অশ্লীলতার পরিণতি ভয়াবহ

মুহাম্মাদ আবু আখতার

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান যুবসমাজ অশ্লীলতার ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। প্রেম-ভালোবাসার নামে তারা বিবাহ-পূর্ব অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। শিল্প-সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান প্রকাশ্যে চলছে। গাইরে মাহরাম যুবক-যুবতী বেপর্দায় অবাধে একসঙ্গে চলাফেরা করছে। তারা টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইলে অশ্লীল নাটক-সিনেমা ও পর্নোভিডিও দেখছে। ঘরে বাইরে সব জায়গায় তারা অশ্লীল গানবাজনা শুনছে। মেয়েরা বেপর্দা হয়ে সেজেগুজে অশ্লীলভাবে চলাফেরা করছে। বখাটেরা সুযোগ পেলে মেয়েদের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করছে। তুচ্ছ কারণে পরস্পরকে অশ্লীল গালিগালাজ করছে। আরো কত যে জঘণ্য ধরনের অশ্লীলতার প্রসার ঘটছে তা বর্ণনাতীত। বর্তমান যুগে যারা যত বেশি নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা প্রদর্শন করতে পারে, তাকে তত বেশি আধুনিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আর যারা অশ্লীলতার বিরোধিতা করে তাদের সেকেলে ও পশ্চাৎপদ হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা সবধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইরশাদ করেন ‘আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়গুলো হারাম করেছেন।’ (সুরা আ’রাফ : ৩৩)। অশ্লীলতার ফলে মানুষ তাদের চারিত্রিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে চারিত্রিক কদর্যতা বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি হাদিসে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। হজরত আনাস (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা কোনো জিনিসের শুধুমাত্র কদর্যতাই বাড়িয়ে দেয়। আর লজ্জা কোনো জিনিসের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। (তিরমিজি : ১৯৭৪)।

অশ্লীলতা মুনাফিকীর লক্ষণ। যারা সত্যিকার ঈমানদার তারা কখনো অশ্লীল কাজ করতে পারে না। কেননা, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা আছে সে অশ্লীল কাজে সংকোচ বোধ করে। হজরত আবু উমামা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লজ্জা-সম্ভ্রম ও অল্প কথা বলা ঈমানের দুইটি শাখা। অশ্লীলতা ও বাচালতা নিফাকের (মুনাফিকীর) দুইটি শাখা।’ (তিরমিজি : ২০২৭)।

কালের অশ্লীলতা : বর্তমান যুগে নাটক-সিনেমার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মুসলমানদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এসবের মধ্যে বিবাহপূর্ব অবৈধ প্রেম-ভালোবাসাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়াও অনেক শিল্পগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে অশ্লীল নাচ গানের মাধ্যমে অশ্লীলতার প্রসার ঘটাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে জনসম্মুখে বিলবোর্ডে এবং সংবাদপত্রের বিনোদন পাতায় অশ্লীল ছবির বিজ্ঞাপন ও সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে বেপর্দা মেয়ের ছবি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের ফ্রি মিক্সিং-এর ছবি রয়েছে। এসব ছবিতে মেয়েদের মাথা, মুখ, বুক, পিঠ ইত্যাদি স্পর্শকাতর অঙ্গ খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া ঈদ, বিয়ে, আকিকা ইত্যাদি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবেও বিনোদনের নামে অশ্লীল গানবাজনা ও নারী-পুরুষের বেপর্দায় অবাধ মেলামেশা চলে। অনেক জায়গায় এসব উপলক্ষ্যে সাউন্ড বক্স এনে রাতভর উচ্চ স্বরে গানবাজনা বাজানো হয়। এছাড়া শীতকালে পিকনিকের নামে সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গানবাজনার কারণে ঠিকমত ঘুমানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এসব অপসংস্কৃতির প্রভাবে মুসলিম যুবসমাজ ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করে অশ্লীলতার সাগরে হাবডুবু খাচ্ছে। যারা মুসলিম সমাজে অশ্লীলতা প্রসার করতে পছন্দ করে আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মোমেনদের মাঝে অশ্লীলতা প্রসার করতে ভালোবাসে তাদের জন্য ইহাকালে ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। (সুরা নুর : ১৯)।

অশ্লীলতার শাস্তি : অশ্লীলভাবে বেপর্দায় চলাফেরার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এক নারীকে শাস্তি স্বরূপ রজম বা পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার হুকুম দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ থেকে অশ্লীলতার জঘন্যতা ও ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি যদি কাউকে সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া রজম করতাম, তবে অবশ্যই অমুক নারীকে রজম করতাম। কেননা, তার কথাবার্তায় ও দৈহিক বেশভূষায় এবং যারা তার কাছে যাতায়াত করে তাদের থেকে অশ্লীলতা প্রকাশ পেয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৫৫৯)। অশ্লীলতা মহাজুলুম তথা মহাঅন্যায়। আর অশ্লীলতার শেষ পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম। তাই জাহান্নামের ভয়ানক শাস্তি থেকে বাঁচতে হলে অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা আবশ্য। হজরত আবু বাকরা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের অবস্থান হলো জান্নাতে। আর অশ্লীলতা হলো জুলুম, আর যার মধ্যে জুলুম থাকবে সে জাহান্নামী।

(সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১৮৪)।

বদকারের পাপে নেককারও ধ্বংস হয় : কোনো সমাজে যখন অশ্লীলতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন বহু নেক লোক থাকা সত্ত্বেও সেখানে আল্লাহর শাস্তি অবতীর্ণ হয়। তখন নেক্কার বদকার সব লোকই ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। তাই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে হলে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে হজরত জায়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) বলেন, একদা নবী (সা.) ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়তে পড়তে তার গৃহে প্রবেশ করলেন এবং বলতে লাগলেন, শিগগিরই একটি দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হবে। এতে আরবের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। ইয়াজুজ ও মাজুজের দেওয়ালে এতটুকু পরিমাণ ছিদ্র হয়ে গিয়েছে, একথা বলে দু’টি আঙুল গোলাকার করে দেখালেন। যায়নাব (রা.) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কি ধ্বংস হয়ে যাব, অথচ আমাদের মধ্যে বহু নেককার ব্যক্তি আছেন?’ নবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ, যখন অশ্লীলতা বেড়ে যাবে। (সহি বোখারি : ৩৫৯৮)। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে অশ্লীলতা থেকে হেফাজত করুন এবং অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), রাজার ভিটা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, চিলমারী, কুড়িগ্রাম।