ করে। বিগত বছরের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে নতুনভাবে নতুন উদ্যমে কাজ করার প্রেরণা কাজ করে আর সেই প্রেরণা থেকেই সাজানো হয় বছরব্যাপী কাজের পরিকল্পনা। যাকে বলা হয় ‘নিউ ইয়ার রেজুলেশন’। একজন মুসলিমের নিউ ইয়ার রেজুলেশন কেমন হওয়া উচিত? মুসলিমের নিউ ইয়ার রেজুলেশন কেমন হওয়া উচিত, সেটা বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে একজন মুসলিমের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী। পবিত্র কোরআনে আমরা-এর উত্তর পাই- আল্লাহতায়ালা বলেন,
আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬)।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন : বলো, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, যিনি কুল মাখলুকাতের প্রতিপালক। (সুরা আল আনআম : আয়াত ৬২)। অর্থাৎ একজন মুসলিমের সব কাজই হতে হবে ইবাদাত তথা আল্লাহকে রাজি-খুশি করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টাই কি আল্লাহর ইবাদত করা সম্ভব? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, সম্ভব। রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় সব কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। (সহি বোখারি) অর্থাৎ যেকোনো ভালো কাজ সেটা শুধু যদি আল্লাহকে খুশি করার নিয়তে করা হয়, তবে তা ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে।
নিউ ইয়ার রেজুলেশন কেমন হওয়া উচিত : বিগত বছরের ভুলগুলো চিহ্নিত করা ও শোধরানো। বিগত বছরে কৃত ভুল-ভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করা এবং তা সংশোধন করা। কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে বা ঠকালে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া, ঝগড়া মিটিয়ে ফেলা, ক্রোধ-হিংসা পরিহার করা, ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদিসহ ভুলগুলো চিহ্নিত করে তা পরিহার করা। নতুবা কাল হাশরের ময়দানে এ ছোট্ট বিষয়ের জন্যই নিজের অর্জিত পাহাড়সম আমল খোয়াতে হবে।
বলা হয়- ‘তীরের ক্ষত শুকিয়ে যায়, তবে মুখের কথার আঘাত শুকায় না’ আর ‘কথার আঘাত রূহ পর্যন্ত পৌঁছায়’। এ বিষয়ে হাদিসে হুঁশিয়ারি এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবীদের বললেন,
তোমরা কি জানো, নিঃস্ব কে? তারা বললেন, আমরা তো নিঃস্ব বলতে তাকেই বুঝি, যার কোনো ধন-সম্পদ নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, না, নিঃস্ব সে নয়, প্রকৃতপক্ষে নিঃস্ব সে, যে কেয়ামতের দিন অনেক নামাজ-রোজা-জাকাতের নেকি নিয়ে আসবে, কিন্তু দুনিয়াতে সে একে গালি দিয়েছে, ওকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এর মাল জোর করে দখল করেছে, ওর রক্ত প্রবাহিত করেছে, তাই সব মাজলুম সেসব জুলুমের বদলা নিতে আসবে। আল্লাহ তখন জুলুমের বদলা হিসেবে তার নেকিগুলো মাজলুমদের দিয়ে দিবেন। একপর্যায়ে তার সকল নেকি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু জুলুমের বদলা নেওয়া এখনো শেষ হবে না। তখন মাজলুমের গোনাহগুলো চাপিয়ে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম : ২৫৮১)। তাই নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে আল্লাহর প্রিয় হওয়ার, আরো তাকওয়া, আরো সবর, আরো শুকরিয়া আদায় করার চেষ্টা করা। নিজের নামাজ, সাদাকা এবং নফল আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া।
ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করা : রাসুল (সা.) বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ইলম অর্জন করা ফরজ। (মুসনাদে আবু হানীফা (হাছকাফী), হাদীস ১, ২; সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪)।
বিশিষ্ট তাবেয়ি উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে সে সঠিকভাবে যতটুকু না করবে, বরবাদ করবে তার চেয়ে বেশি। (তারীখে তাবারী ৬/৫৭২)। তাই ইসলামের বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তাকে জানতে হবে ঈমান-আক্বিদা, আখলাক, হালাল-হারাম ইত্যাদি বিষয়ে। এছাড়াও মাসে তিন দিনের জন্য তাবলীগে বের হওয়া, জুমার নামজে আগে আগে উপস্থিত হয়ে খতিবের বয়ান শোনা, গ্রহণযোগ্য আলেমদের বয়ান শোনা এভাবে বিভিন্নমাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে থাকা।
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া : ব্যস্ততা বা সুযোগের অভাবে অনেক সময় আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয় না। এতে সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায় অথচ হাদিসে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মুসা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। অভ্যস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও যাদুতে বিশ্বাসী’। (আহমদ : ১৯৫৮৭; হাকিম, :৭২৩৪; ইবন হিব্বান : ৫৩৪৬)।
