বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। সমাজবদ্ধ মানুষের যাপিত জীবন সুন্দর এবং পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি নারী-পুরুষের পুতঃপবিত্র জীবন নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ বিয়ের মতো অনুপম বিধান প্রবর্তন করেছেন। কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘তিনি সেই সত্তা যিনি অপবিত্র পানি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং বৈবাহিক সম্পর্ককে বংশ ও আত্মীয়তার অন্যতম মানদ- নির্ধারণ করেছেন। আর আপনার প্রতিপালক প্রবল পরাক্রমশালী।’ (সূরা ফোরকান : ৫৪)।
ইসলামে বিয়ের মধ্যে ব্যয়বহুল ও অতিরিক্ত আড়ম্বরকে নিষেধ করা হয়েছে, বরং ইসলামের বিয়ে খুবই সাধারণ ও সাদাসিধে। রাসুল (সা.) কন্যা ফাতেমা (রা.) কে বিয়ে দিলেন তার চাচাতো ভাই আলী (রা.) এর সঙ্গে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, তার কাছে কী আছে? আলী (রা.) জবাব দিলেন, কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার আর একটি লোহার বর্ম। মহানবী (সা.) তাকে বললেন, ‘আর কিছুই যখন নেই তখন বর্মটি বিক্রি করে অর্থ নিয়ে এসো।’ তাই করা হলো এবং ওই অর্থ দিয়ে বিয়ের খরচ চালানো হলো এবং দেনমোহর হলো ৪০০ মিসকাল রুপা। বোখারি শরিফের একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলের দরবারে একজন সাহাবির বিয়ের প্রশ্ন উঠলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেনমোহর দেয়ার মতো তোমার কী আছে?’ সাহাবি বললেন, ‘আমার কোনোকিছুই তো নেই।’ রাসুল (সা.) জিজ্ঞেসকরলেন, ‘তুমি কি কোরআনের কোনো আয়াত জানো?’ সাহাবি বললেন, হ্যাঁ। আমি কোরআনের এতগুলো আয়াত জানি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমার দেনমোহর হচ্ছে তুমি এ আয়াতগুলো তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দেবে।’ তখন এভাবেই বিয়ে হলো। (উল্লেখ্য, হানাফি মাজহাবের ইমামগণ কোরআন ও হাদিসের অন্য দলিলের ভিত্তিতে বলেন বিয়েতে স্ত্রীর জন্য নগদে বা বাকিতে দেনমোহর নির্ধারণ করা জরুরি। দেনমোহর নির্ধারণ না করা হলে মহরে মিছিল ধার্য হবে। আর কোরআন পড়ানো স্বামীর দায়িত্ব হিসেবে বর্তাবে তবে মোহর পরিশোধ করতে হবে।) হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না। (মেশকাত)। সুতরাং বিয়ের আয়োজনে পটকাণ্ডআতশবাজির ব্যবহার, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, রং ছিটানো ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ ও অপচয়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড়ো অকৃতজ্ঞ।’ (বনি ইসরাইল : ২৭)। অন্যত্র বলেছেন, ‘খাও ও পান করো এবং অপব্যয় করোনা। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।’ (আলআরাফ : ৩১)।
তাছাড়া এ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মেয়ের অভিভাবকরা একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করেন, অনেক সময় দেখা যায় পাত্র পক্ষের চাহিদা পূরণ করার জন্য জায়গা-জমি, সহায়-সম্পত্তিও বিক্রি করতে হয়। কেন না, বর পক্ষ কনে পক্ষকে জোর করে শতশত কিংবা হাজার হাজার বরযাত্রীকে খাবার খাওয়াতে বাধ্য করে। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতামাতা ভিটাবাড়ি বিক্রি করে হলেও এ শর্ত মেনে নেন। তাদের ভয়, বর পক্ষের কথা না মানলে কন্যার বিয়ে হবে না। কারণ গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য এটি কষ্টকর হলেও ধনীরা এটা আনন্দের সঙ্গে করে যাচ্ছে। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, সর্বনিকৃষ্ট খাবারের মজলিস হচ্ছে সেই মজলিস যাতে ধনবানদের দাওয়াত দেয়া হয় আর বিত্তহীনদের বাদ দেয়া হয়। (বোখারি)। অথচ ইসলামে কনে পক্ষের জন্য বর পক্ষকে খাবার খাওয়ানোর কোনো দায়িত্ব নেই, বরং বর পক্ষের জন্য ওয়ালিমার (বিয়ে পরবর্তী খাবার) আয়োজন করা সুন্নত। আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আবদুর রাহমান বিন আউফের জামায় হলুদ রঙ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার আবদুর রাহমান?’ আবদুর রাহমান উত্তর করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আনসারদের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি তাকে কি মোহর দিয়েছ?’ আবদুর রাহমান বললেন, ‘এক খেজুরের আঁটি সমান সোনা মোহর দিয়েছি।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। তুমি একটি ভেড়া দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করো।’ (বোখারি : ৮/৩৯৫)। বোখারির অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) কারও বিয়ে করার কথা শুনলে তাকে বলতেন, আল্লাহ তোমাকে প্রাচুর্য দান করুন। ওয়ালিমার আয়োজন করো একটি বকরি দিয়ে হলেও। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো- ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বড় অঙ্কের দেনমোহর ধার্য করা অমানবিক এবং অবৈধ। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘হে মুসলমান সম্প্রদায়! তোমরা বিয়ে-শাদিতে মোটা অঙ্কের মোহর দাবি করো না। কেন না, আল্লাহর কাছে এটার কোনো মর্যাদা নেই, যদি থাকত তাহলে রাসুল (সা.) তার মেয়ে ফাতেমা (রা.)-এর বিয়েতে করতেন। (তিরমিজি)। আবু দাউদে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘খাইরুস সিদাকি আইসারুহু’ তথা উত্তম মোহর হচ্ছে যা দেয়া সহজ হয়। পাত্রীর অভিভাবকরা মোটা অঙ্কের যে দেনমোহর হাঁকেন, যা একজন পাত্রের সাধ্যের বাইরে। ফলে অনেকে বিয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাই অনেক ক্ষেত্রে একজন ছেলে বিয়ে করার আগেই প্রায় প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেন। এর ফলে সামাজিক জীবনে অবাধ যৌনতা ভয়াবহ রূপ লাভ করে থাকে, অনিরাপদ ঝুঁকিপূর্ণ যৌনক্রিয়া সম্পাদনের সম্ভাবনা থাকে, যা নারী-পুরুষ উভয়কেই এইডসের মতো মরণব্যাধির দিকে ঠেলে দেয়। যা আমাদের সমাজব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি। এতে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পরিশেষে বলা যায়, বিবাহ একটি সামাজিক রীতি, যা ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক নির্দেশিত। এতে পার্থিব ও পরকালীন কল্যাণ আছে। সুতরাং তা রাসুলের আদর্শ মোতাবেক হওয়া উচিত। এতে করে সবার দাম্পত্য জীবনে আসবে সুখ ও শান্তি।