ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যেভাবে রমজানের প্রস্তুতি নেব

ইলিয়াস মশহুদ
যেভাবে রমজানের প্রস্তুতি নেব

হিজরি সনের নবম মাস রমজান। এ মাসের তিনটি ধাপ রয়েছে- রহমত, বরকত ও মাগফিরাত। এ মাসের ফজিলত, মর্যাদা ও গুরুত্ব অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি। মহিমান্বিত রমজান মোমেনের ইবাদতের সেরা মৌসুম। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের অনুশীলন, বাস্তবজীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এবং আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের মাধ্যমে ইহকাল-পরকালের সাফল্য অর্জনই এ মাসে মোমেনের লক্ষ্য হওয়া চাই। এই মাস বিশ্বের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই চায় কীভাবে এ মাস থেকে বেশি সাওয়াব লাভ করা যায়।

রমজানের প্রস্তুতির ব্যাপারে প্রত্যেক মোমেনের জন্য জরুরি হলো- রজবে বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিনকে চাষাবাদ করা, শাবানে বেশি নফল ইবাদত ও রোজার অভ্যাস তৈরি করে মনের জমিনে বীজ বপন করা; আর রমজানে রোজা, তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ ইত্যাদির মাধ্যমে ফসল ঘরে তুলে আনা।

মহিমান্বিত রমজান মাস সমাগত। আর মাত্র কয়দিন বাকি। তাই এখন থেকেই রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে বেশি করে কোরআন তিলাওয়াত, নফল রোজা ও তাহাজ্জুদে সময় দেওয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করা, তিনি যেন আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। কারণ, রমজান মাস মোমেনের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের কারণ হয়ে আগমন করে। সুতরাং প্রত্যেক মোমিনেরই রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা দরকার। শারীরিক, মানসিক, বৈষয়িক ও অভ্যাসগত, সব ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। রমজানের প্রস্তুতি কেমন হবে, নিচে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

১. রমজানের আগেই তাওবা করা : তাওবা করা সবসময় ওয়াজিব। তবে ব্যক্তি যেহেতু এক মহান মাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই অনতিবিলম্বে নিজের মাঝে ও স্বীয় রবের মধ্যে যে গুনাহগুলো রয়েছে এবং নিজের মাঝে ও অন্য মানুষের মথ্যে অধিকার ক্ষুণেœর যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো থেকে দ্রুত তাওবা করে নেয়া উচিত। যাতে করে সে পূত-পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে এ মুবারক মাসে প্রবেশ করতে পারে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে মশগুল হতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর হে মোমেনরা! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা কর; যাতে করে সফল হতে পারো। (সুরা নুর : ৩১)।

গাহাবি হজরত আল-আর্গার ইবনু ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে লোকেরা, আপনারা আল্লাহর কাছে তওবা করুন। আমি প্রতিদিন তাঁর কাছে ১০০ বার তওবা করি।’ (সহিহ মুসলিম : ২৭০২)।

২. দোয়া করা : অনেক সালাফের জীবনে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা রমজানের প্রতীক্ষায় ছয় মাস আগে থেকেই আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যেন আল্লাহ তাঁদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আর রমজানের পর পাঁচ মাস দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাঁদের আমলগুলো কবুল করে নেন। তাই একজন মুসলিম তার রবের কাছে বিনীতভাবে দোয়া করবে, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থতার সঙ্গে রমজান পর্যন্ত জীবিত রাখেন। মুমিন আরও দোয়া করবে, মহান আল্লাহ যেন তাকে নেক আমলের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন এবং তার আমলগুলো কবুল করে নেন।

৩. রমজানের আগমনে খুশি হওয়া : রমজান মাস পাওয়াটা একজন মুসলিমের প্রতি আল্লাহতায়ালার বিশেষ নেয়ামত। কারণ, রমজান হচ্ছে কল্যাণের মৌসুম। এই মাসে জান্নাতের সব দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়; আর জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে রাখা হয়। তা ছাড়া রমজান হচ্ছে কোরআনের মাস, এ মাসেই ইসলামের প্রথম যুদ্ধও সংঘটিত হয়। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, এটি আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। এটি তারা যা সঞ্চয় করে রাখে তা থেকে উত্তম।’ (সুরা ইউনুস : ৫৮)।

৪. ওয়াজিব রোজা থেকে মুক্ত হওয়া : আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন আমি আয়েশা (রা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার ওপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে শাবান মাসে ছাড়া আমি তা আদায় করতে পারতাম না।’ (সহিহ বোখারি : ১৮৪৯)।

ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘শাবান মাসে আয়েশা রা.-এর কাযা রোজা আদায় পালনে সচেষ্ট হওয়া থেকে বিধান গ্রহণ করা যায় যে, রমজানের কাযা রোজা পরবর্তী রমজান আসার আগেই আদায় করে নিতে হবে।’ (ফাতহুল বারি : (৪/১৯১)।

৫. শারীরিক প্রস্তুতি : অনেকেই গ্যাস্ট্রিক বা এ জাতীয় অন্য কোনো অসুখের দোহাই দিয়ে রোজা পালন থেকে বিরত থাকতে চায়। এটা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তা আগেভাগেই সেরে নেওয়া দরকার। শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ সুস্থতা অর্জনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