কোরআনুল কারিম শুদ্ধভাবে শেখা এবং কিছু সুরা মুখস্থ করা ও বুঝা : প্রতিটি মুসলিমেরই কোরআন মাজিদ শুদ্ধভাবে শেখা উচিত। কেননা, কোরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ না হলে সালাত শুদ্ধ হবে না আর সালাত শুদ্ধ না হলে সে আখিরাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় কেয়ামতের দিন বান্দার (হককুল্লাহর মধ্যে) যে কাজের হিসাব সর্বপ্রথম নেওয়া হবে তা হচ্ছে তার নামাজ। সুতরাং যদি তা সঠিক হয়, তাহলে সে পরিত্রাণ পাবে। আর যদি (নামাজ) খারাপ হয়, তাহলে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (আবু দাউদ ৮৬৪, তিরমিযি ৪১৩, ৪৬৫, ৪৬৬, ৪৬৭, দারেমি: ১৩৫৫)। এক্ষেত্রে কোরআন শিক্ষা অর্জনের জন্য কোনো বিজ্ঞ আলেমের সাহচর্য নিতে পারি। আর কোরআন শুদ্ধভাবে পড়তে পারলে প্রতিদিন ৫ আয়াত করে অর্থসহ মুখস্থ করা যেতে পারে। কোনো বিজ্ঞ আলেমের তত্ত্বাবধানে তাফসিরও পড়া যেতে পারে। এতে কোরআনের মর্ম বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা সহজ হয়ে যাবে। এভাবে প্রতিদিন অন্তত একটি হাদিস পড়া যেতে পারে।
সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেওয়া : একজন ভালো মুসলিম মাত্রই একজন ভালো মানুষ। সে সর্বদা কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে জড়িতে রাখে। অপরের মঙ্গলে, মানবতার স্বার্থে সে অবদান রাখে। এক্ষেত্রে একজন মুসলিম যেকোনো কল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে কাজ করতে পারে। যেমন : অসহায়দের খাবার দান, বস্ত্রহীনদের বস্ত্রদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়া, রক্তদান, পথ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বেশি বেশি গাছ লাগানো, রাস্তা-পুল মেরামতে সহায়তা করা, এতিম-অভাবগ্রস্ত-মজলুমদের সহায়তা করা ইত্যাদি কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ও সাধ্যমতো অংশগ্রহণ করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ বান্দাকে ততক্ষণ সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে।’ (মুসলিম)
নিজের দক্ষতা বাড়ানো : বর্তমান বিশ্ব অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। তাই নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। মোমেন হিসেবেও এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা চলবে না। সময়োপযোগী বিষয়গুলো যেমন : নতুন কোনো ভাষা শিখা ও তাতে দক্ষ হওয়া, বর্তমান চাহিদা অনুসারে আইটি স্কিল, কমিউনিকেশন স্কিল, কম্পিউটার স্কিল, ওয়েব ডিজানিং, ভিডিও এডিটিং ইত্যাদি বিষয়ে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে।
ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী হওয়া : মুসলিমদের সম্পদশালী হতে নিরুৎসাহিত করতে দেখা যায়, তারা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি বুঝাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। এটা ঠিক নয়। কেননা, সম্পদ হারাম না, তবে সম্পদের মুহাব্বত হারাম। উসমান (রা.), আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা.)সহ অনেক সাহাবি সম্পদশালী ছিলেন। তবে তারা সম্পদপ্রেমী ছিলেন না, তাদের প্রচুর সম্পদ থাকলেও তারা দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে হারাম পথে উপার্জন করা চলবে না আবার দ্বীনের মৌলিক হুকুম (নামাজ, রোজা, জাকাত, আল্লাহর রাস্তায় অংশগ্রহণ ও ব্যয়) বাদও দেওয়া যাবে না। একজন মুসলিম সম্পদ উপার্জন ও ইসলাম পালনে যথাযথ ভারসাম্য পালন করবে।
ইসলামের প্রচার প্রসারে কাজ করা : মুসলিম হিসেবে ইসলামের প্রচার-প্রসারে কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ওই ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয়ই আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম সমান নয়। প্রতিউত্তর নম্রভাবে দাও, দেখবে তোমার শত্রুও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে পরিণত হয়েছে’ (হা-মীম সিজদা : ৩৩-৩৪)।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদের মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে। (সুরা আলে ইমরান : ১১০)। অর্থাৎ ইসলামের প্রচার-প্রসারে কিছু না কিছু প্রত্যেক মুসলিমেরই দায়িত্ব। সাহাবীরা এ কাজ করার মাধ্যমেই সম্মানিত হয়েছেন এবং মুসলিমরা এ কাজ করার মাধ্যমেই একসময় স্পেন হতে ভারতবর্ষ পর্যন্ত শাসন করেছিল।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।