মিসওয়াক শুধু সুন্নত নয়, শিফাও
দীদার মাহদী
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুখের ও পেটের সুস্থতা অনেকাংশেই নিয়মিত মুখ পরিষ্কার রাখার ওপর নির্ভর করে। মুখ পরিষ্কার রাখার ফলে দাঁতের ক্ষয়রোগ, গিংগিভিটিজ, পিরিওডন্টাল রোগ, হ্যালিটোসিস বা মুখের দুর্গন্ধ এবং অন্যান্য দন্তজনিত সমস্যা থেকে ব্যক্তি রক্ষা পায়। দাঁতের সৌন্দর্য খুবই জরুরি। কারণ, দাঁত শুধু খাবারের প্রয়োজনেই নয় মুখের সৌন্দর্য় বৃদ্ধিতেও অনন্য ভূমিকা রাখে।
দাঁতের যত্নে ইসলাম : ইসলাম পবিত্র এক ধর্ম। মানবীয় যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিয়েছে ইসলাম। নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার রাখা, দাঁতের ময়লা ও দুর্গন্ধ দূর করতে সচেষ্ট থাকা রাসুল (সা.)-এর একটি বিশেষ সুন্নত। দাঁতের যত্নের এই প্রক্রিয়ায় গাছের শিকড় জাতীয় মিসওয়াকই ছিল রাসুল (সা.)-এর একমাত্র মাধ্যম। তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত এই মিসওয়াকের আমল করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও মিসওয়াক করার প্রতি উৎসাহ দিতেন।
এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) রাত-দিনের যখনই ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন অজুর আগে মিসওয়াক করে নিতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫৭)। উম্মুল মোমেনিন আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ঘরে প্রবেশের পর সর্বপ্রথম মিসওয়াক করতেন। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৩)। জায়েদ বিন খালেদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) কোনো নামাজের জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মিসওয়াক করে নিতেন। (তবারানি, হাদিস : ৫২৬১)। উপরে বর্ণিত হাদিসগুলোতে ইসলামি সভ্যতা ও শিষ্টাচারের অন্যতম একটি দিক প্রকাশিত হয়েছে। ঘরে পরিবার পরিজনের কাছে এলে মিসওয়াক করা; স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগে মিসওয়াক করা এবং বাইরে যাওয়ার আগে মিসওয়াক করে বের হওয়া এ আমল মূলত নিজের মুখের দুর্গন্ধে যেন অন্য কারো কষ্ট না হয়, এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মিসওয়াকের সামাজিক দিক : বাস্তবতা হলো, দাঁত না মাজলে মুখে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় মুখ থেকে গন্ধ বের হয়। এতে অন্যের কষ্ট হয়। ইসলাম ছোট কোনো বিষয়েও অপরকে কষ্ট দেওয়া পছন্দ করে না। মোমেন ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকার নির্দেশ রয়েছে রাসুল (সা.)-এর হাদিসে। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দেবে না, তাদের লজ্জা দেবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধান করবে না। কেননা, যে মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধান করে আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দেবেন...।’ (তিরমিজি)।
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম : মিসওয়াকের বিষয়টি সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক ফর্মূলা। আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা মিসওয়াক কর। কেননা, মিসওয়াক মুখ পবিত্র ও পরিষ্কার করে এবং মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের উপায়। আমার কাছে যখনই জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসেছেন, তখনই আমাকে মিসওয়াক করার উপদেশ দিয়েছেন। শেষে আমার আশঙ্কা হয় যে, তা আমার ও আমার উম্মতের জন্য ফরজ করা হবে। আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর হওয়ার আশঙ্কা না করতাম, তাহলে তাদের জন্য তা ফরজ করে দিতাম। আমি এত বেশি মিসওয়াক করি যে, আমার মাড়িতে ঘা হওয়ার আশঙ্কা হয়। (ইবনে মাজাহ, হাদিস, ২৮৯)।
মিসওয়াক ব্যবহারে দাঁতের উপকারিতা : দাঁতের যত্নে বিভিন্ন উপায় মানুষ অবলম্বন করে। কেউ চুলোর ছাই দিয়ে দাঁত মাজে। কেউ বাজার থেকে কেনা মাজন ব্যবহার করে। কেউ টুথ পাউডার বা টুথপেস্ট দিয়ে দাঁতের যত্ন নেয়। ইসলাম এসব উপায়কে নিষেধ করেনি। ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজাও নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু ইসলাম দাঁত পরিচ্ছন্নতায় পুরস্কার ঘোষণা করেছে। মিসওয়াকের এত এত ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে, যে তা খুবই লোভনীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত দাঁতের যত্নে এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম মিসওয়াক। যা পূর্বযুগের নবী রাসুলদেরও আমল ছিল। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু আইয়ুব আল-আনসারি রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, চারটি জিনিস নবীদের চিরাচরিত সুন্নত। লজ্জা-শরম, সুগন্ধি ব্যবহার, মিসওয়াক করা এবং বিয়ে করা। (তিরমিজি, হাদিস, ১০৮০)।
আল্লামা ইবনে আবেদিন বলেছেন মিসওয়াকে রয়েছে ৭০টির ঊর্ধ্বে উপকারিতা। মিসওয়াক করা আল্লাহতায়ালার কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় কাজ। মহানবী (সা.) থেকে মিসওয়াক প্রসঙ্গে ৪০টি হাদিস বর্ণিত আছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রায় ৮০ শতাংশ রোগ পাকস্থলী ও দাঁতের সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশেষত বর্তমানে প্রতি তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন পেটের রোগে আক্রান্ত। মিসওয়াক না করার ফলে মুখে, দাঁতে ও মাড়িতে জীবাণু জন্মায় এবং খাওয়ার সময় তা পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। ফলে পাকস্থলী ও পেটের রোগ সৃষ্টি হয়। নিয়মিত মিসওয়াক করলে এধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া আরো নানারোগ থেকে মিসওয়াকের মাধ্যমে উপকার পাওয়া যায়।
মিসওয়াক কখন করতে হয় : মিসওয়াক করার সময় ৯টি। যথা- ১. সালাতের সময়; ২. কোরআন মাজিদ তিলাওয়াতের সময়; ৩. অজু করার সময়; ৪. ঘুম থেকে জাগ্রত হলে; ৫. ঘুমানোর আগে; ৬. মুখ দুর্গন্ধযুক্ত হলে; ৭. দীর্ঘ সময় কথা বলার পর; ৮. পানাহারের পর ও ৯. দুর্গন্ধযুুক্ত খাদ্য খাওয়ার পর। নামাজের আগে অজু করার সময় মিসওয়াক করা সুন্নত। অন্যান্য সময় মিসওয়াক করা মুস্তাহাব।
মিসওয়াকের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত? : একদল ফকিহ মিসওয়াকের জন্য নিম্নবর্ণিত ৩টি বৈশিষ্ট্য থাকাকে মুস্তাহাব বলেছেন। বৈশিষ্ট্য তিনটি হলো :
ক. মিসওয়াকটি হওয়া উচিত এমন ধরনের ডালা বা শিকড় থেকে, যা হবে নরম ও সিক্ত। কারণ এটি শক্ত হলে দাঁতের মাড়ি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
খ. এটি এমন গাছ থেকে না হওয়া, যা মুখকে রঙিন করে ফেলবে।
গ. গাছটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তা নিশ্চিত হওয়া।
তিক্ত, কাঁচা ও নরম গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা উত্তম। মহানবী (সা.) জাইতুন ও খেজুরগাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করতেন। পিলুগাছের মিসওয়াক ব্যবহারে মস্তিষ্ক সতেজ হয়। দাঁতের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করে। ব্রাশ ব্যবহারে মুখের দুর্গন্ধ দূর হলেও মিসওয়াক ব্যবহারে যে ফায়দা ব্রাশে তা পাওয়া যায় না।
মিসওয়াক করার পদ্ধতি : মিসওয়াক করার সুন্নতপদ্ধতি হলো মুখের ডান দিক থেকে শুরু করা এবং উপর থেকে নিচে মিসওয়াক করা। আড়াআড়িভাবে না করা। দাঁতের ভেতর ও বাইরেসহ জিহ্বার গোড়া পর্যন্ত মিসওয়াক করা। মিসওয়াক করার সময় ডান হাতের কনিষ্ঠাঙুলি মিসওয়াকের নিচে থাকবে। মধ্যমা ও তর্জনী আঙুলি উপরে এবং বৃদ্ধাঙুলি নিচে থাকবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে মিসওয়াক করতেন- হাদিসে এ বিষয়ে স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। এ বিষয়ে আহমদ ইবনে আবদাহ রহিমাহুল্লাহ হজরত আবু মূসা রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম, তখন তিনি মিসওয়াক করছিলেন। মিসওয়াকের এক পাশ তার জিহ্বার ওপর ছিল এবং ‘আ’ ‘আ’ করছিলেন। (নাসাঈ, ১/৩)।
হজরত আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, আমি একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম, আমার সঙ্গে ছিল আশআর গোত্রের দুজন লোক। তাদের একজন ছিল আমার ডানদিকে আর অন্যজন ছিল আমার বাঁ দিকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মিসওয়াক করছিলেন। তারা দুজন তার কাছে কাজ চাইল।(এতে বিব্রত হয়ে) আমি (নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) বললাম, যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন তার শপথ! তাদের অন্তরে কী ছিল তা আমাকে অবগত করেনি আর আমিও বুঝতে পারিনি যে, তারা কাজ চাইবে। আমি তখন তার (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ঠোঁটের নিচে রাখা মিসওয়াকের দিকে লক্ষ্য করছিলাম। তার ঠোঁট তখন উঁচু ছিল। (নাসাঈ, ১/৪)।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, দারুল হুদা মডেল মাদ্রাসা, কোদালপুর।