তাদের আপত্তি কোরআনুল কারিমের গঠনধারা নিয়ে, বক্তব্য ও বিষয়ের বিন্যাস নিয়ে। বস্তুত এ আপত্তি তৈরি হয়েছে কোরআনকে মানবরচিত গ্রন্থ মনে করার ফলে। এই মৌলিক ভুলের ভিত্তিতে তারা ধরে নিয়েছেন মানুষের রচিত গ্রন্থে যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে, কোরআনকেও ঠিক সে রকম হতে হবে। কিন্তু কোরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম। যিনি মানবীয় প্রকৃতির ঊর্ধ্বে। বিন্যাস ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। শর্ত ও নিয়মের ঊর্ধ্বে। এসব নিয়ম ও শর্ত জন্ম নিয়েছে মানুষের কাজকে ভুল ও ভ্রান্তি থেকে বাঁচানো এবং সত্যসন্ধানের পদ্ধতিগত পথের তালাশে। কেন না, মানুষ সীমাবদ্ধ ও ভ্রান্তিপ্রবণ, মানুষ অজ্ঞতা ও ভুলকে অতিক্রম করতে পারে না। কিন্তু কোরআন তো সেই আল্লাহর কালাম, যিনি সত্য, সত্যের উৎস। সৃষ্টির জন্য যেসব বাধ্যবাধকতা ও শর্ত, তিনি সে সবের ঊর্ধ্বে। তার কালামও সেসবের ঊর্ধ্বে। ফলে কোরআনে গ্রন্থ রচনার মেথডকে ফলো করতে হবে, এই মনোভাবই এক ভ্রান্তি।
কোরআনি জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকেই জানেন, পবিত্র কোরআনুল কারিমের গঠন-ধারা গতানুগতিক রীতিপদ্ধতি থেকে একেবারে আলাদা। আল কোরআন বিষয়গুলোকে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ রূপে বর্ণনা না করে বিচিত্র বিষয়াদিকে একাত্ম্য অবয়বে বর্ণনা করেছে। অনেক সময় একই আয়াতে আকিদা, ইবাদত, আখলাক, জীবনাচারমূলক সামাজিক বিষয়াদি এবং আখেরাত সম্পর্কীয় ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটা সকল কালের মুসলিমদের সম্মিলিত, বিতর্কহীন ও অসংশয় বিশ্বাস যে, কোরআনুল কারিমের এ বিন্যাসপদ্ধতি সম্পূর্ণ আল্লাহ প্রদত্ত। এটা না হজরত উসমান (রা.)-এর কাজ, না হজরত যায়দ (রা.)-এর সম্পাদনা।
মুসলিম উম্মাহের সকল কালের জমহুর ওলামা এ প্রশ্নেও একমত যে, সুরা ও আয়াতসমূহের বিদ্যমান ধারাবাহিক বিন্যাস স্বয়ং আল্লাহতায়ালা রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন। আবু বকর ইবনুল আম্বারী, আবু জাফর আল-নাহাস, ইবনুল হিসার, আল-কিরমানি, ইমাম বাগাবি, ইমাম তিবী প্রমুখের মতে কোরআনের সুরা ও আয়াতসমূহের বিন্যাস তাওকিফি বা খোদাপ্রদত্ত। এই মতের ওপর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের সকল ধারার সর্বাধিক বিশেষজ্ঞ একমত। ফলে তাকে ইজমা এর মহিমা দেওয়া হয়েছে। যদিও এতে ইবনে তাইমিয়াসহ কিছু বিশেষজ্ঞের বিচ্ছিন্ন বিরোধিতা রয়েছে। সুতরাং যখন কিছু স্থানে এমন এমন অনুচ্ছেদ এসে যায়, যার সঙ্গে পূর্ববর্তী আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায় না, তখন প্রশ্ন জন্ম নেয়। প্রশ্নটা হলো কোরআনের আয়াতসমূহের পরম্পরায় আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক কি বিদ্যমান নেই?
কোরআনের আয়াতসমূহের যোগসূত্রের প্রকৃতি : আল কোরআনে আয়াতসমূহের পরম্পরা, অভ্যন্তরীণ বিন্যাস ও ধারাবাহিকতায় সেই প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে, যার একদিকে আছে খোদায়ি সীমাহীনতা, স্পর্শাতীত হেকমত ও পদ্ধতি শাসনের ঊর্ধ্বের বাস্তবতা, অপরদিকে আছে মানুষের জন্য ধ্যানের, অবলোকনের, শিক্ষালাভের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগসূত্র। এই দ্বিবিধ বাস্তবতা দিয়ে আল কোরআনের আয়াতসমূহের বিন্যাসকে বুঝতে হবে। এর যতটুকু আমাদের বোধের আওতায় আসবে, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ দিক যেমন রয়েছে, তেমনি আছে পরোক্ষ বন্ধনও। বিভিন্ন যুগের মুফাসসিররা এই বন্ধনসূত্রকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত মুফাসসিরগণের মধ্যে ইমাম ফখরুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে ওমর রাযী (রহ.) তাঁর সুবিশাল তাফসির গ্রন্থ মাফাতিহুল গায়েব-এর মধ্যে এ জাতীয় সবগুলো জায়গা চিহ্নিত করেছেন। যেসব জায়গায় অনুচ্ছেদ বা আয়াতসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক অলক্ষ্যণীয় কিংবা ধারাবাহিক বিন্যাসকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়, এমন প্রতিটি জায়গায় আয়াতসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ধারাবাহিক বিন্যাসের প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। এই সব সম্পর্কসূত্রকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহও। ‘কোরআন এমন কিতাব নয়, যেখানে গতানুগতিক বিন্যাসরীতি ও ধারাবাহিকতা অবলম্বন করা হবে। এখানে বাক্যগুলোর সম্পর্ক সেই সময় ও প্রেক্ষাপটের সাথে, যখন তা অবতীর্ণ হয়। এই সম্পর্ক অবতরণের সময়ের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তার সাথে (যা একই সঙ্গে সময় সংশ্লিষ্ট হয়েও সময়োত্তর), দ্বীনের দাওয়াতি কাজে যেখানে যে ধরনের হেদায়েতের দরকার পড়ে, সেখানে সে ধরনের আয়াতসমূহই নাজিল হতে থাকত। যেন কোরআনুল কারিমের বিষয়বস্তুর সম্পর্ক যুগের সমাজ ধর্ম রাজনীতি এবং নৈতিক বা চারিত্রিক অবস্থাসমূহের মধ্যে প্রকাশিত। (কিন্তু কোনোভাবেই তা সেই যুগের বিষয় হয়ে থাকেনি। সকল যুগের সকল প্রেক্ষাপটের মৌলিক সমস্যা-সংকটের উত্তরণকে সে ধারণ করেছে, সেটা করেছে আপনবাক্য ও প্রকাশভঙ্গীর অনন্যতায়। কোরআনের নিজস্বতা শুধু শব্দণ্ডবাক্যে নয়, বরং সমস্ত সংগঠনের সর্বত্র নিহিত রয়েছে। সবকিছুই আপন জায়গা থেকে যে অর্থ উৎপাদন করে, তার সমন্বয়েই কোরআন আপন পূর্ণাঙ্গতা নিশ্চিত করে।)। (যারা এ ব্যাপারে নিজস্ব সন্দেহে বিক্ষত, তাদের উচিত) বিভিন্নআয়াতগুলো ও সুরাসমূহের পারস্পরিক প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধানের চেয়ে এটা দেখা যে, এই সুরাগুলো বা আয়াতগুলো কোন সময় নাজিল হয়েছে এবং ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে এর প্রাসঙ্গিকতা কী? কোরআনের আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার কারণগুলোর বা আসবাবে নুজুুলের সাধারণ রীতি-পদ্ধতিরভিত্তিতে এ প্রশ্নের জবাব পরিষ্কার। কিছু জায়গায় কোনো কোনো আয়াতকে বিন্যস্ত করা হয়েছে এমনভাবে, যার ফলে আয়াতগুলোর পূর্বাপর সম্পর্ক সাধারণ দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। একজন বিশ্বাসী তখন বিশ্বাসের যুক্তি থেকে সহজেই বুঝে নেবেন, আল্লাহপ্রদত্ত বিন্যাসপদ্ধতির আবেদন বা চাহিদার ভিত্তিতেই এই বিন্যাস ঘটেছে। আয়াতগুলোকে এভাবে প্রতিস্থাপনের মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞা ও নিগূঢ় রহস্য। কোরআনের প্রতিটি শিক্ষার্থী ঐকান্তিকভাবে চান, যেন তিনি এই নিগূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।
বিচার্ড বেলের প্রধান আপত্তি : এমনতরো আয়াতসমূহে ইসলামি প্রামাণ্য ভাষ্যগুলো যে বিশ্লেষণ হাজির করে, তাকে উপেক্ষা করে পশ্চিমারা নিজেদের আপত্তি বিস্তার করছেন। প্রশ্ন তুলছেন কোরআনের আয়াতসমূহের বিন্যাসপদ্ধতি কি আল্লাহ প্রদত্ত নাকি লিপিবদ্ধকারীরা নিজেদের রুচিতে সঠিক এবং বিচেনায় সহজ মনে করে একে সাজিয়েছেন? এ রকম বিষয়াদিকে জড়ো করে এবং ইসলামি সকল বিধিবিধানগুলোর সংকলন ও সংরক্ষণে কোরআনের বিবরণীকে উপজীব্য করে রিচার্ড বেল তার আপত্তিনামা সাজিয়েছেন। তার প্রধান আপত্তি হলো- ১. নববীযুগে বা নবীজির জীবদ্দশায় কোরআন এক মলাটে সংকলিত বা সংরক্ষিত ছিল না। ২. ইয়ামামা যুদ্ধের পর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর যুগেই কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কপি বা নুসখা তৈরি হয়, যা বিভিন্ন সাহাবীর কাছে বিভিন্নভাবে সংরক্ষিত ছিল। চামড়ার পাতলা আবরণ, খেজুরের মোলায়েম ডাল, হাড্ডি এবং পাথরসমূহের ওপর লিখে কোরআন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। ৩. লেখার উপকরণ-সামগ্রীর অভাবের কারণে সাহাবাগণ কোনো কোনো আয়াত এবং সুরাকে মূল মার্জিনের ভেতরে না লিখে মার্জিনের বাইরে বা খাতার কিনারায় লিখে রাখতেন। পরবর্তীতে কোরআন সংকলনকারীরা ওই সকল আয়াত এবং সুরাগুলোকে মার্জিনের ভেতরে মূল লেখার অন্তর্ভুক্ত করে দেন। যার কারণে আয়াতের পারস্পরিক সম্পর্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।
আপত্তিসমূহের পর্যালোচনা : রিচার্ড বেলের আপত্তিসমূহ আপাত বিচারে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু যদি আমরা এর বাস্তবতা ও অন্তঃসারকে তালাশ করি, তখন দেখি এর অন্তর্গত রূপ, যা ভুল ও বিভ্রান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। (ক) প্রথম আপত্তি হলো- নববি যুগে কোরআন কোনো আকারে ছিল এ নিয়ে। এ আপত্তির মতলব হলো পরবর্তীতে কোরআনে বদল এলো কি না, এই সংশয় তৈরি করা। কিন্তু এ জাতীয় জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছে আল কোরআন স্বয়ং। কোরআন মাজিদ হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব খোদ আল্লাহতায়ালাই নিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, অর্থাৎ ‘এই কোরআনকে আমি অবতীর্ণ করেছি আর আমিই তার হেফাজত করব। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে ‘কোরআনের মধ্যে মিথ্যা সামনে দিয়েও আসতে পারবে না, পেছন থেকেও আসতে পারবে না’। সুরা কিয়ামাহ-এ আল্লাহতায়ালা কোরআনের হেফাজত নিজের দায়িত্বে নেওয়ার ঘোষণা দেন। ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয় এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্বে। কাজেই আমি যখন তা পাঠ করি, তখন তুমি সে পাঠের অনুসরণ কর।’ এসব আয়াত প্রমাণ করে যে, কোরআনকে হুজুর (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই পরিপূর্ণ সংকলন করে একটি বিশেষ বিন্যাসের মাধ্যমে নবী (সা.) কে শোনানো হয়েছে। যদি আয়াতের এই ওয়াদা পূর্ণ না হতো তাহলে আল্লাহপাক নবীজিকে সেই কেরাতের বা সেই অহির কেরাত মনোযোগ দিয়ে শোনার ও অনুসরণ করার হুকুম দিতেন না।
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হুকুম ছিল কোরআন সংকলনের পর যেভাবে যে বিন্যাসে জিবরিলের মাধ্যমে হুজুর (সা.) কে কোরআন শোনানো হয়েছে, তিনি যেন সেভাবেই কোরআন পড়েন। এই হুকুমের মূল উদ্দেশ্য ছিল, রাসুল (সা.) যেন উম্মতকে ওই বিন্যাস অনুযায়ী কোরআন শোনান ও শেখান, যে বিন্যাসে সর্বশেষ কেরাত শেখানো হয়ছে তাঁকে। কোরআনের এই তারতিব বা বিন্যাসপদ্ধতিই লৌহে মাহফুজে বিদ্যমান। বোখারি ও মুসলিম শরিফের বর্ণনা প্রমাণ করে যে, প্রত্যেক রমজানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে জিবরিল আমীন (আ.) কোরআনের দাওর করতেন। (দাওর করার মানে হচ্ছে পরস্পরে পরস্পরকে শুনানো।) প্রতি রমজানে ততটুকু দাওর করতেন, যতটুকু ওই সময় পর্যন্ত নাজিল হয়েছে। যাতে করে কোনো ভুলভ্রান্তির আশঙ্কাটুকুও না থাকে।
আল কোরআনের পাঠকমাত্রই লক্ষ্য করবেন, কোরআনের বহু আয়াত ও শব্দণ্ডবাক্য বার বার জানান দেয় যে, আল কোরআন পূর্ব থেকেই সুবিন্যস্ত এবং যথোচিতভাবে সংকলিত ছিল। মুশরিকদের একটি আপত্তির বিবরণী থেকেও এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ইরশাদ হচ্ছে- ‘এবং তারা বলে, এটা তো পূর্ববর্তী লোকদের লেখা আখ্যান, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। সকাল-সন্ধ্যায় সেটাই তার সামনে পড়ে শোনানো হয়।’ মক্কায় অবতীর্ণ এই আয়াত স্পষ্ট করে দিচ্ছে, কাফেররা জানতো এবং বলতো (ক) কোরআন রচিত অবয়বে বিদ্যমান, (খ) এর লেখক মহানবী (সা.) নিজে নন। তিনি একে লিখিয়ে নিয়েছেন, আপন তত্ত্বাবধানে (গ) বিন্যস্ত অবয়বে তা বিদ্যমান (ঘ) যাকে সকাল-সন্ধ্যা পাঠ করা হয়। রাসুল (সা.) তাঁর জীবনের শেষ রমজানে মসজিদে নববিতে জিব্রাইল (আ.)-এর সাথে পূর্ণাঙ্গ কোরআন শরিফ দুইবার দাওর করেছেন (একে অপরকে শুনিয়েছেন)। ওই সময় হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) এবং জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) নিজ নিজ কপিতে তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) নবীজি থেকে যা শুনে লিখেছেন, তা আবার লেখার শেষে ধারাবাহিকভাবে নবীজিকে শুনিয়েছেন। ইবনে কুতাইবার বর্ণনায় স্পষ্ট যে, হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু নিজ নুসখার (কপি) মাধ্যমে রাসুল (সা.) কে কোরআন শুনিয়েছেন।
বোখারির রেওয়ায়েত অনুযায়ী রাসুলের জীবদ্দশায় চারজন আনসারি সাহাবা কোরআনুল কারিম সংকলন করেছেন। তারা হলেন হজরত ১. ওবাই ইবনে কাব (রা.) ২. মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) ৩. যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) ৪. আবু যায়েদ (রা.)। এমন মুহাজিরের সংখ্যাও বিপুল, যাদের নিকট কোরআনের পূর্ণাঙ্গ ও আসল নুসখা ছিল এবং তারা হাফেজও ছিলেন। ফলে এটা কোনোভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় আল কোরআন লিখিত অবয়বে বিদ্যমান ছিল না।
(খ) রাসুল (সা.) এর জীবদ্দশায় কোরআন কি সুবিন্যস্ত ও যথাযথভাবে সংকলিত ছিল? ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের এই সংকলন ও সংরক্ষণের ওপর প্রমাণের ভান্ডার বিপুল। এ বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অনেক গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। গবেষণাসমূহে লক্ষ্য করা যায় দুটি বিপরীতমুখী সূক্ষ্ম দিক। একটি হচ্ছে কোরআন প্রথমে কাঠ, হাড্ডি, পাতা এবং গাছের ছাল-বাকল ইত্যাদিতে লেখা ছিল। পরবর্তীতে রাসুলের ওফাতের পরে তা এক মলাটে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আর এক্ষেত্রে হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সংকলন-কর্ম প্রামাণ্য নজির। জায়েদ (রা.)-এর সংকলনটি সম্পন্ন হলো কীভাবে? যে সাহাবিদের দিয়ে রাসুল (সা.) যেসব মূলকপি লিখিয়েছিলেন, সেই সব নুসখা একত্র করেই পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত সেই নুসখা তৈরি করা হয়। এই বর্ণনার আলোকে কোরআন সম্পর্কে কোনো সন্দেহ তৈরি হয়? তা হয় না। কারণ নবীজির তত্ত্বাবধানে ও অনুমোদনে রচিত পূর্ণাঙ্গ নুসখা হজরত জায়েদ (রা.)-এর কাছেই ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষীয় ও সমন্বিত একটা নুসখার দরকার ছিল, যেখানে সকল সাহাবির সকল নুসখাকে একত্র করে প্রতিটি বাক্য, শব্দ এমনকি হরফকে যাচাই করে কেন্দ্রীয় সংকলন নিশ্চিত করা হবে। ফলে জায়দ (রা.) এর সংকলন মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরে হয়েছে, কথাটি সঠিক, আবার ভুল।
মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের আগে যায়দ (রা.) কোরআনের পূর্ণাঙ্গ সংকলন করেন মহানবীর (সা.) তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আরো সাহাবাদের কাছে কোরআনের আরো কপি বিদ্যমান ছিল। মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরে হজরত আবু বকরের (রা.) তত্ত্বাবধানে পূর্ববর্তী সমস্ত নুসখাকে একত্র করে একটি সংকলন তৈরি করা হয়। এর মানে পরিষ্কার। নবী (সা.) নিজের জীবদ্দশাতেই পূর্ণাঙ্গ কোরআন সহিফা আকারে সংকলন করে যান। এই সত্য সুদৃঢ় দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত। যখনই কোরআনের কোনো সুরা বা আয়াত নাজিল হতো, তখন যারা অহি লেখক বা সাধারণভাবে লিখতে সক্ষম, তারা ওই মুহূর্তে সামনে লিখনসামগ্রী যাই পেতেন, তাতে লিখে রাখতেন। কাঠ, চামড়া, হাড্ডি, পাতা, কাপড়... যা পেতেন, তাতেই সংরক্ষণ করতেন আয়াত। কারণ এইমাত্র অবতীর্ণ অহিকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার সব সময় লেখালেখির ভালো উপাদান সাহাবাদের সঙ্গে থাকবে, তখনকার বাস্তবতায় এটাও হবার ছিল না। এজন্য যখন যেখানে যেভাবে লেখা সম্ভব হয়েছে, সেভাবেই লিখে রাখতেন লেখক সাহাবারা। পরবর্তীতে প্রতে?্যকেই নিজ নিজ মূল কপিতে তা আবারো লিখে নিতেন বা সংকলন করে নিতেন। এজন্য হাদিসে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন পরিভাষার ব্যবহার দেখা যায়। একটি ‘কিতাবাত’ তথা ‘লেখা, আরেকটি জমা বা সংকলন। কিতাবাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তৎক্ষণাৎ নোট করে ফেলা। আর জমা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘরে রাখার নুসখা রচনা। এই জমা বা সংকলনের পদ্ধতি এমন ছিল যে, প্রতিবছর রমজানে রাসুল (সা.)-এর ওপর যে পর্যন্ত কোরআন নাজিল হত সেই পরিমাণ কোরআন ধারাবাহিকতা ও সুস্পষ্ট ধীরতার সঙ্গে নবী (সা.) তেলাওয়াত করতেন। তারপর সকলেই সে অনুযায়ী নিজ নিজ নিজ নুসখায় তা লিখে নিতেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর যুগের কোরআন লিপিবদ্ধকারী কমিটির নিকট আসল কপি তো ছিলই; তারপরও সকল সাহাবা থেকে তাদের মূল কপিগুলো চেয়ে নিয়ে সবগুলো পর্যবেক্ষণ করে একটি সরকারি নুসখা তৈরি করেছিলেন। যা একটি পা-লিপিতে রচিত হয়, এটি ছিল সুচারু নিরীক্ষণের সাথে তৈরি পূর্ণাঙ্গ একটি নুসখা। তাই এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন যে, নবীযুগের মধ্যেই পরিপূর্ণ কোরআন সংকলিত হয়নি এবং হুজুর (সা.) কোরআন সংকলন ও সংরক্ষণের কাজ অপূর্ণাঙ্গ রেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। যেহেতু কোরআনের ধারাবাহিক বিন্যাস আল্লাহ প্রদত্ত তাই বিন্যাস নিয়ে আপত্তি তোলাও অমূলক। মজার ব্যাপার হলো রিচার্ড বেল আয়াতসমূহের ধারা পরম্পরার ওপর আপত্তি তুলেছেন এবং এ জন্য দায়ী করেছেন ওসমান (রা.)-এর সময়ের সংকলনকে। কিন্তু তিনি আবার স্বীকার করেছেন, কোরআনের ধারাবাহিক লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ আবু বকর (রা.)-এর যুগেই সম্পন্ন হয়েছে। (চলবে)