রাসুল (সা.) নবীরূপে প্রেরিত হওয়ার সময় আরব দেশে সাহিত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদান ছিল। তৎকালীন সমাজে-আসমায়ীর বর্ণনা মতে- কবিদের সামাজিক অবস্থান ছিল মোমেন সমাজে নবীদের অবস্থানের মতো। এ কারণেই তখন কাফেররা সাহিত্যকে ইসলামের দাওয়াতের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছিল। এরূপ অবস্থায় মুসলিম কবিরাও ইসলামের দাওয়াতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। এদেরই একজন হলেন হাকিম ইবনে উমাইয়্যা। তিনি মক্কায় বনি উমাইয়্যা ইবনে আবদ শামসের বন্ধু হিসেবে বসবাস করতেন। তাদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন, সমাজে মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম?-এর পক্ষাবলম্বন করে কবিতার চারটি চরণ লিখেছিলেন। ইবনে ইসহাক ও ইবনে হেশাম তাদের সীরাত গ্রন্থে তা সংকলন করেছেন। তিনি কবিতার চরণগুলোতে তার নিজের গোত্রকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন যে, তারা যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরোধিতা করছে, তার প্রতি অসদাচরণ করছে, তার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও শত্রুতামূলক আচরণ করছে, তা ঠিক নয়। এ বিষয়ে তিনি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার অবস্থান মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে। এমনকি এ বিষয়ে তাকে তাদের আগের বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে হলে তিনি তাই করবেন। তারা যে তাকেও এজন্য হুমকি দিচ্ছেন তিনি তার জন্য ভীত ও সন্ত্রস্ত নয়। কারণ এখন তিনি আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : ‘সত্যের ওপর অটল কোনো সত্য কতক আছে কি? কোনো ক্রুদ্ধ হেদায়াতের বাণীর শ্রোতা আছে কি? এমন কোনো ভদ্রলোক আছেন কি নিকটবর্তী আত্মীয় ও দূরবর্তী লোকেরা যার সান্নিধ্যে কল্যাণ আশা করতে পারে? আমি নিজেকে অবমুক্ত করে নিয়েছি, তোমাদের শত্রুতামূলক আচরণ থেকে। তোমরা তার (মুহাম্মদের) প্রতি শত্রুতা করতে থাকলে আমি তোমাদের ছেড়ে যাব, আমি আমার মুখমণ্ডল ও কণ্ঠস্বর এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করব, এমনকি বন্ধু-বান্ধবদের পক্ষ থেকে কোনো ভীতিকর সংবাদ আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করলেও।
এভাবেই কবিতা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। মুসলমানের মনোবল শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করেছিল। তাদের নতুন ধর্ম ইসলাম গ্রহণে সাহস জুগিয়েছিল। এতসব হয়েছিল মক্কায়। আর যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে একটা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, মুসলমানরা সে রাষ্ট্রের ছায়াতলে নিরাপদে স্বাধীনভাবে তাদের ইবাদত-বান্দেগি করতে লাগলেন। কিছুটা আরাম-আয়েশে বিনা বাধায় দিনযাপন করতে লাগলেন, তখন মক্কার সকল মুশরিক তাদের শিকড় আমূলে উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। তারা মদিনার দিকে তাদের সেনাবাহিনী প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তাদের বাড়ি ঘরে গিয়ে তাদের সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগ নিল এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করল। তখন তাদের কবি-সাহিত্যিকরা তাদের কবিতা ও সাহিত্যকে রাসুল ও ইসলামের কুৎসা এবং নিন্দায় ব্যবহার করতে আরম্ভ করল। তারা এর মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষিত হতে ইচ্ছুক লোকগুলোকে ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে চাইল। কারণ বিভিন্ন কাফেলা কবিতাগুলো নানা দিকে নিয়ে যাবে, ফলে তা বিভিন্ন গোত্রের কাছে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে গোত্রগুলো ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা হবে। কারণ তারা ইসলাম গ্রহণ করলে এ কবিরা তাদের বিরুদ্ধে ইজ্জত ও সম্মানহানিকর নিন্দামূল কবিতা লিখবে। এ অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? তার আনসারী সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে তারা কি পারে না, তাকে তাদের মুখের ভাষা তথা কবিতা দ্বারা সহযোগিতা করতে? এ কথা শুনে হাসসান (রা.) এগিয়ে এসে বললেন, হে আল্লার রাসুল! আমিই আপনাকে আমার কবিতা দিয়ে সহযোগিতা করব। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি আবু বকরের কাছে যাও, তিনি তোমাকে তাদের বংশ পরিচয়, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে জানাবেন। তা জেনে তুমি তাদের কুৎসা ও নিন্দাগাথা রচনা করবে। আর জিবরীল তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন।
অতঃপর হাসসান ইবনে সাবেত এগিয়ে আসেন তার কবিতা দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ইসলামকে সহযোগিতা করার জন্য। তার সাথে সম্পৃক্ত হলেন কবি কা’ব বিন মালেক ও আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। এই তিনজনের উদ্যোগে কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষে অনেক কবিতা লিখিত হয়। সে সময় ইসলামের মহত্ব এবং ইসলামি আকিদার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে অনেক কবিতা লেখা হয়। তাতে জনগণকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আর যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল- তাদের মুখোশ খুলে দেয়া হয়।
কবিতার পাশাপাশি গদ্য-সাহিত্যও ইসলামের সেবায় এগিয়ে আসে ইসলামের একেবারে প্রথম যুগ থেকেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? নিজে তার দাওয়াতি বক্তৃতাগুলো গদ্য ভাষায় দিতে থাকেন। হাদিস ও সীরাত গ্রন্থগুলোতে তার হাদিসগুলোর সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক খুতবা বা বক্তৃতাও সংকলিত হয়। এসব বক্তৃতার সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্য কারো কাছে অবিদিত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গদ্য সাহিত্য ইসলামের সেবায় নতুন মোড় নেয়। কখনো বক্তৃতা, ওয়াজ-নসিহত, আবার কখনো বিভিন্ন গোত্রও রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে পত্র ও চিঠির মাধ্যমে, আবার কখনো রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তিপত্র লিখনের মাধমে। আবার কখনো তার কিছু কিছু হাদিস তার কোনো সাহাবিদের জন্য লেখার মাধ্যমে।
সাহাবাদের যুগেও সাহিত্য ইসলামের সেবায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে ইসলামবিরোধীদের বিরোধিতার প্রতিবাদ করে তাদের উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডন করেছে; মুবাল্লিগদের উৎসাহ দান করেছে এবং মুজাহিদদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। সাহাবারা কঠিন মুহূর্তে সাহিত্যকে উত্তম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কারণ সাহিত্য হলো মানবমনে প্রভাব সৃষ্টিকারী একটি অন্যতম শিল্প। কাদেসিয়া যুদ্ধের সময় মুসলিম সেনা অধিনায়ক সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস আল-কোরআনের কারী, বুদ্ধিজীবী এবং গণ্যমান্য মুসলিম নেতাদের মুসলিম সৈনিকদের সামনে নিয়ে আসেন। শুধু তাদের নিয়ে এসেই ক্ষ্যান্ত হননি; বরং তাদের সঙ্গে কবি ও বক্তাদেরও নিয়ে আসেন এবং তারা যুদ্ধকালে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কবিতা পাঠ করেন ও বক্তৃতা শোনান। এসব কবিদের মধ্যে শাম্মাহ ও খুতাইয়্যা ও আউছ ইবনে মা’যা এবং আবদু ইবনে তৈয়বও ছিলেন। তিনি তাদের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যান। তাদের সেখানে পাঠানোর আগে বলেন, আপনারা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধের সময় আপনাদের ও তাদের জন্য যা কল্যাণকর তা শোনাবেন। আপনারা আরব জাতির কবি ও বক্তা। তাদের বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতি। আপনারা সৈনিকদের কাছে যান তাদের জিহাদ সম্পর্কে আপনাদের কথা শোনান, তাদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করুন। তখন তারা জিহাদের ময়দানে গিয়ে তা-ই করলেন। একের পর এক কবি ও বক্তারা গিয়ে তাদের জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন থাকলেন। হাফেজ ও কারীরা জিহাদ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শোনাতে থাকলেন। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস সাহিত্যকে জিহাদের ময়দানে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন কারীদের দিয়ে। তিনি কারীদের আদেশ দিয়েছিলেন, যাতে তারা সৈনিকদের কাতারে গিয়ে সুরা জিহাদ পড়ে শোনান।
অথচ সব মুসলমান সৈনিকেরই সুরাটি মুখস্থ ছিল। তারা সৈনিকদের সুরাটি পড়ে শোনালে সৈনিকদের মধ্যে অন্যরকম আবেগ সৃষ্টি হয়। তখন তাদের প্রথম কাতারের সৈনিকরা দ্বিতীয় কাতারের সৈনিকদের তা পড়ে শোনান। আর তারা তৃতীয় কাতারের সৈনিকদের পড়ে শোনান। এভাবে প্রত্যেক সৈনিক সুরাটি শুনে উদ্বুদ্ধ হন এবং তাদের হৃদয়ে অসাধারণ প্রভাব পড়ে। এভাবেই সাহিত্য প্রত্যেক যুগেই ইসলামের কল্যাণে ব্যবহৃত হতে থাকে। সাহিত্য নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আল-কোরআন সৃষ্টি কি না, এ বিতর্কের সময় সৃষ্টি না হওয়ার পক্ষে সাহিত্য শক্ত অবস্থান নেয় এবং যা বলা আবশ্যক তাই বলতে থাকে। সত্যের পক্ষাবলম্বনকারীদের সহায়তায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যেদিন মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টানরা ক্রুসেড যুদ্ধারম্ভ করে, সেদিনও সাহিত্য মুসলমানদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। মুসলমানদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করে। তাতারিদের আক্রমণের সময়ও সাহিত্যের ভূমিকা কিছুতেই ক্রুসেড যুদ্ধের সময়ের ভূমিকার চেয়ে কম ছিল না। এভাবেই সাহিত্য প্রত্যেক যুগে তার ভূমিকা পালন করেছে ইসলামের পক্ষে এবং ইসলামের সেবায়। সর্বাবস্থায় সাহিত্য ও ইসলামের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের ও হৃদ্যতার। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাকে ইসলামের সেবায় ব্যবহার করেছিলেন। অতঃপর সাহাবারা এবং তাদের পরে অন্যান্য মুসলমানরা তাকে ইসলামের খেদমতে ব্যবহার করেছেন। তাই ইসলাম কখনো সাহিত্য প্রসঙ্গে নেতিবাচক অবস্থান নেয়নি। তবে হ্যাঁ, ইসলাম তাকে প্রথম দিন থেকেই কিছু দিকনির্দেশনা? দান করেছে। সাহিত্যিকদের তা মানতে বাধ্য করেছে; যাতে সাহিত্য মানুষের জন্য কল্যাণকর এবং উপকারী বিষয়ে পরিণত হয়। ইসলামের এই নির্দেশনা ও আদেশ নিষেধ মেনে চলার কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম?-এর যুগ হতে এমন এক ইসলামি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে, যা যুগে যুগে জনহিতকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের মনে বিশ্বাস স্থাপনে, তাদের নৈতিকতা গঠনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। সেই সাহিত্যই হলো ইসলামি সাহিত্য।