ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোজা কেন পালন করি?

সাইফ সিরাজ
রোজা কেন পালন করি?

আধুনিক পৃথিবীতে মানুষ বহুমূখী সেবা গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে। স্কিল হিসেবে যেমন মাল্টি টাস্কিংকে গুরুত্ব দিচ্ছে; তেমন করেই বহুমাত্রিক উপকার ভোগী হতে চাইছে প্রতিটা কাজেই। যে কোনো জিনিস কিনতে গিয়ে একের ভেতর অনেক খুঁজছে। কেউ আবার একটির সঙ্গে আরেকটি ফ্রি নেওয়ার কথা ভাবছে। কর্পোরেট দুনিয়া মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে নানাভাবে গবেষণা করছে। আবার মানুষের মনোজগত কর্পোরেটকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বস্তুসভ্যতার এই প্রতিযোগিতামূলক যাপিত জীবন প্রভাবিত করছে আমাদের আধাত্মিক চেতনায়ও। নানাভাবেই আমাদের রুহানিয়্যাত বস্তুবাদের রওনকে ক্লীশে হয়ে উঠছে। আত্মশুদ্ধি কিংবা আত্মোপলব্ধিও এখন নিরেট ইবাদাত থাকছে না। হয়ে যাচ্ছে বহুবিধ রসমণ্ডপ্রথার বৃত্তে বন্দি।

এমন যখন পৃথিবীর মানুষের মনোজগৎ; তখন আমাদের ইবাদত ও ইনাবাতও ধীরে ধীরে নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইবাদাতের যে আধ্যাত্মিক চেতনা অথবা ইনাবাতের যে আত্মসমর্পণ তা হয়ে উঠছে অনেকটাই লৌকিকতায় পূর্ণ, বৈষয়িক উপকার এবং একের ভেতর অনেক প্রাপ্তিনির্ভর। প্রতিটি ইবাদাতকে বস্তুবাদী চৈতন্য, নশ্বর প্রাপ্তি, যৌক্তিক কার্যকরণ, নগদ লাভ আর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার একটা প্রবণতা তীব্রভাবে প্রকট হয়ে উঠছে। যেখানে ইবাদের প্রণোদনার জন্য বহুবিধ উপকারের কথা, মনোজাগতিক স্বস্তির কথা এবং রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ফলাফলের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ইবাদাত, আত্মসমর্পণ, নিষ্ঠা ও আল্লাহর আনুগত্য গৌণ হয়ে উঠছে। ফলে, ইবাদাত রুহানিয়্যাত হারিয়ে নিরেট আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে।

রোজার বহুবিধ উপকারের কথা বলা হয়। প্রকরণ করলে তিন ধরনের উপকারের কথা আমরা পাই। আধ্যাত্মিক উপকার, চিকিৎসা বৈজ্ঞানিক উপকার, অর্থনৈতিক উপকার। সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা বৈজ্ঞানিক উপকারের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়। সেইসব উপকার থেকে কয়েকটি এমন- রোজায় কমপক্ষে ১৫ ঘণ্টা পানাহার বন্ধ থাকে। ফলে এই সময়ে পাকস্থলী, অন্ত্র-নালী, কিডনি, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রাম নিয়ে নিজেদের পুনর্গঠন করতে পারে। অপর দিকে শরীরে যেসব চর্বি জমে শরীরের ক্ষতির কারণ হয়, সেগুলো রোজার সময় দেহের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য গলতে থাকে। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী ডা. শেলটন তার ‘সুপিরিয়র নিউট্রিশন’ বইয়ে লিখেন, ‘উপবাসের সময় দেহের ভেতরের প্রোটিন, চর্বি ও শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো নিজেই পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি পায়।’ বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী নাস্টবার্নার বলেন, ‘ফুসফুসের কাশি, কঠিন কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা কয়েকদিনের রোজার কারণেই নিরাময় হয়ে যায়।’

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোযা নিয়ে বলেন, ‘রোযা হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ, রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়।’

কোনো এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোজাদার পেপটিক আলসারের রোগীরা রোজা রাখলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্যও রোযা উপকারী। নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত ওষুধ ও শল্য চিকিৎসক ডা. অ্যালেকসিসের মতে, ‘রোজার মাধ্যমে লিভার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয় ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশীর প্রোটিন, গ্রন্থিগুলো এবং লিভারে কোষগুলো আন্দোলিত হয়। আভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হৃৎপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব কিংবা আরামণ্ডআয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়।’ অর্থনৈতিক উপকারের আলাপে বলা হয়ে থাকে- এই মাসে মানুষ জাকাত ও সাদকাতুল ফিতর আদায় করেন অনেক মুসলিম। ফলে অর্থনৈতিক তারল্য বৃদ্ধি পায়। সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ হয়। ফলে মানুষের মধ্যে সাময়িক একটা অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইফতারের রকমারি আয়োজনের কারণে বাজারে একটা চাঙ্গাভাব তৈরি হয়। এই অঞ্চলের মানুষ ইফতারের জন্য বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় মুড়ি ও খেজুর বহুগুণ বেশি ক্রয় করে। রোজার পরেই ঈদুল ফিতর। তাই নতুন পোশাকের বাজারে চঞ্চলতা ফিরে আসে। এক মাসের বেচাকেনায় কারো কারো পুরো বছরের লোকশান উঠে আসে। কারো বা পুরো বছরের বাণিজ্য হয়ে যায়। রোজায় মানুষের অসুস্থতা কমে আসে। বাজে অভ্যেস যেমন তামাক জাতীয় দ্রব্য ও পান জাতিয় দ্রব্যের ব্যবহার কমে যায়। ফলে ব্যক্তিগতভাবে মানুষের অনর্থক খরচ কমে যায়। রোজার আধ্যাত্মিক দিকের আলোচনায় আমরা দেখি; রোজায় মানুষ নিয়ন্ত্রণ করেন তার ভেতরগত নানাবিধ আত্মিক রোগকে। যারা একটু অনুভূতি প্রবণ তারা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সংকট কিছুটা হলেও অনুভব করেন। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার একটা চেষ্টা প্রতিজন মুসলিমের মধ্য চলমান থাকে।

সুফিদের যে সাধনা ও জীবনবোধের কৃচ্ছ্রতা রোজায় সেই চর্চাটাও কারো কারো হয়ে যায়। খেয়ে না খেয়ে নিজের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণের ও নিজের আমিত্বকে নিয়ন্ত্রণের যে মূল প্রচেষ্টা সূফীয়ানে-কেরামের সেইটে রমজানে রোজার মাধ্যমে চাইলেই একজন মুমিন অর্জন করতে পারেন। এইসব আলাপ-আলোচনায় রোজার রাখার মূল গুরুত্বকে কখনোই ব্যাখ্যা করতে পারবে না। রোজার মূল গুরুত্বও তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হলে এর হুকুম ও আদেশ সম্পর্কের জ্ঞান জরুরি। অর্থাৎ আল্লাহ হুকুম ও রাসূলের তরিকায় রোজার গুরুত্বকে উপলব্ধি করা জরুরি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন- ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ ( সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)।

ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে চার নম্বর ভিত্তি হিসেবে রোজাকে বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা:)। তিনি বলেন, ‘পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসুল, নামাজ ক্বায়েম করা, জাকাত আদায় করা, হজ পালন করা এবং রমজান মাসে রোজা রাখা।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নম্বর : ৪ (এ্যাপ))। তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস রেখে সওয়াবের নিয়তে রমজানে রাত জাগে (তারাবি ও তাহাজ্জুদ আদায় করে), আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস নম্বর: ২২০২)। রাসুলুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই; রোজা ছাড়া। রোজা শুধু আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। আর রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুবাসের চেয়েও বেশি সুরভিত।’ (বোখারি, হাদিস : ৫৯২৭)। কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা রোজাকে ফরজ করেছেন; যেনো বান্দা তাকওয়া অর্জন করতে পারে। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয়। ভয় তখনই অর্জন হয়, যখন বান্দা আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজগুলো ছেড়ে দেয়। রমজানে হারাম, সূদ, ঘুস, মিথ্যা, প্রতারণা, ওজনে কম দেওয়া, পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা, সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি কাজ মানুষ তখনই ছাড়তে পারবে, যখন তার তাকওয়া অর্জন হবে। কেউ যদি রোজা রেখে পাপ বর্জন করতে না পারে; তার সম্পর্কে নবীজি (সা.)-এর ঘোষণা হলো, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সেই মিথ্যানুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি, হাদিস : ১৯০৩)।

রোজা তাহলে কেন রাখব? : উপরে যতগুলো উপকার আর চেতনার কথা বলা হয়েছে, এই সবগুলোই উপকার ও গুরুত্ব। কিন্তু রোজা তো মহা-মহিমের অনন্য এক হুকম। ইসলামের মূল ভিত্তির একটি। অন্যতম এক ইবাদাত। ফলে রোজা আল্লাহর হুকুম নবীজির তরিকা অনুসরণের জন্য ইবাদাত হিসেবেই আমরা পালন করবো। কেন না, নবীজি বলেন, ‘প্রতিটি আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’ (বোখারি : হাদিস নম্বর : ০১)।

বলে রোজা ইবাদাতের নিয়তেই পালন করতে হবে। অন্য যেকোনো নিয়তেই রোজা পালন করুন ইবাদত হবে না। ইবাদতের এই এক বৈশিষ্ট্য; আপনি যদি আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের জন্য ইবাদত করেন, নামাজ আদায় করেন ও রোজা রাখেন; তাহলে তার সাওয়াব আপনি পাবেন। তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। যখন ইবাদত হয়ে যাবে; তখন বাকি যতো উপকার আর চেতনার কথা আছে সবগুলোই অর্জিত হবে। কিন্তু হাজারো চেতনা আর উপকারের নিয়তে রোজা পালনে আপনার ইবাদতের ফরজিয়্যাত আদায় হবে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের সহীহ উপলব্ধি দান করুন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, করিমগঞ্জ ছোবহানিয়া কামিল মাদরাসা, কিশোরগঞ্জ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত