ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এতেকাফ ও কদর রজনীর সন্ধান

ইলিয়াস মশহুদ
এতেকাফ ও কদর রজনীর সন্ধান

মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনের এতেকাফ আত্মিক উৎকর্ষ সাধন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। লাইলাতুল কদরের পূর্ণ ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করা হয়। রাসুল (সা.) মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করেছেন। যে ব্যক্তি যত বেশি আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য আত্মনিয়োগ করবে, সে ততো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হবে। মানুষ একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে নিয়োজিত থাকার প্রধান মাধ্যম হলো এতেকাফ। এতেকাফ মানুষের ওপর এমন আধ্যাত্মিক প্রভাব সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হয়। এতেকাফের মাধ্যমে মানুষ অধিক নেকি অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়ক হয়। আর এই এতেকাফ মোমিন মুত্তাকিদের জীবনের মুক্তির বিশেষ পাথেয়।

এতেকাফ আরবি শব্দ। অর্থ হচ্ছে, কোনো বস্তুকে অপরিহার্যরূপে ধরে রাখা, কোনো জিনিসের ওপর নিজেকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখা, শুধু অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায় সাংসারিক কাজকর্ম ও পরিবার থেকে আলাদা হয়ে মসজিদে ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলা হয়। বস্তুত, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করা ও থাকাকে এতেকাফ নামে অবিহিত করা হয়। প্রকৃত অর্থে এতেকাফ হচ্ছে পার্থিব সকল কাজ অর্থাৎ, পরিবার, সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু কাজের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়া। এর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা সম্পর্কে বান্দার জানার পরিধি বাড়ে, হৃদয়ে আল্লাহতায়ালার মহব্বত আরো সুদৃঢ় হয় এবং আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিতে দুনিয়ার আকর্ষণ তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ইবাদতের বসন্তকাল হচ্ছে রমজান মাস। রাসুল (সা.) মাদানি জীবনে প্রায় প্রতি বছর রমজানের শেষ ১০ দিন নিয়মিতভাবে এতেকাফ করেছেন। পবিত্র রমজানের বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগির মধ্যে রাসুল (সা.) যেসব কাজ বা ইবাদতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, এতেকাফ তার অন্যতম। অনেক নফল কাজ রাসুল (সা.) কখনো করেছেন, কখনো ছেড়ে দিয়েছেন; কিন্তু মদিনায় হিজরত করার পর যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, কখনো রমজানের শেষ ১০ দিনের এতেকাফ ছাড়েননি।

কোরআন-হাদিসে এতেকাফ : এতেকাফ শরিয়াহসম্মত একটি আমল হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যেমন ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম, যেন তারা আমার ঘরকে (কাবা) তাওয়াফকারীদের জন্য, এতেকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকুণ্ডসিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর মসজিদে যখন তোমরা এতেকাফ অবস্থায় থাকবে তখন স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত থেকো। সিয়ামের ব্যাপারে এগুলোই হলো আল্লাহর সীমারেখা।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ (বিশ) দিন এতেকাফ করেছেন।’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)। আম্মাজান আয়শা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) প্রতি বছর রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি এই নিয়ম পালন করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীরা এই নিয়ম জারি রাখেন। (সহিহ বোখারি)।

এতেকাফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত; ‘যখন রমজানের শেষ ১০ দিন আসত, তখন নবি করিম (সা.) কোমর বেঁধে নামতেন অর্থাৎ বেশি বেশি ইবাদত করার প্রস্তুতি নিতেন এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বোখারি)। রমজানের শেষ ১০ দিনের কোন এক বেজোড় রাতেই লাইলাতুল কদর রয়েছে। আর কদরের রাত শুধু রমজানের শ্রেষ্ঠ রাতই নয়; বরং এটি বছরের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ রাত। প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী এই রাতের ইবাদত ৮৩ বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। তাই ক্ষমাপ্রাপ্তি ও পুরস্কারের আশায় এতেকাফকে গুরুত্ব দেয়া আমাদের সবার উচিত। এতেকাফ সকল অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে এতেকাফকারীকে দূরে রাখে। সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের অতিরিক্ত পানাহার, যৌনাচার ও পশুবৃত্তির অনুগামী হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। এতেকাফ পালনের মাধ্যমে বান্দা মন্দ সংস্পর্শ, অধিক ঘুুম ও আজেবাজে কথা থেকে বান্দা নিজেকে হেফাজত করে চলে। এর মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও মহিমা অনুসন্ধান করা বান্দার জন্য সহজ হয়ে যায়, মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং দুনিয়ামুখী মানসিকতা ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা যায়। সর্বোপরি এতেকাফের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে ক্ষমা এবং পুরস্কারের আশা করতে পারে।

এতেকাফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য : এতেকাফের অন্যতম লক্ষ্য হলো লাইলাতুল কদরের যে অগণিত ফজিলত রয়েছে, তা অর্জন করা এবং কদরের মর্যাদাময় রাত যেন কোনোক্রমে বাদ না পড়ে, সে জন্য নিজেকে সদা ইবাদতে নিয়োজিত রাখা। এতেকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে বান্দা সব সৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে নিবিষ্টমনে, একান্ত নির্জনে তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে।

এতেকাফের শর্ত : ক. এতেকাফকারীকে মুসলিম হতে হবে, খ. সুস্থ হতে হবে। কোনো পাগল বা উন্মাদ এতেকাফ করতে পারবে না, গ. জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে, ঘ. অপবিত্র অবস্থায় থাকবে না, ঙ. তাকে (সুন্নাত এতেকাফকারী) সিয়াম পালনকারী হতে হবে।

এতেকাফের উপকারিতা : ক. নিশ্চিতভাবে রমজানের শেষ ১০ (দশ) দিনের যে কোন বেজোড় রাতের একটি রাত হচ্ছে লাইলাতুল কদর। তাই এতেকাফকারীর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে তার পক্ষে কদর রাতের সন্ধান করা খুব সহজ। খ. এতেকাফের ফলে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় ইবাদতে মশগুল থাকার প্রকৃত পরিবেশ তৈরি হয়, গ. এতেকাফকারী মসজিদে অবস্থানের কারণে এক সালাতের পর আরেক সালাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এই অপেক্ষার কারণে ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দোয়া করতে থাকে।

এতেকাফের উপযুক্ত ২ এপ্রিল সকাল ১১ টায় স্থান : এতেকাফের জন্য কোরআন-হাদিসের নির্দেশিত জায়গা হচ্ছে মসজিদ। রাসুল (সা.)-এর এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ ও নির্দেশনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; এতেকাফ মসজিদে হতে হবে। বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মত হচ্ছে, এতেকাফ করবেন সেই মসজিদে, যেখানে নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতে আদায় হয়। বিশেষ করে সেখানে যেন জুমার সালাত আদায় হয়। ‘শবেকদর’ প্রাপ্তির প্রসঙ্গ ও উদ্দেশ্য ছাড়াও মাহে রজমানের শেষ মুহূর্তে ইবাদত-বন্দেগির পরিমাণ বৃদ্ধির সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর স্বার্থেও এতেকাফ করা হয়ে থাকে। তাই যথাসাধ্য সবার এতেকাফের সুযোগ গ্রহণ করা সমীচীন।

এতেকাফের মাসায়েল ও নিয়ম : ক. রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া’। মহল্লার ন্যূনতম যেকোনো একজন তা আদায় করলে অন্য সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবেন, নতুবা সবাই তা পরিত্যাগের দরুণ পাপী হবেন। খ. রমজানুল মুবারকের ২০ তারিখ আসরের পর, সূর্যাস্তের পূর্বে শেষ দশকের এতেকাফের নিয়ত করে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। তারপর ২৯ বা ৩০ তারিখ সন্ধ্যায় শরিয়তসম্মতভাবে শাওয়ালের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করতে হবে। চাঁদ প্রমাণিত হলেই এতেকাফ শেষ হয়ে যাবে। গ. কেউ যদি ১০ দিনের পরিবর্তে কেবল তিন দিন, সাত দিন বা বেজোড় রাতগুলোতে এতেকাফ করে, তাহলে সেটা হবে নফল এতেকাফ।

এতেকাফের আদব : ক. অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা। যথাসম্ভব নেকবিষয়ক আলোচনায় লেগে থাকা। খ. উত্তম মসজিদ নির্বাচন করা, যেমন : মক্কা-মদিনার মসজিদে বা জামে মসজিদ। গ. বেশি বেশি কোরআন এবং হাদিস অধ্যয়ন করা। ঘ. জিকির করা। ঙ. ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেওয়া। চ. নবীজির সিরাত পাঠ করা। ছ. নবী-রাসুল ও অলিদের জীবনী পাঠ করা। জ. মুবাহ-জায়েজ কথাও প্রয়োজন ছাড়া না বলা।

যে কারণে এতেকাফ ভঙ্গ হয় : এতেকাফকারী শরিয়ত এবং মানবীয় প্রয়োজনীয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে মসজিদের বাইরে গেলেই এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে জাবে। শরিয়তসম্মত প্রয়োজন বলতে : জুমার নামাজ আদায়ের জন্য বের হওয়া আর মানবীয় প্রয়োজন হলো, মলমূত্র ত্যাগ করার জন্য, অজু ও জরুরি গোসলের জন্য বের হওয়া। ওইসব প্রয়োজন পূরণ হয়ে যাওয়ার পরও যদি অল্প সময় মসজিদের বাইরে অবস্থান করে, দাঁড়িয়ে কথা বলে, হাসি-ঠাট্টা করে; তাহলে সুন্নাত এতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে। (হেদায়া) যার শরীর থেকে জখম, কানপচা, বিড়ি-সিগারেট, ঘাম ইত্যাদি কোনো রকম দুর্গন্ধ বের হয়, তার পক্ষে মসজিদে এতেকাফ জায়েজ নয়। তিনি বাসাবাড়িতে ইবাদত-বন্দেগি করবেন। এতেকাফরত ব্যক্তি বায়ু ছাড়ার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারেন এবং তা-ই হুকুম। (ফাতওয়ায়ে রহিমিয়া : ৫/২১১-২১২)। এতেকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মূখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ইমানি চেতনাকে শাণিত করা ও উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা।

এতেকাফ ৩ প্রকার : ১. ওয়াজিব, ২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, ৩. নফল।

১. ওয়াজিব এতেকাফ : কোনো কারণবশত যদি কেউ এতেকাফের নিয়ত বা মান্নত করে তা আদায় করা ওয়াজিব। রোজাসহ এইরূপ এতেকাফ আদায় বা পালন করা আবশ্যক।

২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এতেকাফ : যা মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন করা হয়। মসজিদ এলাকার কিছুসংখ্যক লোক এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকেই আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই যদি আদায় না করে তবে সবাই গুনাহগার হবে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সবসময় রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন।

৩. নফল এতেকাফ : নফল এতেকাফের জন্য কোনো মাস বা নির্ধারিত সময়ের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো মাসে যে কোনো সময়ে এই নফল এতেকাফ করা যায়। এতেকাফের তাৎপর্য হলো, সৃষ্টিজীব থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সুনির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে নিজকে আবদ্ধ করে নেওয়া। আর আল্লাহ সম্পর্কে বান্দার জ্ঞান যত বাড়বে, আল্লাহর মহব্বত হৃদয়ে যত পোক্ত হবে, আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে যতটুকু অগ্রসর হবে, দুনিয়ার প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ততোই বৃদ্ধি পাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত