ফিলিস্তিনের ইতিহাস : অতীত-বর্তমান

আবদুল্লাহ নুর

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার বাহক। এটাই সেই প্রথম ভূখণ্ড, যেখানে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৯ হাজার বছর আগে মানুষ খেত-খামার ও স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছিল। পরবর্তী ১ হাজার বছর পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮ হাজার বছর আগে গড়ে ওঠে ‘আরিহা’ নামক নগরী। আরিহা নগরীর পতনের পর থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও অসংখ্য নবী-রাসুল এই পবিত্র ভূমিতে বাসস্থান গড়ে তুলেছেন।

ফিলিস্তিনে কেনআনি সম্প্রদায় : যতগুলো সম্প্রদায় ফিলিস্তিনে বসবাস করেছে তাদের মধ্যে কেনআনি সম্প্রদায় সর্বাধিক পুরোনো। তাদের স্মৃতিচিহ্ন আজও ফিলিস্তিনে বিদ্যমান। কেনআনি সম্প্রদায় আনুমানিক ৪ হাজার ৫০০ বছর আগে আরব উপদ্বীপ থেকে এ অঞ্চলে আগমন করে। এ কারনে ফিলিস্তিনকে প্রাচীন ইতিহাসে ‘আরদে কেনআন’ বলা হয়।

ফিলিস্তিনে ইয়াবুসি সম্প্রদায় : আরব উপদ্বীপের উত্তর প্রান্ত থেকে দেশত্যাগ করা গোত্রগুলোর মাঝে ‘ইয়াবুসি’ সম্প্রদায়ও ছিল। আল কুদস নগরী গড়ে ওঠার আগেই এই সম্প্রদায় এখানে বসবাস শুরু করেছিল। এ কারণে ‘আল-কুদস’ নগরীকে তাদের নামের দিকে সম্বন্ধিত করে ‘ইয়াবুস’ ও বলা হতো।

ফিলিস্তিনে ইবরাহিম (আ.) : হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আগমন ফিলিস্তিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মাধ্যমেই ফিলিস্তিনে তাওহিদের প্রদীপ নতুন করে প্রজ্বলিত হয়। কেন না, নুহ (আ.)-এর জমানায় প্লাবনে সব ধ্বংস হয়ে গেলে তিনিই সর্ব প্রথম তাওহিদের বাণী প্রচার শুরু করেন। তিনি ও তার স্ত্রী সারা (আ.) খ্রিষ্টপূর্ব উনিশ শতকে ইরাক থেকে ফিলিস্তিনে আগমন করেন এবং জেরুজালেমে একটি উপাসনালয় গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে ‘বাইতুল মাকদিস’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ছেলে ইসহাক (আ.) সহ তার বংশ পরম্পরা এ পবিত্র ভূমির পরিচর্যা করেন।

ফিলিস্তিনে বনি ইসরাইল : হজরত ইসহাক (আ.)-এর সন্তানের নাম ইয়াকুব (আ.)। তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। তবে পরবর্তীতে তিনি তুরস্কে হিজরত করেন। কয়েক বছর পর আবারো তিনি ফিলিস্তিনে আগমন করেন। ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ইসরাইল (আ.)। তার বংশধরকেই বনি ইসরাইল বলা হয়। ফিলিস্তিনে তখন হেকসোসদের শাসন চলছিল। এক সময় সম্রাট আহমোস ফিলিস্তিনে হামলা করলে হেকসোসরা পরাজিত হয়। আর সম্রাট আহমোস বনি ইসরাইলকে মনে করে হেকসোসদের সহযোগী। তাই তাদের ওপর নেমে আসে প্রচণ্ড জুলুমণ্ডনির্যাতন। এ অত্যাচার চলে প্রায় তিনশত বছর পর্যন্ত। আর বনি ইসরাইলের চরিত্রে নেমে আসে ব্যাপক ধস। তারা এক পর্যায়ে লিপ্ত হয় মূর্তিপূজায়। যে চরিত্রে বর্তমানে আমরা তাদের চিনি তারা এমন নয়। তারা ছিল মূলত উত্তম চরিত্রের অধিকারী একদল সম্প্রদায়।

ফিলিস্তিনে মুসা (আ.) : শত শত বছর অত্যাচারী বাদশাহগণ বনি ইসরাইলের ওপর নানান জুলুমণ্ডনির্যাতন চালায়। অবশেষে তারা অতিষ্ঠ হয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করে মিশরের সিনাই উপত্যকায় আসে। আর সেখানে ছিলেন হজরত মুসা ও হারুন (আ.)। ইসরাইলিরা মুসা ও হারুন (আ.) কে যারপরনাই কষ্ট দেয়। আল্লাহর নির্দেশে হজরত মুসা (আ.) খ্রিষ্টপূর্ব ১২৫০ সালের দিকে বনি ইসরাইলকে নিয়ে বাইতুল মাকদিসে রওয়ানা হন। তবে সেখানে অত্যাচারী কেনআনিদের বসবাস থাকায় বনি ইসরাইল শহরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় তারা তীহ প্রান্তরে পাগলের মতো ঘুরতে থাকে। তীহ প্রান্তরে থাকা অবস্থায়ই হজরত মুসা (আ.) ইন্তেকাল করেন।

ফিলিস্তিনে ইউশা (আ:) : হজরত মুসা (আ.)-এর ইন্তেকালের পরে বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের ভার আসে হজরত ইউশা (আ.)-এর ওপর। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ শতাব্দী সালে বনি ইসরাইলদের নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। তখন কেনআনিদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী য্দ্ধু সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে বনি ইসরাইল বিজয় লাভ করে এবং ইউশা (আ.) তাদের নিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করে। তার জীবদ্দশায়ই বনি ইসরাইল অনেক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। একসময় হজরত ইউশা (আ.) ইন্তেকাল করেন। আর তাদের মাঝে ছড়িয়ে পরে পৌত্তলিকতা। চরমে পৌঁছে তাদের অবাধ্যতা। তারা হারিয়ে ফেলে মুসা (আ.)-এর লাঠি।

ফিলিস্তিনে দাউদ (আ.) : খ্রিষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীর শেষে শাওল ইবনে কায়স (তালুত) বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। তখন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এক ভয়াবহ য্দ্ধু হয়। তাদের সেনাপতি ছিল জালুত। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হজরত দাউদ (আ.) জালুতকে হত্যা করেন। তালুতের ইন্তেকালের পরে দাউদ (আ.) বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব দেন এবং ফিলিস্তিনে সবচেয়ে বড় ইহুদিবাদি রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। এটাই ছিল সর্বপ্রথম ঈমান ও আহলে ঈমানের আধিপত্য।

ফিলিস্তিনে সুলায়মান (আ.) : হজরত দাউদ (আ.) ফিলিস্তিনে ৪০ বছর শাসন করেন। তার ইন্তেকালের পরে হজরত সুলায়মান (আ.) বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বেশ দাপটের সাথেই শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তার প্রভাবে ইসরাইলিরা নুইয়ে পড়ে। তিনি জীনদের দ্বারা বাইতুল মাকদিসকে সংস্কার করেন। সুলায়মান (আ.)-এর ইন্তেকালের পরে বনি ইসরাইলের ১২টি গোত্র বিভক্ত হয়ে যায়। এক জনে নেতৃত্ব দেন ১০ গোত্রের আরেকজনে নেতৃত্ব দেন ২ গোত্রের। ১০ গোত্র ফিলিস্তিনের উত্তরে আর ২ গোত্র ফিলিস্তিনের দক্ষিণে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। বিশৃঙ্খলা ও একগুঁয়েমিতে ছিল উভয় গোত্রই বরাবর। মিশরের সম্রাট শিশাংক খ্রিষ্টপূর্ব ৯২০ সালে উত্তর অঞ্চলের ওপর হামলা করে দখল করে নেয়। আর ৭২১ সালে আ্যসিরিয়ানরা (আশুরিয়া) দক্ষিণ অঞ্চলের ওপর আক্রমন করে দখল করে নেয়। আর ধ্বংস হয়ে যায় ২০০ বছরের ইসরাইলি সাম্রাজ্য।

ফিলিস্তিনে বুখতে নসরের আক্রমণ : শিশাংক ও আ্যাসিরিয়ানদের আক্রমণে ইহুদি সম্প্রদায়ের কোমর ভেঙ্গে যায়। তবে ইহুদিদের ইয়াহুযা সম্প্রদায় ভাঙ্গা কোমর নিয়ে আরো ১৫০ বছর মাকদিস শাসন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ইরাকের সেনাপতি বুখতে নসর আবারও তাদের ওপর তাণ্ডবলীলা চালায়। ধ্বংস করে মসজিদে আকসা। বন্দি হয় প্রায় ৪০ হাজার ইহুদি। আর চিরতরে অবসান ঘটে ইহুদিবাদি সাম্রাজ্যের। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের শাসনকাল ছিল মোট ৪১৮ বছর। যার মধ্যে সুলায়মান (আ.) ৮০ বছর ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে শাসন করে। আর বাকি ৩৩৮ বছর ছিল ফিতনা -ফ্যাসাদ ও জুলুমণ্ডনির্যাতনে জর্জরিত। আর ইহুদিরা এ শাসনকেই বুনিয়াদ বানিয়ে এ দাবি তুলছে, যে তারাই ফিলিস্তিনের বেশি হকদার।

ফিলিস্তিনে ব্যাবিলন ও পারসিক শাসন : ইহুদি সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্য দিয়ে ব্যাবিলন শাসনের গোড়াপত্তন হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৮৬ সাল থেকে ৫৩৯ সাল পর্যন্ত এ শাসন স্থায়ী হয়। পারসিকরা খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ইহুদিদের সহোযোগিতায় ফিলিস্তিনে আক্রমণ করে। ব্যাবিলনদের ব্যাবেল শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে গোটা ফিলিস্তিনকে পারসিকরা দখলে নেয়। প্রায় ২০৭ বছর চলে তাদের শাসন কার্য।

ফিলিস্তিনে রোমান শাসন : রোমান সেনাপতি আলেকজেন্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে পারসিকদের পরাজিত করে। ইহুদিরা পারসিকদের থেকে ভালো সুবিধা না পাওয়ায় রোমানদের যুদ্ধে সার্বিক সহোযোগিতা করে। এমনকি কোনো কোনো ইহুদি রোমানীয়দের ধর্মও গ্রহণ করে। রোমানরা ফিলিস্তিন বিজয়ের পর সর্বপ্রথম তাকে রোমের অধীনে নিয়ে আসে। যা পরবর্তী সপ্ত শতাব্দীকাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইনের অধীনে ছিল।

ফিলিস্তিনে ঈসা (আ.) : ফিলিস্তিনে রোমানীয়দের শাসনকালেই ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। ফিলিস্তিনিরা ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা (আ.)-এর কুফুরীর অভিযোগ আনে। রোমান সম্রাট এ অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে শূলীতে চড়ায়।যা ইহুদি মতাদর্শে তাদের হাতে তার প্রাণ চলে যায়। অথচ বাস্তবতা এমন নয়। বরং আল্লাহ কুদরতিভাবে তাকে উর্ধ্ব আকাশে নিয়ে গেছেন।

ইহুদিদের বিদ্রোহ ও রোমান শাসন : হজরত ঈসা (আ.)-এর ইন্তেকালের প্রায় ১০০ বছর পর আবারও শুরু হয় ইহুদিদের বিদ্রোহ। ১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বারবুখা-এর নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের আক্রমণে ইহুদিরা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। আর হাদ্রিয়ানের সেনাবাহিনী দখলে নেয় আল কুদসের পুরো ইহুদি অঞ্চল। চালায় ধ্বংসের স্ট্রীমরোলার। এ ঘটনার পর থেকে ইহুদিরা আর কখনোই বিদ্রোহের চেষ্টা করেনি। তখন থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আল-কুদস রোমানদের অধীনেই থাকে।

ফিলিস্তিনে মুসলিম শাসন : ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ। চলছিল হজরত উমর (রা.) খেলাফত কাল। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে উড়ছিল মুসলিমদের বিজয় কেতন। মুসলিম বাহিনীর ইয়ারমুক বিজয়ের কারণে গাজা, নাবলুস, লদ, ইয়াফা ও রাফাহসহ কুদসের অন্যান্য অঞ্চলও বিজিত হয়। আল কুদসের অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে রোমান খ্রিষ্টানরা। দীর্ঘ ৪ মাস অবরোধের পর মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হন। তখন জেরুজালেমের বিশপ সফরোনিয়াস উমর (রা.) কাছে কুদসের চাবি প্রদানের শর্তারোপ করেন। অতঃপর উমর (রা.) নিজে ফিলিস্তিনে আগমন করেন এবং খ্রিষ্টানদের সঙ্গে নিম্ন লিখিত দু’টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন :

এক. খ্রিষ্টাানদের বিভিন্ন গির্জাঘর ও উপাসনালয় নিরাপত্তা পাবে। দুই. এই পবিত্র শহরে কোনো ইহুদি বসবাস করতে পারবে না। সেই ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র ‘আহদিয়ায়ে উমরিয়্যাহ’ নামে বিখ্যাত।

হজরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) ছিলেন শামের প্রথম মুসলিম গভর্নর। তার ইন্তেকালের পর গভর্নর হন মুআয ইবনে জাবাল (রা.)। তার ইন্তেকালের পর গভর্নর হন ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.)। তার ইন্তেকালের পর গভর্নর হন মুআবিয়া (রা.)। হজরত উসমান (রা.) খেলাফত কালে তিনিই পুরো শাম অঞ্চলের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। আর উসমান (রা.) খেলাফতের শেষের দিকেই ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওসব ফিতনায় শাম ও ফিলিস্তিনের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

ফিলিস্তিনে উমাইয়া ও আব্বাসী খেলাফত : হজরত মুআবিয়া (রা.) হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খেলাফত। ৪১-১৩২হি:/৬৬০-৭৫০খ্রি. পর্যন্ত চলে তাদের শাসনকাল। সেই সময়টা ছিল ফিলিস্তিনিদের উন্নতি ও অগ্রগতির বসন্ত কাল। ১২৯ হি: ভূমিকম্পে মসজিদে আকসার বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন উমাইয়া খলিফার নেতৃত্বে দ্রুত মসজিদটির মেরামত করা হয়। ১৩২ হি: উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফত। ১৩২-৬৬৫ হি: পর্যন্ত চলে তাদের শাসন। আব্বাসী যুগে আল আকসার ঐতিহ্যের কার্যক্রম বেগবান হয়। খলিফা হারুনুর রশিদ ও তার ছেলে মাহদী এই মসজিদ পরিদর্শনে আসে। সেখানকার জনগণের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়।

ফিলিস্তিনে শিয়া শাসন : ১৩২-৬৫৬ হি: পর্যন্ত আব্বাসী শাসন থাকলেও তারা ২৪৭ হি: দুর্বল হয়ে পড়েন। আব্বাসীয়দের দুর্বলতাকে কাজে লাগায় উবায়দিয়রা। তারা ছিল নিকৃষ্ট শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। উবায়দিয়াদের দখলের মধ্য দিয়ে এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে ফিলিস্তিন। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দাওয়াতের কার্যক্রম একেবারে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। তবে ৪৬৩ হি: সুলতান আল্প আরসালানের নির্দেশে তুর্কি সেনাপতি আতসিয ইবনে উবাক উবায়দিয়াদের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের উদ্ধার করে। কিন্তু সামান্য ভুলের কারণে ৪৮৯ হি: উবায়দিয়ারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং ফিলিস্তিন দখল করে।

ফিলিস্তিনে ক্রসেডার শাসন : ৪৯০ হিজরিতে উবায়দিয়াদের শাসন আমলে ধেয়ে আসে ক্রুসেডাররা। দ্বিতীয় পোপ আরবান ক্রসেডরদের উদ্দেশে এক জালাময়ী বক্তৃতা দেয়। যা সমগ্র ইউরোপে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে আবেগী কণ্ঠে বলে ‘মহামতি মসিহের সমাধি মুসলমানদের থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাদের হাত থেকে আল কুদসকে পবিত্র করতে হবে’। যার ফলে পিটার আন নাসিক এর নেতৃত্বে ক্রসেডররা ফিলিস্তিনে হামলা করে এবং তারা ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কুদস আঙ্গিনায় প্রবেশ করে ৭০ হাজার মুসলমানকে জবাই করে কুদস শহরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। ক্রসেডারদের শাসনামলে বাইতুল মাকদিস ছিল ল্যাটিন সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। ক্রুসেডাররা ৫৬৫(হি.) পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত বছর ফিলিস্তিন শাসন করে।

ফিলিস্তিনে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর (র.) শাসন : মহাবীর সালাহ উদদ্দিন আইয়ুবীর সঙ্গে ৫৮৩ হিজরিতে ক্রসেডারদের এক রক্তক্ষয়ী য্দ্ধু সংঘটিত হয়। যা ইতিহাসে হিত্তিনের য্দ্ধু নামে পরিচিত। মুসলমানগণ এ যুদ্ধে বিজয়ী হলে কুদস দখলের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলমান সৈন্যদল ৫৮৩ হিজরির ১৫ রজব থেকে টানা ১২ দিন বাইতুল মাকদিস অবরোধ করেন। অবরোধ শেষে ২৭ রজব আল কুদসের ওপর মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। ক্রসেডররা আল মসজিদুল আকসাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে। এক ভাগ বানানো হয় গির্জাঘর। দ্বিতীয় ভাগকে বানানো হয় সৈন্যদের কোয়াটার। তৃতীয় ভাগকে বানানো হয় স্টোর রুম। আরেক ভাগকে পরিণত করা হয় ঘোড়ার আস্তাবল। সালহ উদদ্দিনের সৈন্যদল ভেতরে প্রবেশ করে এবং আল আকসা মসজিদ এক সপ্তাহ ধরে পরিষ্কার করে। অতঃপর তারা সবাই আল মাসজিদুল আকসায় শুকরিয়ার নামাজ আদায় করেন। ৫৮৩ হিজরি থেকে নিয়ে ১৩৩৫ হিজরি পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসে চলে মুসলমানদের সোনালি যুগ। উসমানীয় সাম্রাজ্য চলাকালে মোনাফেক মুসলমান ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্রে বাইতুল মাকদিসের পতনের যাত্রা শুরুহয়। আর সেই ধারাবাহিতায় ইহুদিরা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে প্রায় সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড।

ফিলিস্তিনের পতনের সূচনা : ফিলিস্তিন ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী লু-হাওয়ার তপ্ত মরুভূমির দেশ। মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও অসংখ্য নবী রাসুলের পায়ের ধূলোয় ধূসরিত এক পুণ্যভূমি। আরবীয় সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা এ দেশটি ১৯১৭ সাল পর্যন্ত উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে দেশটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর ধীরে ধীরে জন্ম নেয় ইহুদিবাদী ইজরাইল রাষ্ট্র।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ফিলিস্তিন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিন ব্রিটেনবিরোধী জোটে ছিল? ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার চুক্তিতে যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতা কামনা করে? যা ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত? আর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি তাই স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা মুসলমানদের অনুকূল বলেই ধরে নেয় স্থানীয় আরবীয়রা। তবে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান বোমার কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করে ব্রিটেনকে উপহার দেয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আনন্দিত হয়ে এই ইহুদি বিজ্ঞানীর কাছে জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? সে উত্তর দিয়েছিল- অর্থ বা সম্পদ নয়! আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি চাই, আর তা হবে ‘ফিলিস্তিন’? অতঃপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন বিজয়ী হওয়ার পর ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেওয়ার নামে ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের শোষণের অধীনে রাখে? যা ছিল ফিলিস্তিনকে আরব বিশেষত মুসলিম শূন্য করার এক অভিনব প্রক্রিয়া।

মুসলমানদের উচ্ছেদকরণ : ১৯২০ সাল। বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী শক্তিগুলো পরাভূত। অপর দিকে ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার আশায় ক্ষণ গুনে গুনে তদবির চালাচ্ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা মুসলমানদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে ‘জাতিপুঞ্জ’ ঘোষণার মাধ্যমে ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে বিভিন্নদেশে বসবাসরত ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিন আসতে শুরু করে এবং ইহুদিবাদী তিনটি প্রধান সংগঠন হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় মুসলিম নারী-পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে বাড়িতে লুটতরাজ চালায়। যাতে করে আরবীয়রা ফিলিস্তিন ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল, তখন পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে ফিলিস্তিনি বন্দরে ভিড়তে চাওয়া দু’টি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা ধ্বংস করে এবং জাহাজে থাকা ১০৪৫ জন ইহুদিকে হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে ব্রিটিশদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে? অন্যত্র ধীরে ধীরে আরবদের উচ্ছেদকরণও চলতে থাকে? যার ফলে ২০ লাখ জনগণের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪০ হাজার? সর্বশেষ ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর মার্কিনিদের চাপে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ে জাতিসংঘে ভোটগ্রহণ করা হয়, তাতে ৩৩টি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে, ১৩টি বিপক্ষে এবং ১০টি দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে। অতঃপর ইহুদিরা ভূমির ৫৭ শতাংশ আর আরবীয়রা ভূমির ৪৩ শতাংশ জায়গায় নতুন বসতি স্থাপন করে। তবে ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত। আর এ সুযোগে ইহুদিরা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে থাকে।

ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : জাতিসংঘের রায়ের পর আরবীয়রা গাজা নামক শহরের উপকণ্ঠ উত্তর-দক্ষিণে বসবাস শুরু করে। আর ইহুদিরা ফিলিস্তিনের উত্তর-পশ্চিমে বসবাস করতে শুরু করে। যেহেতু উত্তর-পশ্চিমের তাদের বসবাসের সীমানা নির্ধারিত ছিল না, তাই তারা মুসলমানদের সেখান থেকে সমূলে বিতাড়িত করে ভূখণ্ড দখলের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতি করত। কখনো কখনো পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে রাখত। যার ফলে অসংখ্য আরবীয়রা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন ও মিশরে পাড়ি জমিয়েছিল। আর ইজরাইল বাহিনী এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের সীমানা বাড়িয়েই চলছিল। কিছুদিন পরেই ইহুদি জায়নবাদীদের প্রধান দাভিদ বেন গুরিয়নকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। ওই রাতের ১২:১০ মিনিটেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশ ধাপে ধাপে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে।আর তখন থেকেই শুরু হয় ইহুদিদের তাণ্ডবলীলা।

ফিলিস্তিনে হামাস : মিশরের ইসলামি রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড। দখলদার ইসরাইলিদের কাছে বাস্তুচ্যুত অনেক ফিলিস্তিনি মিশরে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ব্রাদারহুডের আদর্শে দীক্ষা নেন। ১৯৮৭ সালে এমনই দুজন আহমেদ ইয়াসিন ও আব্দেল আজিজ আল-রানতিসি প্রতিষ্ঠা করেন হামাস। হামাস হচ্ছে, হারকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া- এর সংক্ষেপ, যার অর্থ ইসলামি নবজাগরণের আন্দোলন। হামাসের দু’টি সংগঠন রয়েছে। এর একটি সাংস্কৃতিক, যার নাম দাওয়াহ। আর অপর সামরিক শাখার নাম ইজ্জ আদদ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেডস।

হামাসের আন্দোলন : ১৪-১২-১৯৮৭ সালে হামাসের আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয় যা আজও চলমান। তারা মুক্তিকামী যোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধে মরণজয়ী হয়ে ইসরাইলের জুলুমের প্রতিবাদ করে চলেছে নিরন্তর। আল্লাহর এই মুজাহিদ বাহীনির দ্বারাই হয়ত আল্লাহ বাইতুল মাকদিসকে আবারও মুসলমানদের হস্তগত করবেন- ইনশাআল্লাহ।

সূত্র : ১. বায়তুল মাকদিস ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস ২. মসজিদে আকসা কোটি মুমিনের হৃদয়ের স্পন্দ ৩. আলকাউসার রবিউল আখির ১৪৪৫হি./নভেম্বর ২০২৩ইংরেজি।