৬. মানসিক প্রস্তুতি : অনেকেই হিজরি সন বা চন্দ্রমাসের খবর রাখে না। ফলে হঠাৎ যখন শোনেন, অমুক দিন থেকে রোজা শুরু হবে, তখন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। এই অল্প সময়ে রমজানের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য যথাযথভাবে তারা অনুধাবন করতে পারেন না। ফলে সঠিকভাবে রোজা রাখাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তা ছাড়া হঠাৎ করে রোজা রাখা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই রমজান আসার আগে রোজা রাখায় অভ্যস্ত হওয়া দরকার।

৭. বৈষয়িক প্রস্তুতি : অফিস-আদালত বা দুনিয়ার নানা ঝামেলা রমজান আসার আগেই কমিয়ে ফেলা দরকার, যাতে রমজানে বৈষয়িক কাজের ভারে ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।

৮. অভ্যাসগত প্রস্তুতি : রমজান আসার আগেই নফল ইবাদত ও জিকির-আজকারের অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। যেকোনো জিনিস হঠাৎ করে গুরুত্বের সঙ্গে করা যায় ন। এ জন্য আগে থেকেই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

৯. মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা : এমনিতেই খারাপ ও মন্দকাজ পরিত্যাগ করা উচিত। তারপরও গুরুত্ব বিবেচনায় রমজান আসার আগে তওবা করে কোনো মন্দকাজের অভ্যাস থাকলে তা থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজে কথা ও কাজ ত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগ নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়।’ (সহিহ বোখারি : ১৮০৪)

১০. ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হওয়া : যেসব কাজ রমজানে আপনার ইবাদত-বন্দেগিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলো দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা।

১১. পরিবারের সবাইকে রমজানের ব্যাপারে সচেতন করা : স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে বসে রমজানের মাসয়ালা-মাসায়েল আলোচনা করা এবং ছোটদেরও রোজা পালনে উদ্ধুদ্ধ করা। পাশাপাশি যেসব বই ঘরে পড়া যায়, এমন কিছু বই সংগ্রহ করা অথবা মসজিদের ইমামকে হাদিয়া দেয়া, যেন তিনি মানুষকে পড়ে শুনাতে পারেন।

১২. রোজা রাখা : রমজানের রোজার প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসে কিছু রোজা রাখা। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত; ‘রাসুলুল্লাহ (স.) এমনভাবে সিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলতাম, তিনি আর সিয়াম ভঙ্গ করবেন না এবং এমনভাবে সিয়াম ভঙ্গ করতেন যে, আমরা বলতাম যে, তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসের গোটা অংশ রোজা পালন করতে দেখিনি এবং শাবান ছাড়া অন্য কোনো মাসে বেশি সিয়াম পালন করতে দেখিনি।’ (সহিহ বোখারি : ১৮৬৮)।

১৩. কোরআন তেলাওয়াত করা : হজরত সালামা ইবনু কুহাইল বলেছেন, ‘শাবান মাসকে তেলাওয়াতকারীদের মাস বলা হত।’ শাবান মাস শুরু হলে আমর ইবনু কায়েস তাঁর দোকান বন্ধ রাখতেন এবং কোরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর নিতেন।’

১৪. মিথ্যা ও পরনিন্দা পরিহার করা : মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যাবাদীদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক।’ (সুরা জারিয়াত : ১০) তাই রোজা রেখে মিথ্যা বলা আরও জঘন্য কাজ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যদি কেউ রোজার সময় মিথ্যা বলে তবে তার রোজা রোজা নয়।’ (সুনানে তিরমিজি : ৭০৭)।

আর অন্যের নিন্দা করা আমাদের অনেকেরই স্বভাবজাত একটি বদঅভ্যাস। এটি অত্যন্ত ভয়ানক গুনাহের কাজ। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে সামনে নিন্দাকারী ও পেছনে গীবতকারী।’ (সুরা হুমাজা : ১) কিন্তু কেউ যদি রোজা রেখে তা করে, সেটি আরও মারাত্মক। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো রোজাদার ব্যক্তি কোনো মুসলমানের নিন্দা করে তবে মনে হয় যে সে আল্লাহর হালাল করা খাদ্য খেয়ে রোজা রেখেছিল এবং আল্লাহর নিষেধ করা কিছু দিয়ে রোজা ভেঙে ফেলল।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৩৬৫৩)।

১৫. অনর্থক ও অশালীন কথাবার্তা না বলা : হাদিসে কুদসিতে এসছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে, তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হই চই না করে।’ (সহিহ বোখারি : ১৯০৪)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। রোজা হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করার নাম। কেউ তোমাকে গালি দিলে বা তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে তুমি তার সঙ্গে তেমনটি না করে শুধু এটুকুই বলো, ‘আমি রোজাদার।’ (সহিহ মুসলিম : ২৪১৬)।

উপরোল্লিখত বিষয়গুলো যে শুধু রমজানেই বিরত থাকতে হবে, এমনটি নয়; সবসময় এগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইসলামও এটাই নির্দেশ দেয়।

তবে রোজা রেখে এগুলোতে লিপ্ত হলে আমাদের সারা দিন না খেয়ে থাকা অনেকটা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তখন আমাদের রোজা রেওয়াজে পরিণত হয়। এ জন্য এখন থেকেই এসব মন্দ বিষয়গুলো থেকে আমরা নিজেদের বিরত রাখার প্রস্তুতি শুরু করব, যাতে রমজানে আমাদের রোজা রাখা সার্থক হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করেন- আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত