ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সমকামিতা ও কওমে লুত

শাহাদাত হোসাইন
সমকামিতা ও কওমে লুত

লূত (আ.) আল্লাহর প্রিয় নবী। কোরআনের ২৭ স্থানে তার নাম এবং ৭০-এর অধিক আয়াতে তার জাতির বিবরণ বিধৃত হয়েছে। তিনি ইবরাহিম (আ.)-এর ভাতিজা এবং হারানের পুত্র। জন্ম ইরাকের বাবেল এলাকায়। মাতৃভূমি থেকে হিজরত করে ওরদুন বর্তমান জর্ডানের মৃতসাগর এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য আদিষ্ট হন। সেখানের লোকের ন্যাক্কারজনক সব অপরাধে জড়িত ছিল। সমকামিতার মতো রুচি, বিবেক ও সমাজ বিধ্বংসী পাপের কাজেও তারা লিপ্ত ছিল। তাদের আগে কোনো জাতি এ কাজে লিপ্ত হয়নি। আসমানি কঠিন আজাবে তাদের ধ্বংস হয়। নিম্নে তাদের বিস্তারিত বিবরণ।

লূত (আ.) এবং তার জাতির বিবরণ : লূত (আ.) পশ্চিম ইরাকের বসরার নিকটবর্তী বেবিলনের বাসিন্দা ছিলেন। চাচা ইবরাহিম নবুওয়াত প্রাপ্ত হলে তিনি তার ওপর ঈমান আনেন। অতপর তার (ইবরাহিমের) প্রতি ঈমান স্থাপন করলেন লূত (সুরা আনকাবুত : ২৬)। ইবরাহিম (আ.) হিজরতে আদিষ্ট হলে, লূতও তার সঙ্গে সিরিয়ায় হিজরত করেন এবং জর্ডান নদীর তীরাঞ্চল বাইতুল মুকাদ্দাসের অদূরে কেনানে অবস্থানের জন্য আদিষ্ট হন। লূত (আ.) সেখানেই নবুওয়াত লাভে ধন্য হন এবং জর্ডান ও বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী সাদুম অধিবাসীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য আদিষ্ট হন। সেখানে সাদুম, আমুরা, উমা, সাবুবিম ও সুগর নামে পাঁচটি শহর ছিল। সাদুম সেগুলোর রাজধানী ছিল এবং লূত (আ.) সেখান থেকেই ইসলাম প্রচারের কাজ করেছিলেন (মাআরেফুল কোরআন : ৪৬০)। এরাই কওমে লূত নামে পরিচিত।

কওমে লূত এবং তাদের অপরাধ : ততকালীন সাদুম সম্প্রদায়ের বসবাসের এলাকাটি উর্বর, শস্য-শ্যামল ও সুফলা ছিল। আল্লাহ তাদের জন্য ধন-স¤পদ এবং নেয়ামতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মানুষ সুখে থাকলে আল্লাহকে ভুলে যায়। অপরাধ ও পাপে মত্ত হয়। সাদুম সম্প্রদায়ের সঙ্গেও এমনটি হয়েছিল। তারা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং শয়তানের প্ররোচনায় সব ধরনের অপরাধ ও পাপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এমন কোনো পাপকর্ম ছিল না যা তারা করেনি এবং এমন কোনো ভালো কাজ ছিল না যা তারা করেছিল। তাদের কর্মের তালিকায় শুধুমাত্র পাপকর্মই ছিল। আব্দুল ওয়াহহাব নাজ্জার বলেন, তাদের অপরাধসমূহের একটি এমন ছিল যে, বহিরাগত কোনো ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে সেখানে আসলে দেখার বাহানায় প্রত্যেকে অল্প অল্প করে হাতে তুলে নিত এবং নিয়েই চলে যেত। বেচারা ব্যবসায়ী অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে স¤পদের অভিযোগ ও কান্নাকাটি করলে, তাদের মধ্যে দু-একজন তা ফেরত দিত এবং বলত ভাই আমি তো শুধু এতটুকুই নিয়েছিলাম। তখন ব্যবসায়ী গোস্বা ও মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলত, সব তো নিয়ে গেছে এতটুকু দিয়ে কী করব? এটাও তুমি নিয়ে যাও। এভাবে তারা অন্যের সম্পদ সহজে হজম করত (কাসাসুল কোরআন ২ : ১৩৯)। একবারের ঘটনা ইবরাহিম ও সারা (আ.) দাস আল-ইয়ারাযকে সাদুমে পাঠালেন। সেখানে পৌঁছলে সাদুম সম্প্রদায়ের এক লোক তাকে বিদেশি ভেবে পাথর মেরে তার মাথা রক্তাক্ত করে দেয়। মাথা রক্তে রঞ্জিত দেখে পাথর নিক্ষেপকারী ব্যক্তি তার কাছে এসে বললেন, আমার নিক্ষেপ করা পাথরে তোমার মাথা রঙিন হয়েছে। সুতরাং আমাকে এর পারিশ্রমিক দাও।

ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি, বরং তারা আল-ইয়ারাযকে টেনে সাদুমের আদালতে নিয়ে যায়। সাদুমের বিচারক রায় দিলেন, আল-ইয়ারাযকে অবশ্যই পাথর ছুড়ে মারার পারিশ্রমিক দিতে হবে। রায় শুনে আল-ইয়ারায ক্রোধান্বিত হয়ে একটি পাথর খণ্ড নিয়ে জোরে বিচারকের মাথায় ছুড়ে মারেন। বিচারকের মাথা রক্তে রঞ্জিত হলে, সে বলেন, এই পাথর ছুঁড়ে মারার কারণে আমি আপনার কাছে পারিশ্রম পাওনা হলাম। আপনি সেই টাকা এই সাদুমি ভাইকে দিয়ে দেবেন। এ কথা বলেই সে সেখান থেকে পালায়ন করেন (কাসাসুল কোরআন ২ : ১৩৯)-এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সাদুম সম্প্রদায় জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, অনাচার, অশ্লীলতা, কুকর্ম, নির্লজ্জতা ও চরিত্রহীনতার সব স্তর পার করেছিল।

সমকামিতায় আসক্ত সাদুম সম্প্রদায় : সাদুম সম্প্রদায়ের সর্বাধিক ঘৃণিত বিষয় ছিল সমকামিতা। ধনৈশ্বর্যে মত্ত হয়ে কাম-প্রবৃত্তি ও লোভ-লালসার শিকার হয়ে এরা লজ্জা শরম, ভালো খারাপের জ্ঞান পর্যন্ত বিস্মৃত হয়েছিল। তারা এমন কাজে নিজেদের জরিয়ে ফেলে জন্তু-জানোয়ারও সাধারণত যে কাজে জড়ায় না। আল্লাহ লূত (আ.) কে তাদের হেদায়াতের জন্য নিযুক্ত করেন। তিনি তাদের বললেন এবং আমি লূতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বে কেউ করেনি? তোমরা তো কামবশত পুরুষদের কাছে গমন কর নারীদের ছেড়ে। বরং তোমরা সীমাতিক্রম করেছ (সুরা আরাফ : ৮০-৮১)। খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক বলেন, যদি কোরআনে আল্লাহ সাদুম সম্প্রদায়ের সমকামিতার কথা বর্ণনা না করতেন তাহলে আমি বিশ্বাসেই করতাম না যে, একজন পুরুষ অপর পুরুষের সঙ্গে কাম-চরিতার্থ করে (ইবনে কাসির ৩ : ৪৪৫)। সমকামিতার মতো মন্দ কাজের জন্মদাতা এরাই।

সমকামিতা ব্যভিচার থেকেও জঘন্যতর : পুরুষে পুরুষে কিংবা নারীতে নারীতে কামরিপু চরিতার্থ করা যেনা হতেও গুরুতর জঘন্য অপরাধ। কারণ, যেনা ব্যাভিচারের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা ‘ফাহিশা’ শব্দকে আলিফ-লামহীন ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সমকামিতার ক্ষেত্রে ‘আল-ফাহিশা’ আলিফ-লামসহ ব্যবহার করেছেন। যা ঈঙ্গিত বহন করে যে, স্বভাব বিরুদ্ধ এই সমকামিতা একাই সব অশ্লীলতার সমাহার এবং যেনা ব্যভিচারের থেকেও কঠোর অপরাধ (মাআরেফুল কোরআন ৪ : ৪৬১) । তাই, ভদ্র কোনো জাতি এমন অশ্লীলতার অনুমোদন করতে পারে না। যারা এমনটা করবে, তারা আসমানি আজাবকে নিজেদের ওপর অত্যাবশ্যক করে নেবে।

জাতিকে সমকামিতা পরিহারে লূতের প্রাণান্তকর চেষ্টা : লূত (আ.) তাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছালেন। আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখালেন। কোরআনের ভাষায়, লূতের সম্প্রদায় পয়গম্বরদের মিথ্যাবাদী বলেছে। যখন তাদের ভাই লূত তাদের বললেন, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তোমাদের বিশ্বস্ত রাসুল। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো বিশ্ব-পালনকর্তা দেবেন। সারা জাহানের মানুষের মধ্যে তোমরাই পুরুষদের সঙ্গে কুকর্ম কর (সুরা শুয়ারা : ৬০-৬৬) । লূত (আ.) এর এমন আহ্বান তাদের মনের বদ্ধ দুয়ার উন্মোচিত হয়নি। তারা সমকামিতা থেকে বিরত থাকেনি। উল্টো লূত (আ.) কে এলাকার থেকে তাড়ানোর জন্য সকলে ঐকমত্যে পৌঁছে। সুরা আরাফে এসেছে, জবাবে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, এদের (লূত তার পরিবার ও অনুসারীদের) তোমাদের জনপদ থেকে বহিষ্কৃত কর, এরা তো এমন লোক যারা অতি পবিত্র হতে চায় (৮২)।

সাদুম সম্প্রদায় কর্তৃক আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ : সাদুম সম্প্রদায় লূত (আ.) কে দেশান্তরিত করার হুকমি দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং তারা এমন কথাও বলে যার দ্বারা স্বয়ং আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তারা নিজেদের ভুল ও অপবিত্রার ওপর অটল থাকে এবং লূত (আ.) প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে যে, আমরা সমকামিতার ওপর অটল থাকব। আপনি সত্যবাদী হলে, যে আজাবের প্রতিশ্রুতি আমাদের দিয়েছেন তা নিয়ে আসুন। যেমনটা কোরআনে এসেছে, আর প্রেরণ করেছি লূতকে। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে পৃথিবীর কেউ করেনি। তোমরা কি পুংমৈথুনে লিপ্ত আছ, রাহজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে গর্হিত কাজ করছ? জবাবে তার সম্প্রদায় শুধু একথা বলল, আমাদের ওপর আল্লাহর আজাব আন যদি তুমি সত্যবাদী হও (সুরা আনকাবুত ২৮ : ২৯)। বর্তমান পৃথিবীতেও এটাই হচ্ছে, সমকামিতার মত ধ্বংসাত্মক কাজকে ঘৃণার বিপরীত রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব হারাচ্ছে এবং নিজেদের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করছে।

সাদুম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লূতের দোয়া : পাপিষ্ঠ ও দুরাচারীরা ছাড় পেয়ে ঔদ্ধত্য হয়। আসমানি কোনো গজব আসছে না দেখে মনে করে সেই পরাক্রমশালী, তাকে ধ্বংস করার কেউ নেই। লূত (আ.) তাদের এমন অনাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বীয় দোয়ায় বললেন, সে বলল, হে আমার পালনকর্তা দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য কর (সুরা আনকাবুত : ৩০)। আল্লাহতায়ালা নবী লূতের দোয়া কবুল করেন। সাদুম সম্প্রদায়ের ওপর আসমানি আজাব আসা নিশ্চিত হয় এবং তাদের ধ্বংসের দিন-ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে যায়।

সাদুমের উদ্দেশ্য ফেরেস্তাদের আগমন : সাদুম জাতি পাপ, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও অপকর্মে, আল্লাহ এবং নবীকে অমান্যকরণে সীমালংঘন করেছিল। সেহেতু আল্লাহতায়ালা তাদের ধ্বংসে ফেরেস্তাদের প্রেরণ করেন। ফেরেস্তারা ইবরাহিম (আ.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সাদুমের ধ্বংসের খবর দেন। সেখান থেকে তারা সুন্দর যুবকের আকৃতিতে সাদুম সম্প্রদায়ে লূত (আ.)-এর বাড়িতে মেহমান হিসাবে আগমন করেন। কোরআনের ভাষায়, এরপর ফেরেস্তারা যখন লূত-পরিবারের কাছে এলো, তখন লূত বলল, তোমরা তো অপরিচিত লোক (সুরা হিজর : ৬১-৬২)। তাদের দেখে লূত (আ.) চিন্তিত ও পেরেশান হয়ে যান। কারণ, সাদুম সম্প্রদায়ের লোক এতটাই নিকৃষ্ট মনের অধিকারী ছিল যে, অপরিচিত কোন যুবকও তাদের কাম-চরিতার্থহীন কর্ম থেকে মুক্তি পেত না।

যুবকরুপি ফেরেস্তাদের সঙ্গে সমকামে উদ্ধৃত : ফেরেস্তারা লূত (আ.) বাসায় পরিপাটি যুবক আকৃতিতে এসেছিলেন। লূত (আ.) নবাগত যুবক মেহমানদের সম্ভ্রম রক্ষার চিন্তায় পেরেশান ছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন খবর পাওয়া মাত্রই সাদুমের লোকেরা ছুটে আসবে তাদের সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হতে। নিজের মেহমানদের সম্মান রক্ষা করতে না পারা একজন নবীর জন্য মন-কষ্টের। লূত (আ.) ধারণা সঠিক হয়, তারা খবর পেয়ে বাসার চারিদিকে একত্রিত হয়। মেহমানদের বের করে দিতে জোর দাবি জানায়। সুরা হিজরে এসেছে-নগরবাসীরা উল্লাসিত হয়ে উপস্থিত হলো। লূত বলল, তারা আমার অতিথি, সুতরাং তোমরা আমাকে বেইজ্জত করো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাকে হেয় করো না ৬৭-৬৯) । লূতের এসব কথার উত্তরে তারা বলে, আমরা কি আপনাকে দুনিয়াসুদ্ধ মানুষকে আশ্রয় দিতে নিষেধ করিনি (৭০)।

ফেরেস্তাদের অভয়বাণী এবং এলাকা পরিত্যাগের আদেশ : সমকামিতায় মত্ত পাগল জাতি আল্লাহ এবং তার আজাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেমালুম, বেখবর। নবীর কথায় কর্ণপাতহীন অপরিচিত মেহমানদেরও কামরিপু চরিতার্থ থেকে নিস্তার দিতে নাখোশ।

আল্লাহ যথেষ্ট বলেছেন, তাদের অন্তর আছে বটে, তবে তা দ্বারা বুঝে না, চোখ আছে তা দিয়ে দেখে না, কানও আছে; কিন্তু তা দিয়ে শুনে না এরা পশুর মতো বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট (সুরা আরাফ : ১৭৯)। প্রকৃতপক্ষেই এরা কুকুরের থেকেও অধম। ফেরেস্তারা লূত (আ.)-এর পেরেশানি বুঝতে পেরে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করলেন এবং সাদুম সম্প্রদায়ের ধ্বংসের খবর দিয়ে তাকে শান্ত হতে বললেন। কোরআনের ভাষায়-তারা (ফেরেস্তারা) বলল, হে লূত নিশ্চয়ই আমরা তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত ফেরেস্তা। তারা কখনোই তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি রাতের কোনো এক সময় পরিবারসহ বের হয়ে পড় এবং তোমাদের কেউ পেছনে তাকাবে না (সুরা হুদ : ৮১)।

ভয়ঙ্কর আজাবের সম্মুখীন সাদুম সম্প্রদায় : লূত (আ.) হাজারো তদবির, প্রচেষ্টা, ভয়ভীতি এবং বোঝানোর মাধ্যমে তাদের সমকামিতা বিমুখ করতে পারেনি। আল্লাহর অঙ্গীকার নিশ্চয়ই ভোর তাদের (শাস্তির) নির্ধারিত সময়। ভোর কি নিকটবর্তী নয়? (সুরা হিজর: ৫৮)। সুবহে সাদিকের সময় এই অভিশপ্ত জাতির ওপর আল্লাহর আজাব নেমে আসে। যাতে তারা সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীতে যতগুলো জাতি আসমানি আজাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে সর্বাধিক ভয়ঙ্কর ছিল সাদুম সম্প্রদায়ের আজাব। যা শ্রবণে গায়ের পশম শিহরিত হয়, অন্তরাত্মা কম্পমান হয়। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

প্রচণ্ড শব্দের মাধ্যমে আজাবের সূচনা : আল্লাহর আজাবের আগাম বার্তা হিসাবে সূর্যোদয়ের সময় এক প্রচণ্ড শব্দ তৈরি করেন। যে বিকট শব্দ তারা এর আগে কখনো শোনেনি। কোরআনে এসেছে, অতঃপর সূর্যোদয়ের সময় তাদের প্রচণ্ড একটি শব্দ এসে পাকড়াও করল (সুরা হুজর : ৭৩)।

সম্পূর্ণ জনপদকে উল্টিয়ে দেয়া : যদিও তাদের আজাবের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত বিবরণ কোরআনে আসেনি। কিন্তু যা আছে তা থেকে অনুমেয় যে, শাস্তি হিসাবে প্রথমে তাদের জনপদকে উল্টিয়ে দেয়া হয়। যেমনটা কোরআনে এসেছে- অবশেষে যখন আমার হুকুম (আজাব) এসে পৌঁছল, তখন আমি ওই জনপদকে উল্টিয়ে ওপর-নীচ করে দিলাম (সুরা হুদ : ৮২)। বর্ণিত আছে, আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্র জিবরাঈল (আ.) তার পাখা সাদুম জনপদের তলদেশে এমনভাবে প্রবেশ করে মহাশূন্য-আসমান পর্যন্ত এমনভাবে উত্তোলন করেন যে, সবকিছু আপন স্থানে স্থির ছিল। এমন কি পানি ভর্তি পাত্র থেকে এক-বিন্দু পানিও পরেনি। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মানুষ, পশু-পাখির বিকট চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছিল। জনপদটিকে মহাশূন্য থেকে উল্টিয়ে আবার যথাস্থানে সজোরে নিক্ষেপ করা হয় (মাআরেফুল কোরআন : ৬৪০)। বলা হয় যে, এর কারণে সেই জনপদটি ৪০০ মিটার নিচে চলে যায়। তারা আল্লাহর বিধানকে উল্টিয়েছিল, আল্লাহও তাদেরকে উল্টে দিয়েছেন।

পোড়ামাটির কঙ্কর বর্ষণ : ভাবতে পারেন! মহাশূন্য থেকে মাটি চাপা দেয়ায় তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল? কিন্তু এরপরেও আল্লাহর আজাব শেষ হয়নি। এবার তাদের ওপর পোড়ামাটির কঙ্কর বর্ষণ করা হয়। যে পাথরগুলোতে বিশেষ ব্যক্তির নাম চিহ্নিত ছিল। যার কারণে পাথরগুলো নিদৃষ্ট ব্যক্তির ওপরেই পতিত হয়েছে। যেমনটা কোরআনে এসেছে- এবং আমি তাদের ওপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম প্রস্তর কঙ্কর, যা তোমার প্রতিপালকের কাছে চিহ্নিত ছিল (সুরা হুদ : ৮২-৮৩)।

আমাদের জন্য জনবার্তা : আল্লাহ কোরআনে এই ঘটনা এমনি এমনি বর্ণনা করেননি। বরং এর পিছনে বিশেষ অ্যাজেন্ডা আছে। তিনি জানতেন, শেষ জমানায় এমন কিছু মানুষ নামের অমানুষ আসবে যারা সাদুম জাতির ঘৃণিত এই কাজে লিপ্ত হবে। তাদের জন্য সাদুম জাতির আজাব রিমাইন্ডার। সমকামিতা এক ধরনের নেশা। মদ, অ্যালকোহল এবং অন্যান্য নেশাদ্রব্য যেমন মানুষের সুন্দর জীবনকে বিনাশ করে, তেমনি সমকামিতাও মারাত্মক এক নেশার নাম। যেমন আল্লাহ বলেছেন- আপনার প্রাণের কসম, তারা আপন নেশায় (সমকামিতায়) মত্ত ছিল (সুরা হুজর : ৭২)। এ নেশা জীবন যৌবন, দুনিয়া আখেরাত সবই ধ্বংস করে। বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রই তা থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

লেখক : শিক্ষা পরিচালক-ভরসা মাদরাসা রংপুর ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত