একটা সময় ছিল যখন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আইন-কানুনের সব উৎস ছিল কোরআন ও সুন্নাহ। এ দুটি মূলবৃক্ষ থেকেই ধর্মীয় জ্ঞানের যাবতীয় শাখা-প্রশাখার উদ্ভব ঘটেছিল। বিখ্যাত মুফাসসির ও ফকিহ কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেছেন, মুসলমানদের জ্ঞান ও শাস্ত্রের সংখ্যা ৭০০। এর সবগুলোই সরাসরিভাবে বা ব্যাখ্যামূলকভাবে কোরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎসারিত। সুতরাং কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তির ওপরই মুসলমানদের চিন্তার, জ্ঞানের ও সংস্কৃতির ইমারত নির্মিত হয়েছে। এই অবস্থা ১১০০ থেকে ১২০০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
তখন যে শিক্ষব্যবস্থা ছিল তার ভিত্তি ছিল কোরআন ও সুন্নাহ এবং কোরআন ও সুন্নাহ থেকে উদ্ভূত জ্ঞান ও শাস্ত্রগুলো। এসব জ্ঞান মুসলিম উম্মাহর যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করেছে। বিভিন্ন রাজ্যে বৈচিত্র্যময় ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। ইউরোপের অর্ধাংশের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় থেকেছে। মুসলিম সেনাবাহিনী অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেছে। পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপে এখনো মুসলমানদের বিজয়চিহ্ন রয়ে গেছে। স্পেনে মুসলমানদের ৭০০ বছরের রাজত্বের নিদর্শন অটুট রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশেরও বেশি ভূখণ্ডে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও একত্ববাদী চিন্তাধারার ওপর নির্মিত শিক্ষাব্যবস্থা মুসলমানদের সার্বিক ধর্মীয় প্রয়োজনও পূরণ করেছে, পার্থিব প্রয়োজনগুলোও পূরণ করেছে। জাগতিক জ্ঞান এবং ধর্মীয় বা ইসলামি জ্ঞান ভিন্ন ভিন্ন, তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই এ ধরনের চিন্তা বা মনোভাব ইসলাম সমর্থন করে না।
এ কথা নিঃসঙ্কোচে ও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যখন থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাগতিক ও ধর্মীয় এই দুই ধারায় ভাগ করা হলো, তখন থেকেই মুসলমানদের মধ্যে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার বিস্তার ঘটতে থাকল। সেক্যুলারিজম কী? সেক্যুলারিজম হলো ধর্মীয় বিষয়াবলিকে ধর্মীয় বলয়ে আবদ্ধ রাখা এবং অধর্মীয় বিষয়গুলোকে অধর্মীয় বলয়ে রাখা। এই দুটির মধ্যে কখনোই কোনো সম্মিলন তৈরি হতে না দেওয়া। একটি নদীর দুটি পাড় যেমন একসঙ্গে মিলিত হতে পারে না, তেমনি সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয়াবলি ও জাগতিক বিষয়াবলি একত্রে মিলিত হতে পারে না। ফলে মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা ও জীবনযাপন দুটি বিপরীতমুখী বলয়ে খণ্ডিত হয়ে পড়ে এবং তাদের দ্বৈতসত্তা ধারণ করে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এটাকেই ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম বলে। ধর্মহীনতা এটারই নাম, ভিন্নকিছুর নাম নয়। এ জন্যই বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা জোর দিয়ে বলে থাকেন যে, ধর্ম ব্যক্তিজীবনে পালনীয় বিষয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের কোনো স্থান নেই।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের শাসনের সময় যখন মুসলমানদের হাত থেকে মূলধারার নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হলো, সেই সময় ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শাস্ত্রগুলোকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য একটি খাঁটি ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া মুসলমানদের পক্ষে আর কোনো উপায় ছিল না। এটি ছিল প্রতিরক্ষামূলক কর্মপন্থা এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মের উপস্থিতি-বিদ্যমানতা বজায় রাখার জন্য এই ব্যবস্থা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না যে, ধর্মীয় শিক্ষব্যবস্থার বলয় নির্মাণ করে যা এবং যতটুকু করা যায় করা হবে এবং মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন যতটুকু অটুট রাখা যায় অটুট রাখা হবে।
ব্রিটিশ খ্রিষ্টান শাসক কর্তৃক মুসলমানদের ক্ষমতা হরণের আগে ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার নামে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল না। মোগল আমলে যে শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যসূচি মুজাদ্দিদে আলফে সানির মতো মহান মনীষী সৃষ্টি করেছে, যার সম্পর্কে কবি মুহাম্মদ ইকবালের এই মন্তব্য বার বার উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে : The greatest religious genius produced by Muslim India - মুসলিম ভারতবর্ষ সবচেয়ে মহান যে মনীষীকে সৃষ্টি করেছে তিনি হলেন শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) সেই একই শিক্ষাব্যবস্থা নওয়াব সাদুল্লাহ খানকে তৈরি করেছিল। তিনি আহমদ সিরহিন্দির সহপাঠী ছিলেন এবং মোগল সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেই সময় মোগল সাম্রাজ্য আফগানিস্তান, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, সিকিম ও বার্মায় বিস্তৃত ছিল। মুজাদ্দিদে আলফে সানির আরেক সহপাঠী ছিলেন উস্তাদ আহমদ মা’মার। তিনি তাজমহলের স্থপতি ছিলেন। এই তিনজন একই শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন, এই উস্তাদের শাগরেদ ছিলেন এবং একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। দেখুন, এই তিনজনের একজন ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইসলামি প্রতিভা। তিনি উপমহাদেশে ধর্মীয় বা ইসলামি আন্দোলনে ও বিপ্লবে যে অবদান রেখেছিলেন, পরবর্তী সব ইসলামি আন্দোলন সেই অবদানের কাছে ঋণী। দ্বিতীয়জন পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য, সংস্কৃতিবান ও সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তার শৃঙ্খলাব্যবস্থা বজায় রেখেছেন। তৃতীয়জন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি সৃষ্টি করেছেন।
এই তিনজন মনীষী একই পাঠ্যসূচি এবং একই শিক্ষাব্যবস্থার সৃষ্টি। এটাই ইসলামের আদর্শ, ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার মডেল। পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের মোকাবিলায় এই শিক্ষাব্যবস্থায় এই মডেলের অনুসরণ জরুরি। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা কীভাবে সম্ভব এবং তার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে।
যখন দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হলো তখন উপমহাদেশে মুসলমানদের অবস্থা কী ছিল? গোটা উপমহাদেশ ছিল ইংরেজদের শাসনাধীন। তাদের কর্তৃত্ব ও নির্দেশে এখানে সবকিছু পরিচালিত হতো। তাদের হাতেই ইসলামি শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার বিভাজন ঘটেছিল। তারা মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। মোগল আমল থেকে মুসলমানদের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্মকাণ্ড থেকে আলেমদের সরিয়ে দিয়েছিল। যেসব আদালতে শরয়ি ব্যবস্থা চালু ছিল, সেসব আদালত বন্ধ করে দিয়েছিল অথবা ইসলামবিরোধী ব্রিটিশ আইনানুগ বিচারকার্য চালু করেছিল।
ব্রিটিশ আইন শরয়ি বিধি-বিধানের জায়গা দখল করে নিয়েছিল। তখন ফরাসি ছিল সরকারি ভাষা। ইংরেজরা সরকারি কর্মকাণ্ডে ফারসি ভাষা নিষিদ্ধ করে ইংরেজি ভাষা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছিল। সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুধু যে আলেমদের সরিয়ে দিয়েছিল তাই নয়, মুসলমানদের সরিয়ে সেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের স্থান দিয়েছিল। এভাবে অমুসলিমরা এগিয়ে গেল এবং মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ল। যা কিছু মুসলমানদের সম্মান ও গৌরবের বিষয় ছিল, সেগুলো তাদের অসম্মান ও লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। মুসলমানদের পোশাক-আশাক, তাদের পদপদবি, তাদের নামণ্ডউপনাম সবকিছু উঁচু স্তর থেকে নীচু স্তরে নেমে এলো। মুসলমানদের নীচু স্তরের ও নিম্ন সারির নাগরিক হিসেবে প্রচার করা হলো। ভারতবর্ষে ইসলামি জ্ঞানকে যতদূর পারা যায়, সুরক্ষদানের জন্য এই সময়টাতে আলেমরা ও ইসলামপ্রেমী জনগণ দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন।
লেখক : বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক