২০ জানুয়ারি ২০২৪ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পুনর্মিলনী ২০২৪। বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে পুরোনো বন্ধুদের মিলনমেলায় যখন উপস্থিত হলাম, তখন উদ্বোধনী অধিবেশনের শেষ বেলা। বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ঢাকাস্থ ইরানী রাষ্ট্রদূত মনসুর চাভুশি। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ইরান ও ফারসির সম্পর্ক নিয়ে কথা বললেন, কিছু আশ্বাসও দিলেন। পরক্ষণে আমার ডাক পড়ল, কিছু বলতে হবে এবং মঞ্চে বসতে হবে। অপ্রস্তুত অবস্থায় সময়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে খুব সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বললাম।
ফারসি চর্চায় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজধানী : দূর অতীত থেকে গোটা উপমহাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির রাজধানী ছিল বাংলাদেশ। কারণ, ইরান ও ফারসির সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পর্কের সেতুবন্ধ ছিল ঢাকার অদূরে তৎকালীন বাঙ্গালার রাজধানী সোনারগাঁ। এ দাবি কি আমার নিজের? না। এ কথা বলে গেছেন বিশ্বসাহিত্যের বরপুত্র, ফারসি সাহিত্যের বিস্ময়কর প্রতিভা, কিংবদন্তি মহাকবি হাফেজ শিরাজী। বাংলাদেশ ও ইরানের মৈত্রিবন্ধনের এ সূত্রটি এখনো অনাবিষ্কৃত। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ অতীতে কত সমৃদ্ধ ছিল এই সূত্রটি তার ঐতিহাসিক দলিল। হাফেজ তার অমর কবিতায় লিখেছেন, ফারসির যে কান্দ (মিছরি খণ্ড) অর্থাৎ তার একটি কবিতা বাংলায় যাচ্ছে তা হিন্দুস্তানের তোতাপাখিরা, কবি সাহিত্যিকরা ঠোকরে ঠোকরে খাবে, সবাই মিষ্টি মুখ হবে। এই কবিতার রচনাকাল আনুমানিক ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ। তা প্রমাণ করে আজ থেকে ৯০০ বছর আগে বাংলাদেশ ও সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতখানি ছিল। হাফেজের ভাষায়-
‘শেকার শেকান শাওয়ান্দ হামে তূতীয়ানে হেন্দ
যিনকান্দে পারসি কে বে বাঙ্গালে মীরওয়াদ’
বাংলার শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজমশাহ (রাজত্বকাল ১৩৯০-১৪১১ খ্রিষ্টাব্দ) শাহী অন্দর মহলের এক ঘটনায় একদিন বেশ খোশ মেজাযে ছিলেন। তিনি রাজপ্রাসাদের কর্মচারীদের নানা অভিযোগ শুনছিলেন। এক পর্যায়ে তিনজন দাসীর মনোকষ্ট দূর করার জন্য একটি বাক্য উচ্চারণ করেন, যা একটি ফারসি শ্লোকের প্রথম চরণের রূপ নেয়:
‘সাকী হাদিসে সারভ ও গুল ওলালে মী রওয়াদ’
(সাকী! সারভ, গুল ও লালাকে নিয়ে কানাঘুষা চলছে)।
কিন্তু শ্লোকের দ্বিতীয় চরণ মিলাতে পারলেন না কিছুতেই। ব্যাপারটা নিয়ে সুলতানের উৎসাহ তর সইল না। তিনি সরাসরি সাহায্য চাইলেন ইরানের বিশ্বনন্দিত মহাকবি হাফেজ শিরাজীর কাছে। সোনারগাঁ থেকে রাজকীয় উপহার সামগ্রী প্রেরিত হলো পারস্য সভ্যতার লালন ভূমি ইরানের শিরাজ নগরিতে। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের কথা চিন্তা করলে ইরানের শিরাজ নগরী আর প্রাচীন বাংলার সোনারগাঁয়ের যোগাযোগ ও মহাকবি হাফেজ শিরাজীর সঙ্গে সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের হৃদ্যতার বিষয়টি ইতিহাসবেত্তা ও সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়।
মহাকবি হাফেজ বাংলার সুলতানের আবদার পেয়ে আপ্লুত হলেন। তিনি শ্লোকের দ্বিতীয় চরণে লিখতে গয়ে একটি পুরো কবিতা রচনা করেন, যা হাফেযের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ দিওয়ানে হাফেজ এ সংকলিত এবং যার আবেদন কালজয়ী। এই কবিতা প্রমাণ করে ঢাকার উপকণ্ঠে সোনারগাঁ ছিল গোটা উপমহাদেশের শিক্ষাসংস্কৃতির রাজধানী। সুদূর শিরাজ হতে ফারসি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মননশীলতার উপহার কবি হাফেজ ‘বাঙ্গালা’য় পাঠান, যাতে সেখান থেকে সারা ভারতে বিস্তৃত হয়।
একবার পাকিস্তানে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেমিনারে দুজন আলোচক উপমহাদেশের সঙ্গে ইরানের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের পটভূমির পক্ষে দলিল হিসেবে হাফেজের কবিতার উপরোক্ত দুটি লাইন উচ্চারণ করেন, যা বাংলায় সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের কাছে পার্ঠিয়েছিলেন।
বিশ্বসভায় প্রাচীন বাংলার গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে, যখন হাফেজের সেই কবিতার শেষ দুটি চরণ সামনে আনি। সেখানে হাফেজ শিরাজী সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের রাজসভায় হাজির হওয়ার প্রেরণায় প্রবল উদ্দীপনার কথা ব্যক্ত করে বলেছেন, ক্রন্দন দিয়েই হাফেজ তোমার কার্যসিদ্ধ হবে।
‘হাফেজ যে শাওকে মাজলিসে সুলতান গিয়াসে দীন
গাফেল মশো কে কারে তো আয নালে মী রওয়াদ’
হাফেজ সুলতান গিয়াস উদ্দীনের রাজসভার উদ্দীপনায়
ভুলে যেওনা যে, কবিতার ক্রন্দনে তোমার কার্যসিদ্ধ হবে।
বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের রাজসভায় হাজির হওয়ার জন্য বিশ্বকবির এমন উদ্দীপনার পর আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ফারসির সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের বন্ধনের পক্ষে আর কোনো সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। লক্ষণীয় হলো, মহাকবি হাফেজ কবিতার দুটি চরণে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় ‘হিন্দ’ ‘বাঙ্গালা’ ও ‘সুলতান গিয়াসে দ্বীন’ শব্দ তিনটি উল্লেখ করেছেন।
ফারসি আমাদের নিজস্ব ভাষা : দ্বিতীয় কথাটি হলো, ফারসি শুধু ইরানী ভাষা নয়, আমাদেরও নিজস্ব ভাষা। বাঙালি জাতির অতীত ইতিহাস লিখিত হয়েছে ফারসি ভাষায়। কারণ, অতীতে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা, রাজকীয় কাজকর্ম ও দলিল দস্তাবেজ লিখিত হত ফারসিতে। উপনিবেশবাদী ইংরেজরা ১৭৫৭ সালে পলাশির আম্রকাননে এক অসমযুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করার পর বাংলার স্বাধীনতা হরণ করে নেয়। তারপর ক্রমান্বয়ে গোটা উপমহাদেশের দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে যায়। এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৩৭ সালে ফারসি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে রহিত করে এবং তদস্থলে ইংরেজি চালু করে। এরপর থেকে আমাদের জাতীয় জীবনে ফারসির গুরুত্ব হ্রাস পেতে পেতে এ পর্যায়ে চলে এসেছে। এত কিছুর পরও একটি বিষয়ের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তথ্যটি একজন ইরানী ভিজিটিং প্রফেসর বলেছিলেন, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদালয় প্রতিষ্ঠার সূচনাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু করা হয়। তখনও স্বয়ং ইরানে স্বতন্ত্র সাবজেক্ট হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফারসি সাহিত্য বিভাগ চালু হয়নি। তারমানে কী দাঁড়ায়। তারমানে, ফারসি শুধু ইরানের ভাষা ও সাহিত্য নয়। আফগানিস্তান, কাজাকিস্তানে যেমন ফারসি তাদের নিজস্ব ভাষা। ফারসিও বাংলাদেশে আমাদের নিজস্ব ভাষা। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা এ ভাষাতেই লেখা। কাজেই ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শিকড় সন্ধানের সাধনা হিসেবে গণ্য।
আধ্যাত্মিকতা ও প্রেমেরবন্ধন : আমাকে এত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে দুটি কথা বলার সুযোগ দানের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আরেকটি কথা ও আবেদন নিয়ে বক্তব্য শেষ করছি। ব্রিটিশ আমলে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার সাক্ষাৎ সুফল ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ। অনুরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে সুফল পেয়েছি তা হলো মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও প্রকৃত পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা থেকে চালু হওয়া ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি। ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ অন্যদের মতো গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গেলে চলবে না। আমি মনে করি, ফারসি ভাষা মানবসভ্যতার জন্য যে পয়গাম বহন করে তারমধ্যে একটি আধ্যাত্মিকতা অপরটি প্রেম-ভালোবাসার বার্তাবরণে বিশ্বমানবতা। বর্তমান সময়ে একটি মহলের ইসলামের উগ্রবাদী ব্যাখ্যার মোকাবিলায় মুসলিমসমাজকে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়ার সক্ষমতা ফারসি সাহিত্যের রয়েছে। সেই সঙ্গে বস্তুবাদী জীবন দর্শনের মোকাবিলায় দেশ, সমাজ ও বিশ্ববাসীর সামনে আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসার সূত্রে ইসলামের প্রেমময় মানবতার বাণী তুলে ধরার চেতনা ফারসি চর্চার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের চিন্তা ও মননে ঝড় তুলতে হবে। তাহলেই আমাদের মন সুন্দর হবে, নৈতিকার উজ্জীবন হবে, শিকড়ের সন্ধান পাব এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা বাংলার জমিনে ইসলামের সৌন্দর্যকে যেভাবে বিকশিত করেছেন, তার পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পাব।