কোরআন তেলাওয়াত সব সময়ের জন্য একটি উত্তম আমল। কোরআন তেলাওয়াতে প্রতি হরফে দশ নেকি পাওয়া যায়। এবিষয়ে সনদগত শক্তিশালী হাদিস রয়েছে। আলেমরা সবসময়ই কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন। কোরআনের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় মোমেনের জন্য অক্সিজেন রয়েছে। রবের সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের এক গভীর আবেদন ও বার্তা রয়েছে। তাই কোরআনমুখী মানুষ সবসময়ই চেষ্টা করেন বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতে। আজকে আমরা কয়েকজন পূর্ববর্তী অনুসৃত আলেম ও বরেণ্য শায়খের কোরআন তেলাওয়াত সম্পর্কে আলোচনা করব। যারা রমজানে ঈর্ষণীয় পর্যায়ের কোরআন তেলাওয়াত করতেন। যা আমাদের মতো দুর্বল মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা ও শিক্ষণীয়।
ইমাম বোখারির কোরআন তেলাওয়াত : ইমাম বোখারি হাদিসশাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থ বোখারি শরিফের রচয়িতা। রমজান মাসে তিনি বিভিন্নভাবে কোরআন খতম করতেন। রমজানের প্রথম রাতে তার ছাত্ররা তার কাছে এসে জড়ো হতেন। তিনি তাদের নিয়ে সালাত আদায় করতেন। প্রতি রাকাতে ২০ আয়াত করে তেলাওয়াত করতেন। এভাবে একটি খতম পূর্ণ হত। আবার সাহরির সময় তিনি কোরআনের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ তেলাওয়াত করতেন। এভাবে সাহরির সময় প্রতি তিন রাতে একটি খতম হত। এছাড়া দিনের বেলায় প্রতিদিন একবার কোরআন খতম করতেন। ইফতারের সময় সেই খতম সমাপ্ত হত। তিনি বলতেন, প্রত্যেক খতমের সময়টা হচ্ছে দোয়া কবুল হওয়ার সময়। তিনি ২৫৬ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (শুআবুল ঈমান, বাইহাকি : ২/ ৪১৬)।
ইমাম নাসায়ির তেলাওয়াত : তিনি হাদিসের প্রসিদ্ধ কিতাব সুনানে নাসায়ি এর সংকলক। ইমাম নাসায়ি হিসেবে তিনি পরিচিত। সাধারণ সময়ে তিনি প্রতিদিন একবার কোরআন মাজিদ খতম করতেন। আর রমজানে প্রতি দিনে-রাতে দুইবার কোরআন খতম করতেন। এই বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ৩০৪ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (মিরআতুয যামান, সিবত ইবনুল জাওজি : ১৬/৪২৯)।
মুহাম্মদ ইবনে উমর আলকুরতুবি : তিনি পুরো রমযান মাসে ৬০ বার কোরআন শরিফ খতম করতেন। এই বিশিষ্ট বুজুর্গ আলেম ৩১৪ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (আদদীবাজুল মুযহাব : ২/১৯০)।
ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) : রমজান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কোরআন তিলাওয়াতের জন্য সমস্ত ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যেতেন। স্বাভাবিক সময়ে তিনি প্রতিদিন এক খতম তেলাওয়াত করতেন। রমজানে প্রতিদিন দুই খতম তেলাওয়াত করতেন। এভাবে ঈদুল ফিতরের রাত ও দিনসহ মাহে রমজানে সর্বমোট ৬২ বার কোরআন খতম করতেন। যখন রমজানের শেষ দশক শুরু হত, তখন তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ খুব কমই হত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ১৫০ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (আখবারু আবী হানিফা : পৃষ্ঠা ৫৫-৫৭; তারিখে বাগদাদ : ১৩/ ৩৫৫)।
সুফিয়ান সাওরি (রহ.) : সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বিশিষ্ট আলেম ও মুহাদ্দিস। রমজান মাসে অন্য সব ইবাদতের চেয়ে কোরআন তিলাওয়াতেই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ১৬১ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলি, পৃষ্ঠা ১৭১)।
ইমাম মালেক (রহ.) : ইমাম মালেক (রহ.)। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকিহ। চার ইমামের একজন। তিনি রমজান মাসে হাদিসের দরস প্রদান থেকে এবং আহলে ইলমের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকতেন। কোরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। তিনি ১৭৯ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব হাম্বলি, পৃষ্ঠা ১৭১)।
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) : তিনি চার ইমামের একজন। বিশিষ্ট ফকিহ ও মুহাদ্দিম। মুজতাহিদ আলেম। তিনি প্রতি মাসে ৩০ বার কোরআন শরিফ খতম করতেন। মাহে রমজানে ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। দিনে এক খতম, রাতে এক খতম। তিনি যে শুধু তেলাওয়াত করে যেতেন, এমনটি নয়; বরং কখনো কখনো এমন হত, তিনি কিয়ামুল লাইলে দাঁড়িয়েছেন। তখন এমন একটি আয়াত সামনে এলো, যেটা ফিকহের কোনো অধ্যায় সম্পর্কিত। তিনি সালাম ফিরিয়ে বাতি জ্বালতেন এবং সেটা নোট করে রাখতেন। এরপর আবার বাতি নিভিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। দেখা যেত, এক রাতেই কয়েকবার এমনটি ঘটত। তিনি ২০৪ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (আদাবুশ শাফেয়ি ওয়া মানাকিবুহু, ইবনে আবি হাতেম : পৃ.৭৪; মানাকিবুশ শাফেয়ি, বাইহাকি :১/ ২৪৪-২৭৯)।
খালাফ ইবনে মুহাম্মাদ (রহ.) : তিনি নিয়মিত কিয়ামুল লাইলে কোরআনের এক-ষষ্ঠমাংশ তেলাওয়াত করতেন। এরপর রমজান এসে গেলে তিনি লোকদের নিয়ে মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করতেন। তার কণ্ঠ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ছিল। একেবারে সাদামাটাভাবে তেলাওয়াত করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার তেলাওয়াত শুনে মুসল্লিদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যেত। তারাবি শেষ হলে লোকেরা সবাই একে একে ঘরে ফিরে যেত। তিনি নিজেকে একটা কাপড়ে পেঁচিয়ে মসজিদেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। অতঃপর আবার নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। কোরআন কারিমের শুরু থেকে তেলাওয়াত আরম্ভ করতেন। সাহরির সময় হলে সাথীদের ডেকে তুলতেন। ততক্ষণে তিনি ‘সূরা মুলক’ পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন। তারপর সাথীদের নিয়ে নামাজে খতম পূর্ণ করতেন এবং দোয়া করতেন। পুরো রমজান মাস তিনি এভাবেই আমল জারি রাখতেন। (রিয়াযুন নুফূস, আবু বকর আলমালেকি : ২/১৯৫)।
আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ (রহ.) : তিনি ছিলেন বিখ্যাত তাবেয়ি। তিনি বছরের অন্যান্য সময়ও মাত্র ছয় দিনে কোরআন খতম করতেন। আর মাহে রমজানে প্রতি দুই রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। মাগরিব থেকে এশার মাঝামাঝি সময়ে সামান্য বিশ্রাম করে নিতেন। এরপর সারা রাত আর ঘুমাতেন না। তিনি ৭৫ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (তবাকাতে ইবনে সা‘দ : ৮/ ১৯৫, কিতাবুস সিকাত, ইবনে হিব্বান : ৪/ ৩১)।
ইমরান ইবনে ইসাম আদদুবায়ি (রহ.) : তিনি মাহে রমজানে লোকদের নিয়ে এলাকার মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। প্রতি ৩ দিনে নামাজে একবার কোরআন খতম করতেন। তিনি ৮৩ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (তারিখে দিমাশক : ৪৩/৫১৬)।
ইবরাহীম নাখায়ি (রহ.) : তিনি ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.)-এর উস্তাদ। বিশিষ্ট ফকিহ। ইবরাহীম নাখায়ি (রহ.) থেকে বর্ণিত, রমজান মাসে তিনি তিন দিনে একবার কোরআন খতম করতেন। শেষ দশকে দুই দিনে এক খতম করতেন। তিনি ৯৬ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৪/২৫৪, বর্ণনা ৭৭০৫)।
কাতাদা ইবনে দিআমা (রহ.) : তিনি একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। তিনি প্রতি ৭ দিনে একবার কোরআন কারীম খতম করতেন। রমজান মাসে প্রতি ৩ দিনে একবার কোরআন খতম করতেন। শেষ দশকে প্রতিদিন এক খতম তেলাওয়াত করতেন। তিনি ১১৭ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। (হিলইয়াতুল আউলিয়া : ২/৩৩৯)।
ইবনে শিহাব যুহরি (রহ.) : রমজান মাস এলে ইবনে শিহাব যুহরি (রহ.) বলতেন, এ মাস তো তেলাওয়াতের মাস। রোজাদারকে ইফতার করানোর মাস। (আততামহীদ, ইবনে আব্দিল বার ৬/১১১)। (সূত্র: আলকাউসারে প্রকাশিত মাওলানা ফয়যুল্লাহ মুনির এর একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে)।