ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোরআনুল কারিমের হেদায়াত

আল্লাহর প্রিয়তম বান্দার পরিচয়

ড. আবুল হাসান সাদেক
আল্লাহর প্রিয়তম বান্দার পরিচয়

অনুবাদ : পরম করুণাময়ের বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। আর যখন অজ্ঞ জাহিল লোকেরা তাদের সম্বোধন করে কথা বলে, তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদায় ও দাঁড়ানো অবস্থায় রাত কাটায়। আর যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিকে সরিয়ে দিন। নিঃসন্দেহে-এর শাস্তি হলো স্থায়ী কষ্টদায়ক। নিশ্চয়ই তা আশ্রয় ও আবাস উভয় হিসেবেই অতি মন্দ। আর যখন তারা ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং এর মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করে। আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাস্যকে ডাকে না, আল্লাহ যে প্রাণকে হারাম করেছেন কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তি এসব কাজ করে, সে তার শাস্তি পাবে। কেয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে, আর সেখানে অনন্তকাল থাকবে লাঞ্ছিত অবস্থায়। (সুরা ফুরকান : ৬৩-৬৯)।

মর্ম ও শিক্ষা : আলোচ্য আয়াতগুচ্ছ সুরা ফুরকান থেকে উদ্ধৃত। এ সুরায় ইসলামি জীবনাদর্শের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূণ মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। যুক্তি সহকারে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ ও সীমাহীন কুদরতের বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের আনুগত্য ও আখিরাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর এখান থেকে সুরাটির শেষ পর্যন্ত আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, তারা অনন্তকালের সুউচ্চ জান্নাতে পরম শান্তিতে বাস করবে। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কয়েকটি বিশেষ গুণ বর্ণিত হয়েছে।

১. চলনে-বলনে বিনয় প্রকাশ : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম গুণ এই যে, তারা তাদের চাল-চলনে বিনয়ী হবে, তারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করবে। তারা অহংকার ভাব দেখাবে না। এতে করে তারা নিজেদের দুর্বল বা হীনমন্য ভাববে, তাও কিন্তু নয়। বরং চাল-চলনে তারা ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান, গাম্ভীর্য রক্ষা করে চলবে। কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, তুমি যমীনে অহংকার করে চলবে না, কারণ তুমি পৃথিবীকে বিদীর্ণ করে ফেরতে পারবে না, আর না পারবে পাহাড় সম উঁচু হতে।

২. বাতিলপন্থি অজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা অজ্ঞ-জাহিল, অশিক্ষিত ও সামাজিক রুচিহীন লোকের সম্মুখীন হলে নিজেদের আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে তাদের ‘সালাম’ বলে বিদায় নেয়। তারা সৌজন্য বজায় রেখে শালীন ভাষায় তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ব্যবহারের জবাব দেয়, নিজেদের অনভীপ্রেত কুট-তর্কে জড়ায় না।

৩. সারাদিন কর্মণ্ডব্যস্ততার পর রাতে আল্লাহর ইবাদত : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সারাদিন কর্মণ্ডব্যস্ততার পর রাতে নিদ্রা ত্যাগ করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করে, কোরআন তিলাওয়াত করে, গোনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করে এবং এভাবে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সেজদায় ও দাঁড়ানো অবস্থায় রাত কাটায় (আয়াত ৬৪-৬৬)। তারা সারা দিন দ্বীনের কাজ, দাওয়াতী মিশন, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারিবারিক কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকে। সারাদিনের কর্মণ্ডব্যস্ততার পর তারা রাতের বেলায় আরামের বিছানায় শুয়ে থাকে না, বরং আল্লাহর দরবারে ধর্ণা দেয়। রাতের ইবাদতে রিয়া বা লৌকিকতার সুযোগ থাকে না। তাছাড়া রাতের বেলা ইবাদত ও কোরআন অধ্যয়নে সত্যিকার মনোযোগ দেয়া যায়। তাদের জন্যে রাত আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার উপযুক্ত সময়, তাই আল্লাহর খাঁটি বান্দারা এ সময়কে কাজে লাগায়।

৪. ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং এর মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করে। আল্লাহর খাঁটি বান্দারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভারসাম্য রক্ষা করে। তারা অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় করে না। আবার প্রয়োজনীয় খাতে অর্থ খরচ করার ক্ষেত্রে কার্পণ্যও দেখায় না। মূলত অর্থ ব্যয়ের খাত ও মাত্রা সম্পর্কে কেয়ামতে প্রতিটি মানুষকে প্রশ্ন করা হবে। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসি সৃষ্টি করেছেন পরিমিত পরিমাণে। জগতের প্রতিটি বস্তুই ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। তাই মানুষও তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখবে, এটিই কাম্য। তাহলে কোথায়ও কোনো প্রকার অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না।

৫. আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাস্যকে না ডাকা : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাস্যকে ডাকে না। তারা শিরক করে না। শিরক মানে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো শক্তিকে অংশীদার সাব্যস্ত করা। এ অংশীদারিত্ব হতে পারে আল্লাহ সত্ত্বায়, তাঁর গুণাবলীতে, অথবা তাঁর ক্ষমতায়। যেভাবেই হোক র্শিক এক অমার্জনীয় পাপ। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অথবা আল্লাহর পপাশাপাশি অন্য কোনো শক্তির শরণাপন্ন হওয়া কোনো মুমিন ব্যক্তির নীতি হতে পারে না। কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কারো সাহায্য করার কোনো ক্ষমতা নেই। আল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে হলে অবশ্যই তাকে শিরকমুক্ত হতে হবে। নয়তো হাজারো নেক আমল করা সত্ত্বেও তার আমল প-শ্রম হয়ে যাবে।

৬. অন্যায়ভাবে নরহত্যা না করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ষষ্ঠ গুণ হলো, তারা আল্লাহর হারাম করা কাউকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করে না অর্থাৎ অন্যায়ভাবে নরহত্যা হত্যা করে না (আয়াত ৬৮)। অন্যায় নরহত্যা বলতে বুঝায় ইসলামী শরীয়ত অনুমোদিত নিয়মের বাইরে হত্যাকাণ্ড। ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা গোটা মানব জাতিকে হত্যা করার সমান অপরাধ। তবে ন্যায়সঙ্গত আইনানুগ পন্থায় হত্যা করা যাবে। যেমন হত্যার বদলে হত্যা, যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে হত্যা, ইত্যাদি।

৭. ব্যভিচার না করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সপ্তম গুণ এই যে, তারা ব্যভিচার করে না। ইসলাম মানুষের জৈবিক চাহিদা ন্যায়সঙ্গত ও আইনানুগ পন্থায় পূরণের সুন্দর ব্যবস্থা করেছে। এজন্য শরীয়তে বিয়ের বিধান দেয়া হয়েছে। এভাবে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পন্থায় মানুষের স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে নর-নারীর মিলনের দ্বারা পরিবার গঠন হয় এবং বংশ ধারা চালু থাকে। সেখানে পরকীয়া সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, অসামাজিক ও অশ্লীল কাজ। ব্যভিচার শুধু ইসলামেই নয়, বরং সব ধর্মেই একটি পাপ বলে স্বীকৃত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত