সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থা

সংকট মোকাবিলায় আমরা কী করতে পারি?

আবদুস সাত্তার আইনি

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কোনো সন্দেহ নেই যে, ইসলাম বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক ও সংকটপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে। মুসলিম উম্মাহ বর্তমান সময়ে যেসব সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, অতীত ইতিহাসে এ ধরনের সংকট ও সমস্যা কখনো দেখা দেয়নি। মুসলিম উম্মাহ ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত সার্বিক দিক থেকে সমস্যা ও জটিলতাহীন সময় যাপন করেছে তা কখনো হয়নি। রাসুলে আকরাম সা. এর নবুয়তপ্রাপ্তির পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি বছরেই বিভিন্ন সংকট ও জটিলতার মোকাবিলা করতে হয়েছে। এবং আজ পর্যন্ত এমন কোনো শতাব্দ নেই, এমন কোনো দশক বা বছর নেই যখন মুসলিম উম্মাহকে সংকটে পড়তে হয়নি। কিন্তু বর্তমান সময়ে যে সংকট ও সমস্যা তার সঙ্গে পূর্ববর্তী সময়ের সমস্যা ও সংকটগুলোর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অতীত সমস্যাগুলো জীবনের কোনো না কোনো বলয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। মুসলমানদের হয়তো কোনো অভিযানের মোকাবিলা করতে হয়েছে, তারা হয়তো জয় ছিনিয়ে এনেছে অথবা পরাজয় বরণ করেছে, অথবা পিছু হটে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। কখনো মুসলমানদের রাজ্যশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, কখনো শত্রুরা তাদের প্রতি চোখ রাঙিয়েছে, কখনো তাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। অথবা মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং এতে মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বলয়ে কখনো তাদের প্রভাব ও প্রতাপ কমে এসেছে, অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এসব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সঙ্কটের একটা সাধারণ চরিত্র ছিলো এবং মুসলিম উম্মাহ প্রতিটি যুগেই সেসব সঙ্কটের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রতিটি যুগে মুসলমানদের পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক বন্ধন, শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-আখলাক, শিষ্টাচার, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য অটুট ছিলো। চিন্তাগত, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক আক্রমণ ও আগ্রাসন থেকে মুসলিম উম্মাহ ও তাদের সন্তানরা সুরক্ষিত ছিলো। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা ও প্রেক্ষিত বদলে গেছে। গত দেড়শো বছর ধরে এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। এই সময়টাতে এমন কোনো বছর, এমন কোনো যুগ যায়নি যখন নতুন কোনো সমস্যার উদ্ভব ঘটেনি। ইসলামি জীবনব্যবস্থার এমন কোনো দিক ছিলো যা সংকটের মুখোমুখি হয়নি। ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন, মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্ক, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, তালিম-তারবিয়ত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিন্তাধারা ও মানসগঠন, সর্বোপরি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার প্রতিটি বিষয় পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। তাতাররা মুসলমানদের ওপর বিপর্যয় ঘটিয়েছিলো বটে, কিন্তু তারা মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা-চিন্তাধারা নিয়ে মাথা ঘামায়নি : আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হবে এবং কী পড়ানো হবে না তা নিয়ে তারা কথা বলেনি; মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যসূচিতে কী কী বিষয় থাকবে এবং কী কী বিষয় থাকবে না তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিলো না। মোটকথা, ইসলামের সেসব যুগে বিধর্মীরা বা মুসলিম বিশ্বে আক্রমণকারীরা মুসলমানদের আদব-আখলাক-শিষ্টাচার নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ইংরেজরাও উপমহাদেশে (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে) আধিপত্য বিস্তারের পর বহুদিন পর্যন্ত এদিকে দৃষ্টি দেয়নি। তাই তাদের আধিপত্য বিস্তারের একশো বছরেরও বেশি সময়ে, প্রায় দেড়শো বছর পরও মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ শক্তি অটুট ছিল, পাশ্চাত্যের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। লাখ লাখ নয়, বরং কোটি কোটি মানুষও এমন ছিলো যাদের জীবনের কোনো একটি দিকও ইংরেজদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়নি। তারা বিধর্মীদের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত প্রভাব তো দূরের কথা, একটি শব্দকেও তাদের ঘরে ঢুকতে দেয়নি। মুসলমানদের পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য হাজার হাজার মানুষ লড়াই করেছেন, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

