রিচার্ড বেলের কোরআন গবেষণা : খোদার ওপর খুদকারী
মুসা আল হাফিজ
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় কোরআন কি সুবিন্যস্ত ও যথাযথভাবে সংকলিত ছিল? ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের এই সংকলন ও সংরক্ষণের ওপর প্রমাণের ভান্ডার বিপুল। এ বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অনেক গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণাসমূহে লক্ষ্য করা যায়, দুটি বিপরীতমুখী সূক্ষ্ম দিক। একটি হচ্ছে কোরআন প্রথমে কাঠ, হাড্ডি, পাতা এবং গাছের ছাল-বাকল ইত্যাদিতে লেখা ছিল। পরবর্তীতে রাসুলের ওফাতের পরে তা এক মলাটে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আর এক্ষেত্রে হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সংকলন-কর্ম প্রামাণ্য নজির। জায়েদ (রা.)-এর সংকলনটি সম্পন্ন হলো কীভাবে? যে সাহাবীদের দিয়ে রাসুল (সা.) যেসব মূলকপি লিখিয়েছিলেন, সেই সব নুসখা একত্র করেই পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত সেই নুসখা তৈরি করা হয়। এই বর্ণনার আলোকে কোরআন সম্পর্কে কোনো সন্দেহ তৈরি হয়? তা হয় না। কারণ নবীজির তত্ত্বাবধানে ও অনুমোদনে রচিত পূর্ণাঙ্গ নুসখা হজরত জায়েদ (রা.) এর কাছেই ছিলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষীয় ও সমন্বিত একটা নুসখার দরকার ছিল, যেখানে সকল সাহাবির সকল নুসখাকে একত্র করে প্রতিটি বাক্য, শব্দ এমনকি হরফকে যাচাই করে কেন্দ্রীয় সংকলন নিশ্চিত করা হবে। ফলে জায়দ (রা.)-এর সংকলন মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরে হয়েছে , কথাটি সঠিক, আবার ভুল।
মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের আগে জায়দ (রা.) কোরআনের পূর্ণাঙ্গ সংকলন করেন মহানবীর (সা.) তত্তাবধানে। কিন্তু আরো সাহাবাদের কাছে কোরআনের আরো কপি বিদ্যমান ছিল। মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরে হজরত আবু বকরের (রা.) তত্ত্বাবধানে পূর্ববর্তী সমস্ত নুসখাকে একত্র করে একটি সংকলন তৈরি করা হয়। এর মানে পরিষ্কার। নবী (সা.) নিজের জীবদ্দশাতেই পূর্ণাঙ্গ কোরআন সহিফা আকারে সংকলন করে যান। এই সত্য সুদৃঢ় দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত।
যখনই কোরআনের কোনো সুরা বা আয়াত নাজিল হতো, তখন যারা অহি লেখক বা সাধারণভাবে লিখতে সক্ষম, তারা ওই মুহূর্তে সামনে লিখনসামগ্রী যাই পেতেন, তাতে লিখে রাখতেন। কাঠ, চামড়া, হাড্ডি, পাতা, কাপড় যা পেতেন, তাতেই সংরক্ষণ করতেন আয়াত। কারণ এইমাত্র অবতীর্ণ অহিকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার সব সময় লেখালেখির ভালো উপাদান সাহাবাদের সঙ্গে থাকবে, তখনকার বাস্তবতায় এটাও হবার ছিল না। এজন্য যখন যেখানে যেভাবে লেখা সম্ভব হয়েছে, সেভাবেই লিখে রাখতেন লেখক সাহাবারা। পরবর্তীতে প্রত্যেকেই নিজ নিজ মূল কপিতে তা আবারো লিখে নিতেন বা সংকলন করে নিতেন। এজন্য হাদিসে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন পরিভাষার ব্যবহার দেখা যায়।
একটি ‘কিতাবাত’ তথা ‘লেখা, আরেকটি জমা বা সংকলন। কিতাবাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তৎক্ষণাৎ নোট করে ফেলা। আর জমা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘরে রাখার নুসখা রচনা। এই জমা বা সংকলনের পদ্ধতি এমন ছিল যে, প্রতিবছর রমজানে রাসুল (সা.)-এর ওপর যে পরিমাণ কোরআন নাজিল হত সেই পরিমাণ কোরআন ধারাবাহিকতা ও সুস্পষ্ট ধীরতার সঙ্গে নবী (সা.) তেলাওয়াত করতেন। তারপর সকলেই সে অনুযায়ী নিজ নিজ নিজ নুসখায় তা লিখে নিতেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর যুগের কোরআন লিপিবদ্ধকারী কমিটির নিকট আসল কপি তো ছিলই; তারপরও সকল সাহাবাদের থেকে তাদের মূল কপিগুলো চেয়ে নিয়ে সবগুলো পর্যবেক্ষণ করে একটি সরকারি নুসখা তৈরি করেছিলেন।
যা একটি পা-লিপিতে রচিত হয়, এটি ছিল সুচারু নিরীক্ষণের সঙ্গে তৈরি পূর্ণাঙ্গ একটি নুসখা। তাই এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন যে, নবী যুগের মধ্যেই পরিপূর্ণ কোরআন সংকলিত হয়নি এবং হুজুর (সা.) কোরআন সংকলন ও সংরক্ষণের কাজ অপূর্ণাঙ্গ রেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। যেহেতু কোরআনের ধারাবাহিক বিন্যাস আল্লাহ প্রদত্ত তাই বিন্যাস নিয়ে আপত্তি তোলাও অমূলক। মজার ব্যাপার হলো- রিচার্ড বেল আয়াতসমূহের ধারা পরম্পরার উপর আপত্তি তুলেছেন এবং এ জন্য দায়ী করেছেন ওসমান (রা.)-এর সময়ের সংকলনকে। কিন্তু তিনি আবার স্বীকার করেছেন, কোরআনের ধারাবাহিক লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ আবু বকর (রা.)-এর যুগেই সম্পন্ন হয়েছে।
(গ) কোরআন সংকলন হয়েছিল যেসব সামগ্রীর মধ্যে, তা লক্ষ্যণীয়। হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) কোরআন সংকলন করেন চামড়ার পাতলা আবরণে খেজুর বা খেজুরের পাতায় কাঠের তক্তায় এবং পাথরের গায়ে। এসব উপাদানকে ভিত্তি করে রিচার্ড বেল তার ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ ঃড় ঃযব ছঁৎধহ গ্রন্থে দাবি করেন যেসব উপাদানে কোরআন রচিত হয়, তার আকার ছিল সমস্যার কারণ। এগুলোর সাইজ একই রকম ছিল না। ফলে যেখানে যতটুকু সংকুলান হয়েছে, সেটাই হয়ে গেছে কোরআনের এক অংশ। অন্য উপাদানে যা লেখা হয়েছে, তা হয়ে উঠেছে আরেক অংশ।
এতে মিল নষ্ট হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। অধিকাংশ সময় কোনো উপাদানের এক পিঠে লেখার পর আর জায়গা না থাকলে অন্য উপাদানে যদি জায়গা অবশিষ্ট থাকত, তাহলে তাকে কাজে লাগানো হতো। প্রাথমিক অহি লেখকরা অহিকে সংরক্ষণ করার জন্য ওই খালি জায়গাগুলোতে আয়াতগুলো লিখে রাখতেন। পরবর্তীতে সংকলনকারীরা নিখুঁত বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই টিকা টিপ্পনীতে লেখা আয়াত ও অভিন্ন পাতার পিঠে লেখা আয়াতগুলোকে মূলকপিতে সংযোজন করে নিতেন এই বিষয়টিকে সঠিক সাব্যস্ত করার জন্য তারা কিছু প্রসিদ্ধ গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়েছেন।
কিন্তু রিচার্ড বেলের এই দাবি নির্বিচারী এবং জবরদস্তি। খ্রিষ্টান মিশনারীদের তরফে কোরআনে মানবীয় হস্তক্ষেপকে প্রমাণের ধারাবাহিক চেষ্টা বেলের গবেষণায় যে আকার পেয়েছে, তাতে মনে হয় তার মস্তিষ্কে কোরআনের বিন্যাসের নিজস্ব প্রস্তাবনা বদ্ধমূল হয়ে আছে। সেজন্য আল কোরআনের বিদ্যমান ধারাবাহিকতাকে যেভাবেই হোক, ভুলের ফসল হিসেবে তিনি দেখাতে উদগ্রীব। কিন্তু এটা স্পষ্ট ও প্রমাণিত যে, আল কোরআনের আয়াতসমূহের বিন্যাস, কোন সুরায় কত আয়াত, কোন আয়াত কোন সুরার অন্তর্গত, কোন বাক্যের অবস্থান কোথায় হবে? সব কিছুই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।
আল্লামা তাহির ইবন আশুর (রহ.) বলেন, ‘সুরাসমূহের নাম অহি নাজিলের সময় থেকেই নির্ধারিত। ‘শায়েখ সুলাইমান আল বুজাইরমি (রহ.) বলেন, ‘জিবরীল (আ.) রাসুলুল্লাহেেক সংবাদ দিয়েছেন যে, কোরআন এভাবেই লাউহে মাহফুযে আছে।’
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, হজরত ওসমান (রা.) বলেছেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর কোন আয়াত নাজিল হত, তখন তিনি অহি-লেখক কাউকে ডেকে বলতেন, এই আয়াতটি অমুক সুরার মধ্যে অমুক স্থানে রাখো। সুরা আনফাল প্রথম দিকের মাদানী সুরা এবং সুরা তওবা শেষের দিকের মাদানী সুরা। দু’টি সুরার বিষয়বস্তু প্রায় একই। সেজন্য সুরা দু’টিকে আমি পাশাপাশি রেখেছি। কিন্তু তিনি বলেননি যে, এটি ওটার অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য আমি দু’টি সুরার মাঝে বিসমিল্লাহ... লিখিনি’।
জিবরিল (আ.) প্রতিবছর রমজানে রাসুল (সা.)-এর নিকটে এসে কোরআন পাঠ করতেন এবং তার মৃত্যুর বছরে দু’বার পাঠ করে শুনান। এখান থেকেও বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। আয়াতসমূহের ধারাবাহিকতার বিষয়টি রাসুল (সা.) কর্তৃক সম্পাদিত না হলে তা নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরোধ হত। কিন্তু তা হয়নি। অতএব কোরআনের এ বিন্যাস ও ধারাবাহিকতার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমাও সুস্পষ্ট। জালালুদ্দীন সুয়ুতি (রহ.) প্রমাণ করেছেন, আল কোরআনের সুরাসমূহের বিন্যাস ও ক্রমধারা অবশ্যই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ফরমান ও নির্দেশ মোতাবেক হয়েছে। (চলবে)