রিচার্ড বেলের কোরআন গবেষণা : খোদার ওপর খুদকারী
মুসা আল হাফিজ
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রিচার্ড বেল ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদদের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আরবি ভাষার অধ্যাপনা করেন। ১৯০৭ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত নিউটন ওয়াম্ফরের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের প্রধান অংশ তিনি কাটিয়ে দেন কোরআন অধ্যয়নে। এর ফসল হিসেবে রচনা করেন তার ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য কোরআন, যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে রিচার্ড বেল আল কোরআনের একটি অনুবাদ প্রকাশ করেন। তার কাজ দু’টি পশ্চিমা দুনিয়ার কোরআন বিচারে অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত। Edinburg university press থেকে রিচার্ড বেল-এর ইন্ট্রোডাকশন টু দি কোরআন গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। বইটি কোরআন গবেষণায় নতুন দিগন্ত নিয়ে হাজির হয়েছে বলে শোনা গেল। মুসলিমদের প্রতি প্রেম ও সহমর্মিতার নমুনা হিসেবে বইটি বিবেচিত হলো উপনিবেশিত মুসলিম কিছু স্কলারের কাছে। ইউরোপ-এশিয়া থেকে অনুচ্চ ও উচ্চ আওয়াজে বলা হলো, না, কোরআন প্রসঙ্গ এখন গতি ও জঙ্গমতা নিয়ে আসবে। কারণ বেল প্রথা অতিক্রম করে নতুন মাত্রা যোজনা করেছেন। কী সে মাত্রা? বেল কোরআনের আয়াত নিয়ে অভিনব রায় নিয়ে হাজির হন। বলেন, কোরআনের আয়াতসমূহের বিন্যাস যথাযথ নয়। বিষয়ের বিচারে এক আয়াতের সঙ্গে আরেক আয়াতের মিল নেই। বিচ্ছিন্ন, মিলবর্জিত, বিশৃঙ্খল বিন্যাসের কারণে কোরআন পাঠ জটিল এক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী হজরত ওসমান রা. এর সংকলন। যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) যেখানে যা পেয়েছেন, তাকে সেখানে বসিয়ে দিয়েছেন। বইটির ৭৪- ৭৮ পৃষ্ঠায় দীর্ঘ বিশ্লেষণে বেল এ উপসংহারে উপনীত হন। তিনি কোরআনের নতুন বিন্যাসের প্রস্তাবনা করেন। বেলের এ ধারণা বিলাসের পক্ষে কোনো প্রমাণ চাইলো না প্রাচ্যবিদ্যা। এখানে তত্ত খাড়া করতে কোনো প্রামাণিকতা লাগে না। বিষয় যখন ইসলাম, তখন একেকটা সুসজ্জিত অনুমান একেকটা থিউরি!! উইলিয়াম মন্টোগোমারি ওয়াট বেলের এ সংশোধন থিউরিকে বিনা প্রশ্নে অবলম্বন করলেন এবং অনুমানের ওপর আরো অনুমানের বালিয়াড়ি সাজালেন। ১৯৫৭ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত তার the dating of the Quran: শীর্ষক পরিশ্রমী রচনায় বেলের বয়ানকে কোরআন সম্পর্কিত আদি ও আসল থিউরি জ্ঞান করে এর সম্প্রসারণ করে গেলেন মাত্র।
আপত্তির গোড়ার কথা : তাদের আপত্তি কোরআনুল কারীমের গঠনধারা নিয়ে, বক্তব্য ও বিষয়ের বিন্যাস নিয়ে। বস্তুত এ আপত্তি তৈরি হয়েছে কোরআনকে মানবরচিত গ্রন্থ মনে করার ফলে। এই মৌলিক ভুলের ভিত্তিতে তারা ধরে নিয়েছেন মানুষের রচিত গ্রন্থে যে সব বৈশিষ্ট্য থাকে, কোরআনকেও ঠিক সে রকম হতে হবে। কিন্তু কোরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম। যিনি মানবীয় প্রকৃতির ঊর্ধ্বে। বিন্যাস ও সীমাবদ্ধতার ঊর্র্ধ্বে। শর্ত ও নিয়মের ঊর্র্ধ্বে। এই সব নিয়ম ও শর্ত জন্ম নিয়েছে মানুষের কাজকে ভুল ও ভ্রান্তি থেকে বাঁচানো এবং সত্যসন্ধানের পদ্ধতিগত পথের তালাশে। কেন না, মানুষ সীমাবদ্ধ ও ভ্রান্তিপ্রবণ, মানুষ অজ্ঞতা ও ভুলকে অতিক্রম করতে পারে না। কিন্তু কোরআন তো সেই আল্লাহর কালাম, যিনি সত্য, সত্যের উৎস। সৃষ্টির জন্য যেসব বাধ্যবাধকতাও শর্ত, তিনি সে সবের ঊর্ধ্বে। তার কালামও সেসবের ঊর্ধ্বে। ফলে কোরআনে গ্রন্থরচনার মেথডকে ফলো করতে হবে, এই মনোভাবই এক ভ্রান্তি। কোরআনি জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্যেকেই জানেন, পবিত্র কোরআনুল কারিমের গঠন-ধারা গতানুগতিক রীতিপদ্ধতি থেকে একেবারে আলাদা। আল কোরআন বিষয়গুলোকে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদরূপে বর্ণনা না করে বিচিত্র বিষয়াদিকে একাত্মা অবয়বে বর্ণনা করেছে। অনেক সময় একই আয়াতে আকিদা, ইবাদত, আখলাক, জীবনাচারমূলক সামাজিক বিষয়াদি এবং আখেরাত সম্পর্কীয় ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটা সকল কালের মুসলিমদের সম্মিলিত, বিতর্কহীন ও অসংশয় বিশ্বাস যে, কোরআনুল কারিমের এই বিন্যাসপদ্ধতি সম্পূর্ণ আল্লাহ প্রদত্ত। এটা না হজরত উসমান (রা.)-এর কাজ, না হজরত যায়দ (রা.)-এর সম্পাদনা। মুসলিম উম্মাহের সকল কালের জমহুর ওলামা এ প্রশ্নেও একমত যে, সুরা ও আয়াতসমূহের বিদ্যমান ধারাবাহিক বিন্যাস স্বয়ং আল্লাহতায়ালা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন। আবু বকর ইবনুল আম্বারী, আবু জাফর আল-নাহাস, ইবনুল হিসার, আল-কিরমানি, ইমাম বাগাবি, ইমাম তিবী প্রমুখের মতে কোরআনের সূরা ও আয়াত সমূহের বিন্যাস তাওকিফি বা খোদাপ্রদত্ত। এই মতের ওপর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের সকল ধারার সর্বাধিক বিশেষজ্ঞ একমত। ফলে তাকে ইজমা এর মহিমা দেওয়া হয়েছে। যদিও এতে ইবনে তাইমিয়াসহ কিছু বিশেষজ্ঞের বিচ্ছিন্ন বিরোধিতা রয়েছে। সুতরাং যখন কিছু স্থানে এমন এমন অনুচ্ছেদ এসে যায়, যার সঙ্গে পূর্ববর্তী আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায় না, তখন প্রশ্ন জন্ম নেয়। প্রশ্নটা হলো কোরআনের আয়াতসমূহের পরম্পরায় আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক কি বিদ্যমান নেই?
কোরআনের আয়াতসমূহের যোগসূত্রের প্রকৃতি : আল কোরআনের আয়াতসমূহের পরম্পরা, আভ্যন্তরীণ বিন্যাস ও ধারাবাহিকতায় সেই প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে, যার একদিকে আছে খোদায়ী সীমাহীনতা, স্পর্শাতীত হেকমত ও পদ্ধতি শাসনের ঊর্ধ্বের বাস্তবতা, অপরদিকে আছে মানুষের জন্য ধ্যানের, অবলোকনের, শিক্ষালাভের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগসূত্র। এই দ্বিবিধ বাস্তবতা দিয়ে আল কোরআনের আয়াতসমূহের বিন্যাসকে বুঝতে হবে। এর যতটুকু আমাদের বোধের আওতায় আসবে, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ দিক যেমন রয়েছে, তেমনি আছে পরোক্ষ বন্ধনও। বিভিন্ন যুগের মুফাসসিররা এই বন্ধনসূত্রকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত মুফাসসিরদের মধ্যে ইমাম ফখরুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে ওমর রাযী (রহ.) তাঁর সুবিশাল তাফসির গ্রন্থ মাফাতিহুল গায়েব এর মধ্যে এ জাতীয় সবগুলো জায়গা চিহ্নিত করেছেন। যেসব জায়গায় অনুচ্ছেদ বা আয়াতসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক অলক্ষ্যণীয় কিংবা ধারাবাহিক বিন্যাসকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়, এমন প্রতিটি জায়গায় আয়াতসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ধারাবাহিক বিন্যাসের প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। এসব সম্পর্কসূত্রকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহও। কোরআন এমন কিতাব নয়, যেখানে গতানুগতিক বিন্যাসরীতি ও ধারাবাহিকতা অবলম্বন করা হবে। এখানে বাক্যগুলোর সম্পর্ক সেই সময় ও প্রেক্ষাপটের সাথে, যখন তা অবতীর্ণ হয়। এই সম্পর্ক অবতরণের সময়ের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তার সাথে (যা একই সাথে সময় সংশ্লিষ্ট হয়েও সময়োত্তর), দ্বীনের দাওয়াতী কাজে, যেখানে যে ধরনের হেদায়েতের দরকার পড়ে, সেখানে সে ধরনের আয়াতসমূহই নাজিল হতে থাকত। যেন কোরআনুল কারিমের বিষয়বস্তুর সম্পর্ক যুগের সমাজ ধর্ম রাজনীতি এবং নৈতিক বা চারিত্রিক অবস্থাসমূহের মধ্যে প্রকাশিত। (কিন্তু কোনোভাবেই তা সেই যুগের বিষয় হয়ে থাকেনি। সকল যুগের সকল প্রেক্ষাপটের মৌলিক সমস্যা-সংকটের উত্তরণকে সে ধারণ করেছে, সেটা করেছে আপন বাক্য ও প্রকাশভঙ্গীর অনন্যতায়। কোরআনের নিজস্বতা শুধু শব্দণ্ডবাক্যে নয়, বরং সব সংগঠনের সর্বত্র নিহিত রয়েছে। সবকিছুই আপন জায়গা থেকে যে অর্থ উৎপাদন করে, তার সমন্বয়েই কোরআন আপন পূর্ণাঙ্গতা নিশ্চিত করে।) (যারা এ ব্যাপারে নিজস্ব সন্দেহে বিক্ষত, তাদের উচিত) বিভিন্ন আয়াতগুলো ও সূরাসমূহের পারস্পরিক প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধানের চেয়ে এটা দেখা যে, এই সূরাগুলো বা আয়াতগুলো কোন সময় নাজিল হয়েছে এবং ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে এর প্রাসঙ্গিকতা কী? কোরআনের আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার কারণগুলোর বা আসবাবে নুযুলের সাধারণ রীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতে এ প্রশ্নের জবাব পরিষ্কার। কিছু জায়গায় কোনো কোনো আয়াতকে বিন্যস্ত করা হয়েছে এমনভাবে, যার ফলে আয়াতগুলোর পূর্বাপর সম্পর্ক সাধারণ দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। একজন বিশ্বাসী তখন বিশ্বাসের যুক্তি থেকে সহজেই বুঝে নেবেন, আল্লাহপ্রদত্ত বিন্যাস- পদ্ধতির আবেদন বা চাহিদার ভিত্তিতেই এই বিন্যাস ঘটেছে। আয়াতগুলোকে এভাবে প্রতিস্থাপনের মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞা ও নিগূঢ় রহস্য। কোরআনের প্রতিটি শিক্ষার্থী ঐকান্তিকভাবে চান, যেন তিনি এই নিগূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। (চলবে)