আজ থেকে একশ’-দেড়শ’ বছর আগে বিধর্মীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষার যে প্রত্যয় ও সচেতনতা ছিল বর্তমান সময়ে তা সমূলে বিনষ্ট হয়েছে এবং মুসলমানদের প্রত্যেক গৃহদ্বার পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অভিনন্দন জানানোর জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। পশ্চিমা চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির ভালো বা মন্দ প্রভাব থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার কোনো প্রতিবন্ধক অবশিষ্ট নেই। কেউ কেউ চিন্তা করেন যে, পশ্চিমা জ্ঞান ও চিন্তাধারা এবং সংস্কৃতির ভালো দিকটাকে আমরা গ্রহণ করব এবং খারাপ দিকগুলোকে রুখে দাঁড়াব। এটি একটি সঠিক চিন্তা এবং কোনো মুসলমানের এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণের কারণ নেই। কারণ ‘যা-কিছু ভালো তা গ্রহণ করো এবং যা-কিছু মন্দ তা পরিত্যাগ করো’ নীতির ব্যাপারে সব মুসলমানের ঐকমত্য রয়েছে। মুসলিম জাতির চিন্তা ও কর্মের ইতিহাসও এই নীতির সপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, আমরা না জানলেও বা সচেতন না হলেও পশ্চিমা বিশ্বের সিদ্ধান্তও হলো মুসলমানরা ‘ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জনের’ ভিত্তিতে কাজ করুক। তবে কি তারা যা-কিছু আমাদের জন্য উপযুক্ত তা আমাদের পাতে তুলে দেবে এবং যা কিছু আমাদের জন্য উপযুক্ত নয় তা আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? না, তা নয়। আসলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে আমাদের চেয়ে তারাই বেশি চিন্তা করে এবং তারা জানে যে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির কোন কোন বিষয় আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্য উপকারী এবং কোন কোন বিষয় ক্ষতিকর। তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে সাধারণ পর্যায়ে যে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে তা নয়, বরং উচ্চ পর্যায়ে ও গুরুত্বপূর্ণ বলয়ে চিন্তা-ভাবনা হয়েছে এবং বই লেখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন তার ঝবরুব Seize the Moment: America’s Challenge In A One-Superpower World বইয়ে দেখিয়েছেন, মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা জীবনধারা ও সংস্কৃতির প্রভাব কতটুকু আছে এবং কতটুকু থাকা উচিত। কেবল নিক্সন নন, তাদের বড় বড় চিন্তাবিদ, মনীষী ও লেখক এ ব্যাপারে কথা বলেছেন ও লিখেছেন।

পশ্চিমা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করা ও না করার ব্যাপারে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিন ধরনের মত রয়েছে।

১। কিছু মানুষ আছেন যারা তাদের পরিবার ও সমাজে পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারের একটি শব্দও প্রবেশ করতে দেবেন না এবং তারা মনপ্রাণ দিয়ে বিধর্মী কৃষ্টি-কালচার ঘৃণা করেন। আমার ধারণা, বর্তমান সময়ে এই শ্রেণির মানুষ খুব কমই আছেন। তাছাড়া তাদের এই চিন্তাধারাকে কট্টর গোঁড়ামি ও অনুপকারী মনে করা হয়। এক সময় হয়তো পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারবিরোধী এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

২। ‘পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারে গা ভাসিয়ে দেওয়া এবং জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে তাদের মতো হয়ে ওঠা’র সর্বগ্রাসী নীতিও প্রচার করেছেন কিছু মানুষ এবং ইদানীং এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা অনেক। যারা এমন চিন্তা পোষণ করেন তারা মনে করেন, পাশ্চাত্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তাদের পায়ের সঙ্গে পা রেখে চললে মুসলমানদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এই মত সমর্থন করেন না। ১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ শতকের শুরুতে কতিপয় রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন যাঁরা উপর্যুক্ত মত ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে উচ্চ পর্যায়ে এ ধরনের চিন্তা পোষণকারী ব্যক্তির সংখ্যা নগণ্য বলেই মনে হয়।

৩. ‘যা-কিছু ভালো তা গ্রহণ এবং যা-কিছু মন্দ তা বর্জন’ (ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন নীতি) শুরুর দিকে একশ’-দেড়শ’ বছর আগে দুর্বল ছিল; কিন্তু এখন এই চিন্তা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকতা লাভ করেছে। মুসলিম চিন্তাবিদ এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির একটা বড় অংশ এই মত পোষণ করে থাকেন। তারা মনে করেন, ‘ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন’ নীতির ভিত্তিতে মুসলমানদের পশ্চিমা সংস্কৃতির ভালো দিকগুলো গ্রহণ করা উচিত। তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদ মুসলমানরাও গ্রহণ করুক। ইউরোপ-আমেরিকার মানুষেরা তাদের জীবনযাত্রাকে বিজ্ঞানের দানে ও প্রযুক্তির ব্যবহারে যেভাবে সহজতর ও উন্নত করে তুলেছে, মুসলমানরাও তাদের জীবনযাত্রাকে সেভাবে বিন্যস্ত করে নিলে তাদের জীবন আধ্যাত্মিকতা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সমন্বয়ে আরো বেশি সুখকর ও কল্যাণময় হয়ে উঠবে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের যা-কিছু মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক যেমন : চারিত্রিক মানদ-, বিবাহবন্ধন, যৌথ পরিবার, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে তাদের চিন্তাধারা, সেক্যুলারিজম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মহীনতা, যৌনতাচর্চার স্বাধীনতা মুসলিম বিশ্বের জন্য তা গ্রহণ করা কিছুতেই উচিত হবে না।

শুরুর দিকে এই চিন্তা নির্দিষ্ট বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও এই সময়ে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য মানুষ এই মত পোষণ করে থাকেন।

‘ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন’ করতে হলে যা যা দরকার তা হলো ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানদের সঠিক চিন্তা-ভাবনা, ইসলামের যথার্থ জ্ঞান এবং একনিষ্ঠ প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয়। সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো মুসলিম বিশ্বে ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক ও কার্যকরী চর্চা ও বিস্তার। যদি শরিয়তের জ্ঞান ও শরিয়ত-নির্দেশিত জ্ঞান-বিজ্ঞানে মজবুত ভিত্তি তৈরি করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে তার ওপর ইমারত নির্মাণ করা যাবে না।

(বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক, আবদুস সাত্তার আইনির টাইম লাইন থেকে)