ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দরসে নিজামি ও সময়ের দাবি

আবদুস সাত্তার আইনি
দরসে নিজামি ও সময়ের দাবি

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সময় ভারত উপমহাদেশে দরসে নিজামি চালু ছিল। দরসে নিজামি কোনো আসমানি ব্যাপার নয়; কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত কোনো বিষয় নয়। ইসলামের অতীত বা ভবিষ্যতের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইংরেজরা যখন ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিল তখন কয়েক ধরনের দরসে নিজামি চালু ছিল। পূর্ব হিন্দুস্তান, জৌনপুর ও কাছাকাছি এলাকায় এক ধরনের দরস চালু ছিল। এই দরসকে ‘শিরাজে হিন্দ’ বলা হতো। শিরাজে হিন্দ বলা হতো এ কারণে যে, এই অঞ্চলে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার প্রচণ্ড চর্চা ছিল। এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা পড়াশোনা করতেন তারা যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতেন। উপমহাদেশে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার যেসব গ্রন্থ লিখিত তার অধিকাংশই লিখেছেন ‘খয়রাবাদি’ ঘরানার আলেমগণ। মাওলানা ফজলে হক খয়রাবাদি ও মাওলানা ফজলে ইমাম খয়রাবাদি এই ঘরানার বিখ্যাত দুটি নাম। ‘হাদিয়্যা সাদিয়্যা’ ও ‘শামসে বাযেগা’ তাদের লিখিত গ্রন্থ।

দরসে নিজামির বর্তমানে প্রচলিত পাঠ্যসূচি যুগসমস্যার সমাধানে ও ইসলামকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বলয়ে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, পাশ্চাত্যের চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির মোকাবিলায় যথার্থ কি না এই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। মোটাদাগে এই প্রশ্নের একটি জবাব দেওয়া যায় যে, ইসলামি শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সমন্বিত পাঠ্যসূচি (জাগতিক ও ইসালামি জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে) যেটাকে আমরা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার মডেল বলেছি গৃহীত হতে পারে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আলিয়া মাদরাসাগুলোতে এ-ধরনের সমন্বিত পাঠ্যসূচি রয়েছে। কিন্তু তার ফলাফল উল্লিখিত জায়গাগুলোতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আনেনি। আলিয়া মাদরাসা ইংরেজদের হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো, অথচ ইংরেজরাই ইতঃপূর্বে সমস্ত ইসলামি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলো এবং হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করেছিলো। বোঝাই যাচ্ছে, একটি অনুগত ইসলামি জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে তারা এই শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দিয়েছিলো। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আলিয়া মাদরাসা থেকে অনেক বিখ্যাত আলেম তৈরি হয়েছেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে আলিয়া মাদরাসার সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার যে-অনুশীলন তা থেকে এমন ফলাফল আশা করা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাষ্ট্র ও সরকারের সার্বিক আনুগত্য মেনে ইসলামের যথার্থ চর্চা ও প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে পাঠ্যসূচি তৈরি করা হয়েছে। কেউ কেউ কওমি মাদরাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করার এবং এখানেও সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কথা বলছেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম তাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে, এতে কওমি মাদরাসাগুলোকে আলিয়া মাদরাসার পরিণতি বরণ করবে এবং আখেরে কতিপয় ব্যক্তি লাভবান হলেও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কোনো উপকার হবে না। সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা যে আবশ্যক তাতে কোনো সন্দেহ নেই; এটা যদি কল্যাণকরভাবে বাস্তবায়ন করা যেতো তাহলে ইসলাম ও মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি উপকার হতো। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক উপযোগিতা ও অনুশীলন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। তার আগে আমি কতিপয় প্রস্তাব পেশ করতে চাই-

১। যেসব আলেম, বিশেষ করে তরুণ আলেম শ্রেণি, যোগত্যা রাখেন ও আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন যে, আগামী দিনগুলোতে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব¡ গ্রহণ করবেন, দার্শনিক ও চিন্তার বলয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আঞ্জাম দেবেন তাদের অবশ্যই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশ্চাত্য ধারার সঙ্গে পরিচিত থাকতে হবে, প্রতিনিধিত্বমূলক ও সমালোচনা করার মতো জ্ঞান থাকতে হবে। তবে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে তা নয়। যেমন : তাদের ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের মতো আইনজ্ঞ বা সমাজবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত জানা-শোনা থাকলেই হলো; পাশ্চাত্যের আইনের ভিত্তি কী, আইনগুলো কী ধরনের মৌলিক ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এগুলোর যুক্তিগত ও দালিলিক ভিত্তি কী রূপ, ইসলামি আইন ও ফিকহের সঙ্গে তাদের আইনের মিল ও অমিলগুলো কোথায় ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখাই যথেষ্ট।

২। কওমি মাদরাসাগুলোতে সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই দুটি জ্ঞানশাখার ইসলামি ধারার রচনাবলির সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য ধারার রচনাবলিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শিক্ষক তুলনামূলক পর্যালোচনা করে বুঝিয়ে দেবেন।

৩। কওমি মাদরাসার ইফতা বা ফতোয়া বিভাগগুলোতে বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইন নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার ব্যবস্থা থাকবে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এসব সংবিধান ও আইন কতটা অনুকূলে ও কতটা প্রতিকুলে তা নিয়ে গবেষণা হবে।

৪। আলেমদের নেতৃত্বে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিশোর বয়স থেকে শিক্ষার্থীদের ইসলামিক ধ্যান-ধারণায় গড়ে তুলতে হবে। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করবে এবং ইসলামি দাওয়াতের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

৫। আলেমদের নেতৃত্বে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করতে হবে। এখানে শিক্ষার্থীরা প্রকৌশলবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি মৌলিক ও পর্যাপ্ত ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করবে। পোশাক-আশাক, আখলাক-শিষ্টাচার মোটকথা তাদের দৈনন্দিন জীবনাচার হবে কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী।

৬। বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১০০ নাম্বারের ইসলামিয়্যাত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ১০০ নাম্বারের মধ্যে ৫০ নাম্বার থাকবে কোরআন বিষয়ে (কোরআনের বিশুদ্ধ পাঠ, তাজবীদ, গুরুত্বপূর্ণ অংশ/সূরা মুখস্থ করা ইত্যাদি) এবং বাকি ৫০ নাম্বার থাকবে হাদিস ও মাসআলা-মাসায়েল বিষয়ে। আলেম সমাজকে এজন্য যথার্থ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, দেশের ৯৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং ইসলাম ও কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।

আমার এই প্রস্তাবগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়, সামগ্রিকও নয়। এগুলো ও সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া একটি সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাষ্ট্রে বসবাস করে আলেমসমাজের পক্ষে পাশ্চাত্যের চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব ও সময়োপযোগী তা বৃহৎ পরিসরে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা-পর্যালোচনার দাবি রাখে।

লেখক: বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত